Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
বাংলার ফুটবলে আঁধার: আনন্দবাজারের ময়নাতদন্ত

সুব্রত-মনোরঞ্জনদের জেলায় আকর্ষণ হারাচ্ছে লিগ

উত্তর চব্বিশ পরিগনায় জেলা লিগ এখনও হয়। সুপার ডিভিশনে খেলছে ১৮টি ক্লাব। প্রথম ডিভিশনে রয়েছে ১৬টি ক্লাব। দ্বিতীয় ডিভিশনে ক্লাবের সংখ্যা ২২টি। কিন্তু অতীতের সেই আকর্ষণ বা জৌলুস নেই।

—প্রতীকী ছবি।

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৮ ০৭:৫৭
Share: Save:

বাংলা ফুটবলের আঁতুড়ঘর বলা হত উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলাকে। ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি ও ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে ভারতীয় ফুটবল দলের সদস্য কৃষ্ণ কুমার (কেষ্ট) পালের উত্থান এই জেলা থেকেই। সনৎ শেঠ, পরিমল দে, অশোকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত মিত্র, সুব্রত ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, অলোক দাস, দীপেন্দু বিশ্বাস থেকে এই প্রজন্মের সুব্রত পাল, অরিন্দম ভট্টাচার্য, প্রণয় হালদার, মহম্মদ রফিক— উঠে এসেছেন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা থেকেই। অথচ সেখানে এখন ফুটবল গুরুত্ব হারাচ্ছে!

উত্তর চব্বিশ পরিগনায় জেলা লিগ এখনও হয়। সুপার ডিভিশনে খেলছে ১৮টি ক্লাব। প্রথম ডিভিশনে রয়েছে ১৬টি ক্লাব। দ্বিতীয় ডিভিশনে ক্লাবের সংখ্যা ২২টি। কিন্তু অতীতের সেই আকর্ষণ বা জৌলুস নেই। কেন এই বেহাল অবস্থা? সুব্রত ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘উত্তর চব্বিশ পরগনায় প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলারের অভাব নেই। কিন্তু তাদের অনুসন্ধানের কাজটাই হচ্ছে না।’’ হতাশ সুব্রতর তোপ, ‘‘মুরারি শূর, পান্নালাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জহুরিরা নেই। তা ছাড়া এখন রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ অনেক বেড়ে গিয়েছে।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘আগে বাংলা দলে সুযোগ পেলে চাকরি পাকা ছিল। কিন্তু এখন তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই ফুটবলের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ কমছে। শুধু তা-ই নয়। অধিকাংশ অভিভাবকই কোচিং সেন্টার ও অ্যাকাডেমিতে ছেলেদের ভর্তি করাচ্ছেন ফিট রাখার জন্য, ফুটবলার হওয়ার জন্য নন।’’

নিজের উদাহরণ দিয়ে সুব্রত বললেন, ‘‘আমরা খুব দরিদ্র ছিলাম। শৈশবে বাবা-মা বলতেন, ভাল খেললে চাকরি নিশ্চিত। আমার মামারাও চাকরি পেয়েছেন ফুটবল খেলে। অফিসগুলো ফুটবলার নেওয়া এখন প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে।’’ তিনি আরও বললেন, ‘‘মুরারি শূর আমাকে সতেরো বছর বয়সে বালি প্রতিভায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সই করি বিএনআর-এ। তার পরে মোহনবাগানে। এখন প্রচুর কোচিং সেন্টার ও অ্যাকাডেমি থাকলেও তাদের খুঁজে বার করার মতো কোচেরা আর নেই।’’ কলকাতায় থাকলেও প্রত্যেক সপ্তাহে শ্যামনগরে পৈতৃক বাড়িতে যান সুব্রত। বলছিলেন, ‘‘আমরা যখন জেলা লিগে খেলতাম, তখন মাঠ উপচে পড়ত। প্রবল উন্মাদনা ছিল। কিন্তু এখন দেখি মাঠ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। খেলার কেউ নেই। দেখে খুব কষ্ট হয়।’’ তিনি আরও বললেন, ‘‘১৯৭৯ সালে জেলা লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনে শ্যামনগরের সবুজ সঙ্ঘকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলাম। আমি তখন মোহনবাগানে খেলতাম। উন্মাদনা এতটাই ছিল যে, ব্যারাকপুরের মাঠে একটি ম্যাচে পুলিশ মোতায়েন করতে হয়েছিল। এখন তো কোনও মতে জেলা লিগ চলছে।’’

একই রকম হতাশ আর এক তারকা মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। খোলাখুলি বললেন, ‘‘এই প্রজন্মের ছেলেরা পরিশ্রম করতে চায় না। তাদের ফুটবলের প্রতি আগ্রহও নেই। ফলে জেলা লিগের আকর্ষণ অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে।’’

এক ক্লাবের কর্তার মতে, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অধিকাংশ ক্লাবের কর্তারাই এখন খেলাধুলোর চেয়ে বেশি তৎপর পুজোর আয়োজন করতে। তিনি বলছিলেন, ‘‘মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য যে বেলঘরিয়া থেকে উঠে এসেছেন, সেখানে ফুটবল প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়। প্রচুর ক্লাব প্রায় উঠেই গিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যারাকপুরের মোহনপুর, পলতার জলি, ইছাপুরের গোপীনাথ ইউনিয়ন ও অনুশীলনী। বেশির ভাগ ক্লাবের কর্তারাই ব্যস্ত পুজো নিয়ে।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হওয়ায় অফিস লিগও উঠে গিয়েছে।’’

উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা লিগের জৌলুস হারানোর আরও একটা কারণ, অবনমন উঠে যাওয়া। লিগ শুরু হওয়ার আগে বেশ কিছু ক্লাবের কর্তারা জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনের তুলনায় ফুটবলার কম। তাই দু’বছরে জন্য অবনমন তুলে দেওয়া হোক। এই দু’বছরে নতুন ফুটবলার তুলে আনা হবে। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। উল্টে আকর্ষণ হারিয়েছে লিগ। অবনমন না থাকলেও উত্তরণ রয়েছে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা লিগে। যেমন, দ্বিতীয় ডিভিশনের দু’টি দল আগামী বছর প্রথম ডিভিশনে খেলবে। একই ভাবে প্রথম ডিভিশনের দু’টি ক্লাব যোগ্যতা অর্জন করেছে সুপার ডিভিশনে। ক্ষুব্ধ এক ক্লাবকর্তা বললেন, ‘‘অবনমন না-থাকায় গড়াপেটা বন্ধ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু লিগের আকর্ষণ শেষ হয়ে গিয়েছে।’’ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সচিব রতন সমাজদারকে ফোনে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন অবনমন তুলে দেওয়া হল? তাঁর জবাব, ‘‘ফোনে কিছু বলব না!’’

অন্য বিষয়গুলি:

Football District League North 24 Paraganas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE