সাংবাদিক সম্মেলনের ফাঁকে বাগানের পিয়ের বোয়ার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন বেঙ্গালুরুর জন জনসন। নিয়মমাফিক শুভেচ্ছার হাত। তা সবুজ-মেরুনের ক্যামেরুন স্ট্রাইকার মুখটা এমন করলেন, যেন টিভি ক্যামেরাগুলো না থাকলে এখনই বিপক্ষের অন্যতম সেরা অস্ত্রকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিতেন!
মোহনবাগান আর বেঙ্গালুরু এফসি কোচ ফটোসেশনে এসে হাতে হাত রাখলেন বটে। কিন্তু হাসি-হাসি মুখটা রইল যেন শুধু ক্যামেরার জন্যই। পরে দু’জনে দু’জনের দিকে তাকালেন যথেষ্ট তেতো মুখ করে।
তীব্র চাপ, টেনশন না অন্য কিছু? কীসের জন্য আই লিগের খেতাবি ম্যাচের আগের দিন দু’পক্ষের এই যুদ্ধং দেহি মনোভাব?
সেটা বোঝা গেল ওঁরা প্রশ্নোত্তর পর্বে ঢুকতেই।
‘‘বাইরের মাঠে বাগান মোটে কুড়ি শতাংশ ম্যাচ জিতেছে। আমাদের সঙ্গে কী জিতবে? আমার ক্যাবিনেটে এক বছরেই দু’টো ট্রফি— আই লিগ, ফেড কাপ। ওদের সেখানে কিছুই নেই। চাপটা তো বাগানেরই’’— মার্কামারা ব্রিটিশ ঔদ্ধত্যে বলে দিলেন বেঙ্গালুরু কোচ অ্যাসলে ওয়েস্টউড।
তাঁর পাল্টাও মজুত। ব্যবধান বড়জোর মিনিট পাঁচেকের।
‘‘এটা অন্য ম্যাচ। নতুন খেলা। ওদের কলকাতায় চার গোল দিয়েছি। তবু বাকি আঠারোটা ম্যাচের মতো ওটাও মনে রাখছি না। কাল জিততে চাই। তবে এক পয়েন্ট পেলেও কিন্তু আমরা চ্যাম্পিয়ন। সেখানে ওদের জিততেই হবে। চাপটা তা হলে কাদের বেশি?’’ বলার সময় যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী দেখায় সবুজ-মেরুন কোচ সঞ্জয় সেনকে।
আই লিগ ‘ফাইনালে’র চব্বিশ ঘণ্টা আগে মাঠের বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়ানোর লড়াই এর পর আরও এগোয়—
ওয়েস্টউড: আমাদের বেঙ্গালুরুর রেকর্ডটা দেখেছেন? এক দিকে এএফসি কাপের মূলপর্বে উঠেছি, অন্য দিকে আই লিগের প্রথম দুইয়ে— আজ পর্যন্ত কোন ক্লাব এটা পেরেছে বলুন তো? আমরা টানা বারো ম্যাচ অপরাজিত। কাল দেখবেন মাঠে নেমে বাগানই কেমন নার্ভাস থাকবে!
সঞ্জয়: আমরাও দশটা ম্যাচ টানা জিতেছি। এক বার ছাড়া এই মরসুমে টানা লিগের এক নম্বরে। ইতিহাস-ভূগোল ভেবে লাভ নেই। আমরা জিততে এসেছি। এটা মেন্টাল গেম। সব শক্তি নিয়ে তৈরি।
পিকে বনাম অমল দত্ত মার্কা কটাক্ষ-পাল্টা কটাক্ষ, শ্লেষ মেশানো বিবৃতির সেই ঝাঁঝালো লড়াই তা হলে ফিরে এল! এ সব তো কলকাতা ডার্বিতে হয়ে এসেছে এত দিন। পরিবেশটাও যেন সে রকমই পড়শি-লড়াইয়ের! যতই টিম দু’টো হোক না কেন মোহনবাগান আর বেঙ্গালুরু!
শনিবার সন্ধের পর থেকে সেই যুদ্ধ তো আরও বেশি মাত্রা পেয়ে গিয়েছে আই লিগে ইস্টবেঙ্গলের লজ্জার ১-৫ হারে। এই টুর্নামেন্টে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর বৃহত্তম হারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই বাগানের সামনে তেরো বছর পর ফের আলোয় ফেরার সুযোগ। আই লিগ জিতেই। বাংলার ফুটবলে কলঙ্কের দাগ লাগার পরের দিন শিল্টন পালের হাতেই এখন কলঙ্কমুক্তির চাবিকাঠি!
কান্তিরাভা স্টেডিয়ামের রং দেখে মনে হবে কলকাতায় আছি! সর্বত্র মমতাময় রং— নীল আর সাদা। আসলে সুনীল ছেত্রী-রবিন সিংহদের জার্সির রং ওটা। শনিবার সাতসকালের তীব্র রোদেও গমগম করছিল সনি-বোয়াদের অনুশীলন। যেমনটা হয় ডার্বির আগে বাগান তাঁবুতে। চিংড়ি, পালতোলা নৌকো, সবুজ-মেরুন ব্যানার সবই হাজির। সেগুলো যাঁরা রাত জেগে তৈরি করে এনেছেন, তাঁদের সবাই কিন্তু বেঙ্গালুরুর নন। বঙ্গসন্তানরা কেউ এসেছেন পুণে থেকে। কেউ মুম্বই। কলকাতা-আগত সমর্থকরা তো আছেনই। এমনকী কাল সকালেও দমদম থেকে উড়ান ধরছেন কেউ কেউ।
বেঙ্গালুরুর বঙ্গজরাও অবশ্য ভীষণ ভাবে আছেন কালকের দ্বৈরথে। এঁদের কেউ বড় কোম্পানির অফিসার, কেউ দু’লাখি মাইনের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সাবেক শিবপুর বিই কলেজের (বর্তমান আইআইইএসটি) প্রাক্তনীদের একটা ঝাঁক গোটাদশেক টিকিট কেটে তৈরি। ঝকঝকে মুখ, তারুণ্যের উজ্জ্বল চোখ। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের সুবাদে ভারতীয় ফুটবলের এক নতুন দিগন্ত খুলে গিয়েছে মনে হচ্ছিল। এঁরা সবাই দেশের কোনও না কোনও শহরের মেরিনার্স ক্লাবের সদস্য। প্রবাসে থেকেও তাঁদের বেশির ভাগেরই রিংটোন, ‘সবুজ-মেরুন সবুজ-মেরুন, পাল তোলা নৌকো ছুটছে দারুণ...।’ দুর্গাপুজোয় ঠাকুর এলে পাড়ায় যেমন হয়, সে ভাবেই মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিলেন ওঁরা। মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছিল, ‘জিতবে কে?... মোহনবাগান! গোল করবে কে?... সনি ছাড়া আবার কে!’
নিজের নাম শুনে সেট পিস অনুশীলনে বল মারা থামিয়ে হঠাৎই সে দিকে তাকিয়েছিলেন বাগানের হাইতি স্ট্রাইকার। ধমক খেলেন কোচের কাছে। সঞ্জয় জানেন, সনিদের এখন এ সব শোনা মানেই টিমের আত্মতুষ্ট হয়ে পদস্খলনের দিকে পা বাড়ানো। মনঃসংযোগ নষ্ট হওয়া। বাগানের বঙ্গসন্তান কোচ তাই বাড়তি সতর্ক, সংযমী, আত্মমগ্ন। বাগান হোটেলে ‘নো এন্ট্রি’। খাওয়া-দাওয়া থেকে অনুশীলন— সবেতেই কড়া নজর রাখছেন কোচ। সঞ্জয়ের সুবিধে, সঙ্গে রয়েছেন খোদ ফুটবল সচিব সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ফুটবলার জীবনে বাগানের হয়ে দু’টো জাতীয় লিগ জিতেছেন সত্য। ফুটবল সচিবের সেই অভিজ্ঞতা তো কাজে লাগাবেনই বুদ্ধিমান সঞ্জয়।
চরম পেশাদার বেঙ্গালুরু এফসি-র লোকজন আবার খুব সূক্ষ্ম ভাবে এই ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছেন যে, তাঁদের কোচ কোনও নির্দিষ্ট ফর্মেশনের ধার ধারেন না। বাগানকে চাপে রাখার জন্য ওয়েস্টউডের মুখ থেকে গড়গ়ড় করে বেরিয়েছে সঞ্জয়ের প্রথম একাদশের নাম। এমনকী তাতে বাগানের লেফট ব্যাক হিসেবে ধনচন্দ্রর নামও। এবং সত্যিই কাল সবুজ-মেরুনে একটাই পরিবর্তন। এ দিন অনুশীলনে সেটা দেখিয়েও দিয়েছেন সঞ্জয়। কিন্তু অবাক কাণ্ড— তিন ঘণ্টার মধ্যেই সেটা জেনে গেলেন বেঙ্গালুরু কোচ!
বাগান কোচ আবার অন্য ধারার স্ট্র্যাটেজিতে বিশ্বাসী। বেঙ্গালুরুর এ মরসুমের নানা ম্যাচের সিডি থেকে কিছু বাছাই অংশ টিম মিটিংয়ে ছেলেদের দেখিয়েছেন শনিবার রাতে। বিপক্ষের লিংডোর ভয়ঙ্কর সেট পিস আটকানোর উপায় খুঁজেছেন। টিমকে আরও একাত্ম করার লক্ষ্যেই সকালে মাঠে ফুটবলারদের পাঠিয়েছেন নিজেদের মধ্যে আলাদা করে মিটিং করতে। বোয়া সেখানে বলেছেন, ‘‘এটা মরসুমের শেষ ম্যাচ। এমন কিছু করতে হবে যাতে আমরা সবাই হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে পারি।’’ আর বাগান কোচ বলেছেন, ‘‘এত দূর এসেছি। তোমরাই টিমকে এখানে এনেছ। সব পরিশ্রম বৃথা যাবে যদি এই ম্যাচটা না জিততে পারো।’’
কান্তিরাভা স্টেডিয়াম সঞ্জয়ের কাছে পয়মন্ত হলেও বাগানের কাছে ‘অভিশাপ’।
মহমেডানকে এই মাঠে আই লিগ টু-তে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন সঞ্জয়। আবার এগারো বছর আগে ফেড কাপ ফাইনালে ক্রিশ্চিয়ানো জুনিয়রের মৃত্যুর ঘটনা এখনও এখানে মুখে মুখে ফেরে। যে ফাইনালে ডেম্পোর কাছে হেরেছিল বাগান।
এখন দেখার, নতুন চেহারার কান্তিরাভায় রবিবাসরীয় রাত বাগানকে অভিশাপ-মুক্ত করতে পারে কি না। সঞ্জয়ের ‘ভাগ্য’ মধুর প্রলেপ দিতে পারে কি না তেরো বছর আই লিগ অধরা থাকার যন্ত্রণায়।
আসমুদ্র হিমাচলের ‘মেরিনার্স’ যে আজ চাইছে বাজুক এই গান— ‘তোমার মুক্তি আলোয় আলোয়!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy