Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

বর্ষসেরা মঞ্চে বিশ্বাসের অরুণ-মন্ত্র

শুষ্কং-কাষ্ঠং পুরস্কারে মিটিয়ে ফেলা নয়। প্রত্যেক স্মারকের সঙ্গে প্রাপ্তি অর্থও। বরাবরের মতো সিএবি কর্তা দিয়ে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা বাদ। বদলে মঞ্চে সোজা পেশাদার সঞ্চালক।

সিএবি-র জীবনকৃতি সম্মান গোপাল বসুকে। ব্লেজার পরিয়ে দিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

সিএবি-র জীবনকৃতি সম্মান গোপাল বসুকে। ব্লেজার পরিয়ে দিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৬ ০৩:০৬
Share: Save:

শুষ্কং-কাষ্ঠং পুরস্কারে মিটিয়ে ফেলা নয়। প্রত্যেক স্মারকের সঙ্গে প্রাপ্তি অর্থও।

বরাবরের মতো সিএবি কর্তা দিয়ে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা বাদ। বদলে মঞ্চে সোজা পেশাদার সঞ্চালক।

অনুষ্ঠান মঞ্চে পুরস্কার দিতে-দিতে প্রধান অতিথির গলদঘর্ম হওয়ার পরিচিত দৃশ্য অতীত। প্রধান অতিথি এ বারও থাকলেন, পুরস্কার দিলেন, কিন্তু সব নয়। বেছে-বেছে, প্রধানগুলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতেও তাঁকে হল না।

বার্ষিক অনুষ্ঠানে বর্ষসেরা ক্রিকেটারকে সম্মানিত হতে এত দিন দেখেছে সিএবি। দেখেছে, অতীতের কোনও ক্রিকেট-মহীরূহের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে আজীবন সম্মান। কিন্তু ক্রিকেটের ‘থ্যাঙ্কলেস জব’-এ আম্পায়ারদের মতোই গোটা বছর বিনিয়োগ করেন যাঁরা? স্কোরারদের বর্ষসেরা— আজ পর্যন্ত সিএবি-তে কেউ শুনেছে না দেখেছে?

প্রেসিডেন্টের চেয়ারে উপবিষ্ট হওয়ার পর গত কয়েক মাসে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় প্রচুর মনে রাখার মতো কাজ করেছেন। ইডেন সংস্কার থেকে বঙ্গ ক্রিকেট-কাঠামো আধুনিকীকরণ, বিশ্বকাপ-যজ্ঞকে ঘিরে জাঁকজমক— স্মৃতি ঝটিতি এ সব বলে দেবে। শনিবারের সিএবি বার্ষিক অনুষ্ঠান এ বছরের মতো প্রেসিডেন্ট গাঙ্গুলির শেষ পরীক্ষা ছিল। যার মার্কশিটে না ঢুকেও এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, অন্যান্য বারের তুলনায় এ বার ভাল হয়েছে।

আড্ডা চলছে অরুণ লাল ও দেবাঙ্গ গাঁধীর সঙ্গে। শনিবার ইডেনে। ছবি: উৎপল সরকার

উত্তরসূরি সৌরভের অনুষ্ঠান মঞ্চে পূর্বসূরি গোপাল বসুকে আজীবনের সম্মানে সম্মানিত করা। ক্যানসার-জয়ী অরুণ লালের মাইক হাতে জীবন-মন্ত্র দিয়ে যাওয়া। সিএবি যুগ্ম সচিব অভিষেক ডালমিয়ার অসাধারণ সমাপ্তি-বক্তৃতা। যেখানে ডালমিয়া-পুত্র অরুণ লালকে প্রশাসনিক দুনিয়াতেও ‘‘অনুপ্রেরণা’’ বলে দেওয়ায় কেউ কেউ বললেন, বৃত্তটা আজ সম্পূর্ণ হল। প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার সঙ্গে অরুণের যে অম্লমধুর সম্পর্ক ছিল, তা আজ কেটে গেল। ডালমিয়ার ছেলেই মেঘটা সরিয়ে দিলেন। শনিবারের সিএবি অনুষ্ঠানে মনে রাখার মতো এমন অনেক কিছু ছিল, এমন অনেক কিছু হয়েছে।

গোপাল বসু যেমন। বরাবর তাঁকে ঠোঁটকাটা, স্পষ্টবক্তা জেনে এসেছে বঙ্গ ক্রিকেট। সিএবি— তার সঙ্গেও খটাখটি লেগেছে অতীতে। কিন্তু সেই একই মেজাজি অধিনায়ক সিএবি-র অনুষ্ঠানে আশ্চর্য রকম আবেগাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন, জনসমক্ষে বার করে আনলেন কঠিন বর্মের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নরম মনটা। বারবার বললেন, ‘‘আমার কাছে এটা বিরাট সম্মান।’’ বললেন, তাঁর ক্রিকেট-জীবনের চার চরিত্রের কথা। নতু কোলে, দীপক কুমার ঘোষ, টুন্টু মিত্র, প্রদ্যুৎ মিত্র— এই চার না থাকলে নাকি তাঁর গোপাল বসু হওয়াই হত না! এঁদের মধ্যে প্রদ্যুৎ মিত্র তো তাঁর এক কথায় ‘গ্যারি কার্স্টেনই’ ছিলেন। গরমে ব্যাট করে আসার পরেও থ্রো ডাউন দেওয়ার ডাক দিতেন গোপালকে, হাঁক দিতেন, ‘‘আয়, বল মারবি!’’

কর্কটরোগ-জয়ী ‘লালজি’-ও কম গেলেন না। গোপাল স্মৃতিমেদুরতায় ডুবে গেলে বাংলার এই প্রাক্তন অধিনায়ক অনুষ্ঠান-মঞ্চেও দুঁদে ক্যাপ্টেন্সি করে গেলেন। ১৯২০ অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জয়ী চার্লস প্যাডককে টেনে এনে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে বিশ্বাসের জপমন্ত্র তুলে দিয়ে। ‘‘প্যাডক ছিলেন আমারই মতো, বেঁটেখাটো। উনি বলতেন, একশো মিটারে আমি চ্যাম্পিয়ন হব। আর লোকে বলত, এই উচ্চতা নিয়ে হবে কী করে? পাঁচ হাজার মিটারে নামো,’’ কথাগুলো বলার সময় অরুণ যেন নিজেকেই দেখতে পান ট্র্যাকে। বলতে থাকেন, ‘‘উনি শোনেননি। বাড়ি ছেড়ে, কোচ বদলে ওই একশো মিটারেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। জিতে বলেছিলেন, তুমি যদি ভাবো পারবে, তা হলে অবশ্যই পারবে!’’ হুঙ্কার দেন বাংলার নতুন প্রজন্মের প্রতি, ‘‘একটা অরুণ লাল যদি ভারতের হয়ে খেলতে পারে, তা হলে যে কেউ পারবে। শুধু বিশ্বাসটা রাখতে হবে যে, আমিই সেরা!’’

সুদীপ চট্টোপাধ্যায়দের কপাল খারাপ, কর্নাটকে টুর্নামেন্ট চলায় অরুণের কথা তাঁরা শুনতে পেলেন না। কিন্তু পরে শুনলে, উদ্বুব্ধ হবেন নিশ্চয়ই। সুদীপ চার-চারটে পুরস্কার পেলেন এ বার, বর্ষসেরাও তিনি। বিশেষ সম্মান একটা চালু হল এ বার থেকে। যা পেলেন অতীতের দিকপাল আন্তর্জাতিক আম্পায়ার সুনীত কুমার ঘোষ। এবং আপাতদৃষ্টিতে সব দেখলে মনে হবে, এটাই সিএবি অনুষ্ঠানের পূর্ণতার ছবি। এত দিন যা যা ছিল না। এ বার তা থাকল।

মুশকিল হল, তা বলতেও কোনও অসুবিধে ছিল না। যদি না কয়েকটা প্রশ্ন, কিছু চোরা আক্ষেপ অনুষ্ঠান ঘিরে সৃষ্টি না হত।

প্রয়াত ইডেন কিউরেটর প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের পুত্র প্রণব একজন। উত্তেজিত ভাবে যিনি ফোনে বললেন, ‘‘আশ্চর্য যে একমাত্র অভিষেক (ডালমিয়া) ছাড়া বাবার নামোচ্চারণ অনুষ্ঠানে কেউ করল না! আমাদের কেউ ডাকল না পর্যন্ত!’’ প্রয়াত বাংলা পেসার সমর চক্রবর্তীর স্ত্রীর আক্ষেপ, মার্কেটিং সম্ভব নয় বলে বাংলার সেরা একাদশে সমর নেই! অনুষ্ঠানে আরও দু’টো ব্যাপার বিসদৃশ লেগেছে। এক, কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে প্রতি বার অনুষ্ঠানে উদ্যমী ভূমিকা নেন। এ বার তিনি আশ্চর্য রকম নিষ্ক্রিয়। বসে থাকলেন শেষ প্রান্তে। আর দুই, অনুষ্ঠানের গতানুগতিকতা। সৌরভের প্রশাসনিক আবির্ভাবেও যা পাল্টায়নি। সিএবি-র জুনিয়র-সিনিয়র কর্তাদের যুগপৎ ভাবা উচিত, বার্ষিক অনুষ্ঠানে কী করে আরও বৈচিত্র আনা যায়।

তবে বাংলার ক্রিকেট পীঠস্থানের ‘বিজয়া দশমী’-তে এ সব দুঃখ, অভিমান বোধহয় ভুলে যাওয়াই ভাল। তার জন্য বছরের বাকি তিনশো চৌষট্টি দিন তো আছে। আজকের দিনের মতো প্রাসঙ্গিক বরং পুরস্কার-প্রাপ্তির বর্ণোজ্জ্বল মুখগুলো।

মহম্মদ ইরফান আনসারি— অনূর্ধ্ব উনিশ বর্ষসেরা। ডোনিল দত্ত—অনূর্ধ্ব সতেরো বর্ষসেরা। দেবজ্যোতি ঘোষ— অনূর্ধ্ব ষোলো বর্ষসেরা। অর্ক চক্রবর্তী— অনূর্ধ্ব ১৫ স্কুল ক্রিকেটের সেরা। শ্রেয়ান দত্ত—অনূর্ধ্ব ১৪-র সেরা। শুভ্রজিৎ দাস— বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ক্রিকেটার। অশোক দিন্দা— বর্ষসেরা ফাস্ট বোলার। ঝুলন গোস্বামী— বর্ষসেরা মহিলা ক্রিকেটার।

কেউ কিশোর, কেউ যুবা। কেউ প্রতিষ্ঠিত, কেউ প্রতিশ্রুতিমান। প্রশাসনিক ভাল-খারাপ বাদ দিয়ে একটা বার্ষিক অনুষ্ঠান এঁদের জন্যই মনে রাখা যাক না!

অন্য বিষয়গুলি:

CAB Lifetime Achievement Award Gopal Bose
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE