Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

ঘর থেকে ব্যাটই বার করে দিলেন অঙ্কিতের মা

দোতলা বাড়িটা রং করানো বাকি। পুরোটা তৈরিও হয়নি এখনও। সামনেই একফালি বারান্দা। সেখান দিয়ে ঢুকলে আট বাই আটের একটা ঘর। হালফিলের কোনও জন্মদিনের পার্টির সাজসজ্জা এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঘরের দেওয়ালে। এই ঘরে মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন অঙ্কিত কেশরী। এই ঘরেরই একটা কোণা থেকে এক-এক করে অঙ্কিতের ব্যাটগুলো তুলে নিচ্ছেন তাঁর মা।

বাড়িতে অঙ্কিতের মা। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

বাড়িতে অঙ্কিতের মা। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২০
Share: Save:

দোতলা বাড়িটা রং করানো বাকি। পুরোটা তৈরিও হয়নি এখনও। সামনেই একফালি বারান্দা। সেখান দিয়ে ঢুকলে আট বাই আটের একটা ঘর। হালফিলের কোনও জন্মদিনের পার্টির সাজসজ্জা এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঘরের দেওয়ালে।

এই ঘরে মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন অঙ্কিত কেশরী।

এই ঘরেরই একটা কোণা থেকে এক-এক করে অঙ্কিতের ব্যাটগুলো তুলে নিচ্ছেন তাঁর মা।

তুলে প্রায় ছুড়ে ফেলছেন সামনের বারান্দায়! সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছোট ছেলের ঘাতকের চিহ্নমাত্র আর সহ্য করতে পারছেন না নির্মলা দেবী।

আত্মীয়ারা তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করবেন কী, তাঁরাও শোকে ডুবে। সোমবার সকাল থেকে ওই বাড়িটার চার দেওয়ালের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে দুটো পদাংশ— বাবু, বাবু!

এক বৃদ্ধা দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে চলেছেন, এই ঘরটায় তিন জন থাকতে অসুবিধে হচ্ছিল ওদের। ভেবেছিল অঙ্কিতকে ওর নিজস্ব একটা ঘর দেবে। ভেবেছিল, বছরকয়েক পরেই বাড়িতে নতুন বউ আসবে। আগে থেকে তোড়জো়ড় শুরু করে দেওয়া ভাল। একটু দূরে কেশরী পরিবারের বড় পুত্রবধূ ঠায় দাঁড়িয়ে একটা ক্যাবিনেটের সামনে। যার কাচের পিছনে পরপর সযত্নে সাজানো অঙ্কিতের জেতা ট্রফিগুলো। ঘরের এ দিক-ও দিক যতই অবিন্যস্ত হোক, ট্রফিগুলো দেখেই বোঝা যায় ওগুলো নিয়ম করে ঘষামাজা হয়।

কয়েক মিনিট আগে বাঁশদ্রোণীর সরু, প্রায়ান্ধকার গলির এই বাড়িটা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন বছর কুড়ির অঙ্কিত। শেষ বারের মতো। আর পাঁচটা দিনের মতো দুমদাম পা ফেলে দৌড়ে নয়। বন্ধুদের কাঁধে! শ’দুয়েক লোকের ভিড় ঠেলে, কান্নার করুণ গান স্যালুটের মধ্যে। তাঁর জন্য তখন সার দিয়ে মোমবাতি জ্বলছে বাড়ি থেকে কয়েক পা দূরে, পাড়ার ক্লাবে। রাস্তা ব্যারিকেড করে দাঁড়িয়ে পুলিশ আর শোক-ক্লান্ত, শুকনো মুখে সিএবি কর্তারা। তাঁর শেষযাত্রায় সামিল পাড়া-পড়শির কারও কারও স্বগতোক্তি, সবে ভাল খেলতে শুরু করেছিল ছেলেটা!

অঙ্কিতের ‘অপরাধী’ কি ডাক্তারি উপেক্ষা না প্রশাসকদের গাফিলতি— এ সব প্রশ্ন অনেকক্ষণ অর্থহীন হয়ে গিয়েছে রাজকুমার কেশরীর পৃথিবীতে। পুত্রশোকের আগুনে দগ্ধ পিতা আশ্রয় নিয়েছেন দর্শনে। বলছেন, কাউকে দোষ দেব কী করে? যার যাওয়ার ছিল, সে তো যাবেই। কে পারবে তাকে আটকাতে?

অঙ্কিতের দাদা দীপক স্বাভাবিক কম কথার মানুষ, না শোকের ধাক্কায় জিভ অসাড় হয়ে গিয়েছে, বোঝা কঠিন। ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে যখন ছোট ভাইকে দেখতে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর সামনে নিয়ে আসা হল অঙ্কিতের দাদাকে। কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন, কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলেন না। তবে সব ইন্দ্রিয় যে অসাড় হয়ে যায়নি তার প্রমাণ তখন পাওয়া গেল। দীপকের গাল বেয়ে ঝরেই চলেছে চোখের জল।

কেশরী পরিবারের দুই পুরুষের নীরব, নিয়ন্ত্রিত শোকের একেবারে বিপরীত ছবি পাওয়া গেল অঙ্কিতের খুব কাছের আর একজনের মধ্যে। কেওড়াতলা মহাশ্মশানে শেষযাত্রার অপেক্ষায় যখন শুয়ে আছেন নিথর অঙ্কিত, তখন থেকে যিনি তাঁর কাছ ছাড়েননি। বৈদ্যুতিক চুল্লির দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কান্নার তোড়ে যিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। বসে পড়েছেন হঠাৎ আহতের মতো। ইনি অরিজিৎ মজুমদার। অঙ্কিত যে অ্যাকাডেমিতে নিয়মিত ক্রিকেট-পাঠ নিতেন, সেই বুলান ক্রিকেট অ্যাকাডেমির কোচ। যাঁকে ওই অবস্থায় দেখে নিজেদের শোকের মধ্যেই তাঁকে একটু সুস্থ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে তাঁর অ্যাকাডেমির খুদে একদল ছাত্র।

‘‘কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ হঠাৎ অ্যাকাডেমিতে চলে আসত অঙ্কিত। আর এসেই আব্দার, তোমার বাইকটা একটু দাও না! ঘুরতে বেরবো,’’ একটু পরে প্রায় নিজের মনে বলছিলেন অরিজিৎ। ‘ছটফটে’ বলতে যাঁর মুখটা তাঁর মনে ভেসে উঠত, সেই মুখের মালিক এত কম বয়সে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন। অরিজিতকে দেখে তখন মনে হচ্ছে, এ-ও তো এক ধরনের পুত্রশোক। রক্তের টান নেই, কিন্তু ক্রিকেট গভীর আত্মীয়তায় মিলিয়ে দিয়েছিল গুরু-শিষ্যকে।

যে শিষ্যের পরিবার বিহারে নিজেদের ভিটে ছেড়ে অনেক দিন হল কলকাতায় চলে এসেছে। আয় মূলত নিজেদের চায়ের দোকান থেকে। ইদানীং যে দোকানের দেখভাল করতেন অঙ্কিতের দাদা। খুব সাধারণ, নিম্ন মধ্যবিত্ত একটা পরিবার। যাঁরা স্বপ্ন দেখতেন, ছোট ছেলের জন্য এক দিন ঠিক তাঁদের সামনে বুম ধরবে টিভি চ্যানেল। খবরের কাগজ খুললে ঠিক দেখবেন ছোট ছেলের ছবি। সাধারণ থেকে তাঁদের অ-সাধারণ করে তুলবেন অঙ্কিত।

স্বপ্নটা বড্ড তাড়াতাড়ি সত্যি হয়ে গেল!

বড্ড নির্মম ভাবে সত্যি হয়ে গেল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE