দর্শকশূন্য: বার্সেলোনায় রাজনৈতিক ঝামেলায় লাস পালমাসের বিরুদ্ধে ফাঁকা ক্যাম্প ন্যু স্টেডিয়ামে চলছে লিও মেসিদের খেলা। রবিবার। টুইটার
বার্সেলোনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, এল প্রাতের বাইরে পা রেখে আপনার মনে হতেই পারে, স্পেনে পৌঁছে গেলাম।
যদি সে রকম মনে হয়, তা হলে কিন্তু খুব ভুল ভাববেন। আপনি মোটেই স্পেনে পা দেননি। আপনি এসে পড়েছেন কাতালুনিয়ায়!
বছর খানেক আগে বার্সেলোনায় নামার পরে এই ভুলটাই ধরিয়ে দিয়েছিলেন লা লিগার এক বড় কর্তা। বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর মুখে তিনি হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘‘আপনারা ভাবছেন বুঝি স্পেনে এসেছেন? মোটেই কিন্তু তা নয়। আপনারা কাতালুনিয়ায় এসেছেন। স্পেনে যেতে হলে চলে যান মাদ্রিদে।’’ ভারতীয় সাংবাদিকদের কিছুটা বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে এর পরে তিনি বলে ওঠেন, ‘‘থাকছেন তো কয়েক দিন। ঠিক বুঝে যাবেন।’’
আরও পড়ুন: দেশের হয়ে খেলতে চান না পিকে
সত্যিই বোঝা গিয়েছিল। বিশেষ করে ফুটবলকে কেন্দ্র করে এই ‘দুই দেশের’ রেষারেষি যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে, সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল বার্সা ক্লাব প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এবং ক্যাম্প ন্যু-তে মেসি-নেমার-সুয়ারেজদের ম্যাচে দর্শকদের আবেগের বিস্ফোরণ দেখে।
অগ্নিগর্ভ: ভোট দিতে এসে পুলিশের হাতে প্রহৃত হচ্ছেন বার্সেলোনার বাসিন্দারা। রবিবার। ছবি: টুইটার।
এখনও কানে ভেসে আসে সেই গর্জন। ক্যাম্প ন্যু-তে বার্সেলোনার কোনও ম্যাচ ১৭ মিনিট ১৪ সেকেন্ড গড়ালেই দর্শকদের একটা অংশ উঠে দাঁড়িয়ে গর্জন করতে থাকে, ‘‘স্বাধীনতা চাই, স্বাধীনতা।’’ কীসের স্বাধীনতা, কীসের এই দাবি? প্রশ্ন করার পরে লা লিগার অডিও ভিসুয়াল বিভাগের দায়িত্বে থাকা রজের ব্রসেল সে দিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাপারটা। ১৭১৪ সালেই যে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের দখলে চলে গিয়েছিল কাতালুনিয়া। বার্সেলোনা দখল করে নিয়েছিল স্প্যানিশ শক্তি। সেই যন্ত্রণা আজও তিলে তিলে দগ্ধ করে কাতালানদের। ফুটবল হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশের এক রাস্তা।
তাই রবিবার বার্সেলোনায় স্বাধীনতা চেয়ে কাতালানদের ভোটদানের প্রচেষ্টা অবাক করে না। নিরীহ মানুষের ওপর স্প্যানিশ পুলিশের হামলাও কি অবাক করার মতো ঘটনা? সম্ভবত নয়। কারণ স্পেন বনাম কাতালুনিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যে তিনশো বছর ধরে চলে আসছে।
‘আমরা’ আর ‘ওরা’— এই শব্দ দু’টো বোধহয় স্প্যানিশ আর কাতালানদের সম্পর্কে খুব ভাল করেই ব্যবহার করা যায়। গত বছর লা লিগার আমন্ত্রণে বার্সেলোনায় থাকার সময় একটা ঘটনা ঘটেছিল। ‘বুল ফাইটিং’-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল কাতালান সংসদ। বছর ছ’য়েক সেই নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকার পরে হঠাৎ করে স্প্যানিশ আদালত সেই সময় বলে দেয়, ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। সেই রায় শোনার পরে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বার্সেলোনার মানুষ। বার্সেলোনার এক সাংবাদিক তখন বলেছিলেন, ‘‘আমরা পশু-প্রাণী ভালবাসতে জানি। স্পেনের মানুষ জানে না। না হলে এ রকম জঘন্য একটা প্রথাকে কেউ চালু রাখে। কাতালুনিয়ায় কিন্তু ষাড়ের লড়াই আপনি কোনও দিন দেখবেন না।’’
রবিবার পুলিশি আক্রমণে চারশোর ওপর মানুষ জখম। রেহাই পাননি বয়স্ক থেকে মহিলা— কেউই। সোশ্যাল মি়ডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষোভ। কেউ কেউ বলে দিচ্ছেন, স্পেন থেকে পুলিশ পাঠানো হয়েছে কাতালানের মানুষদের ওপর হামলা চালানোর জন্য। কেউ কেউ বলেছেন, লাঠি চালিয়ে, ব্যালট বক্স ভেঙে দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করা যাবে না। এই রোষ, এই ক্ষোভ জমে উঠেছে দীর্ঘ দিন ধরে। ক্যাম্প ন্যু-তে স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে একটা সুড়ঙ্গ গিয়ে উঠেছে বাইরের রাস্তায়। ম্যাচের রাতে টানেলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম, মেসি-নেমারদের গাড়ি একে একে বেরিয়ে আসছে আর দু’পাশে দাঁড়ানো দর্শকরা হাততালি দিয়ে উঠছেন। স্টিয়ারিংয়ে সুপারস্টাররা। নেই কোনও পুলিশ বেষ্টনী, নেই গাড়ির ভিতরে আলাদা কোনও ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী। অবাক হয়েই পাশে দাঁড়ানো বার্সা প্রতিনিধির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘‘গাড়ি যদি কোনও সিগনালে আটকে যায়, তা হলে ফুটবলারদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না?’’ যথেষ্ট বিরক্ত হয়েই তিনি বলে ওঠেন, ‘‘আমরা কি স্পেনের লোক নাকি যে ফুটবলারদের দেখলেই হামলে পড়ব?’’
কাতালানরা মনে করেন, ফুটবল তাঁদের কাছে ধর্ম। ফুটবলাররা তাঁদের কাছে ঈশ্বর। ভালবাসা আছে, ভক্তি আছে, কিন্তু গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া নেই। আদেখলাপনা নেই। ‘‘অথচ আপনি যদি মাদ্রিদে যান, দেখবেন রোনাল্ডোকে নিয়ে ওখানে কী হচ্ছে। যেন পারলে ওরা ছিঁড়ে খাবে। আমরা জানি, ফুটবলারদের সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করতে হয়,’’ মহিলার কথা শুনে আঁচ পাওয়া গিয়েছিল, কতটা বিদ্বেষ জমা হয়েছে।
সবই ভাবা গিয়েছিল। কিন্তু ভাবা যায়নি, কোনও দিন ক্যাম্প ন্যু-তে শূন্য গ্যালারির সামনে খেলতে হবে লিও মেসিদের। ‘ঈশ্বর’ গোল করবেন, কিন্তু মাঠ জু়ড়ে থাকবে
শব্দহীন হাহাকার।
১৭ মিনিট ১৪ সেকেন্ড হয়ে যাবে, কিন্তু স্বাধীনতার সেই গর্জন আর উঠবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy