ঐতিহাসিক: হিরো কাপের সেই মুহূর্ত। চ্যাম্পিয়ন ভারতের ভিকট্রি ল্যাপ ইডেনে। মাঠে সচিনরা জিতলেন, মাঠের বাইরে জয় ডালমিয়াদের। ফাইল চিত্র।
সালটা ১৯৯০।
বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ফিরছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। নির্বাসন মুক্তির পরে ওরা প্রথম ম্যাচ তারা খেলবে ইডেনে।
ভারতীয় ক্রিকেটে সেই প্রথম লাইভ টেলিকাস্ট চালু হল। এর আগেও দূরদর্শনে ম্যাচ দেখা গিয়েছে। কিন্তু সেগুলি সবই ছিল ‘ডিলেড টেলিকাস্ট’। মানে দশ বা পনেরো মিনিট পরে সম্প্রচারিত হতো। আমি যত দূর জানি, ভারতীয় ক্রিকেটে সরাসরি সম্প্রচারিত প্রথম ম্যাচ ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ইডেনের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ।
সেই সময় দূরদর্শন ম্যাচ সম্প্রচারের জন্য যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে হয়তো কেউ ভাবতেই পারবে না। ওরা বলেছিল, ম্যাচ দেখানোর জন্য ওদেরকে প্রত্যেক দিন ৫ লক্ষ টাকা করে দিতে হবে। ভুল লেখা হয়নি। হ্যাঁ, ওদেরকেই আমরা টাকা দেব। সঙ্গে ম্যাচ চলাকালীন সম্প্রচারের কাজে নিযুক্ত ১২০ জন লোকের সমস্ত খরচও বইতে হবে।
১৯৯৩-তে সিএবি-র ডায়মন্ড জুবিলি সেলিব্রেশন হওয়ার কথা। ঠিক হল, হিরো কাপ আয়োজন করা হবে। সমস্ত টেস্ট খেলিয়ে দেশ আসবে এই ওয়ান ডে টুর্নামেন্ট খেলতে। ঠিক সেই সময়েই আবির্ভাব মার্ক মাসকারেনহাস নামের এক ব্যক্তির। তখন কে আর ভাবতে পেরেছিল, ভারতীয় ক্রিকেট সম্প্রচারের ইতিহাসকেই পাল্টে দিতে এসেছেন এই মাসকারেনহাস!
আরও পড়ুন: ‘হাজার গোল করলে আমার সমান হবে’
জগমোহন ডালমিয়ার সঙ্গে দেখা করে অলৌকিক এক প্রস্তাব দিল মার্ক। ‘অলৌকিক’ বলছি কারণ, সেই সময়ে এমন প্রস্তাব কেউ ভাবতেই পারত না। মার্ক বলল, তোমাদের এই টুর্নামেন্ট আমার সংস্থা টিভি-তে দেখাতে চায়। তার জন্য আমি তোমাদের টাকা দেব। তোমরা আমাকে খেলা দেখানোর অধিকার দেবে? শুনে ভারতীয় ক্রিকেটের তখনকার পরিচালকেরা তো স্তম্ভিত! বলে কী এ লোক? খেলা দেখানোর জন্য আমরাই তো টাকা দিয়ে আসছি। এ কি না উল্টে আমাদের টাকা দেবে!
গেমচেঞ্জার: ক্রিকেট বাণিজ্যকে বদলে দেন ডালমিয়া। ফাইল চিত্র
প্রয়াত মার্ক পরে সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে ঐতিহাসিক চুক্তি করেন। মার্কের প্রস্তাব সকলের চোখ খুলে দিল। জগমোহন ডালমিয়া বলল, গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হোক। ১৯৯৩-এর হিরো কাপের জন্য ডাকা টেন্ডার খুলে দেখা গেল, সব চেয়ে বেশি অর্থের ‘বিড’ করেছে ট্রান্স ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশানল। ওদের প্রস্তাব ছিল ৫.৫ লক্ষ মার্কিন ডলারের। ভারতীয় মুদ্রায় যা হল ৩ কোটি ৫২ লক্ষ ৬৯ হাজার টাকা। ওরা বলল, ম্যাচ সম্প্রচার করবে মার্ক মাসকারেনহাসের ওয়ার্ল্ড টেলের মাধ্যমে। সেটাই শেষ নয়। অভিনব এই প্রস্তাবে টিডব্লিউআই আরও বলেছিল, এই ৫.৫ লক্ষ মার্কিন ডলার হচ্ছে ন্যূনতম গ্যারান্টি অর্থ। লভ্যাংশ থেকে ৭০ শতাংশও বোর্ডকে দেবে।
দূরদর্শনকেও টেন্ডারের সময় প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছিল। ওরা গোটা হিরো কাপের জন্য এক কোটি টাকা দিতে রাজি হয়েছিল। টিডব্লিউআই-এর প্রস্তাব ছিল ওদের তিনগুণেরও বেশি। কিন্তু টিডব্লিউআই-এর সঙ্গে ঐতিহাসিক চুক্তি সাক্ষর হয়ে যাওয়ার পরে গোলমাল বাধল। দূরদর্শন বিদ্রোহ করে বলল, বিদেশি সংস্থাকে ওদের কাছ থেকে টাকা দিয়ে সিগন্যাল নিতে হবে। বিশাল একটা টাকার অঙ্ক দাবি করে বসল ওরা। ডালমিয়া তাতে ভেঙে পড়ার পাত্র নন। সিএবি কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করল। রায় সিএবি-র পক্ষেই গেল। দূরদর্শন ফের অ্যাপিল কোর্টে আবেদন করল। এ বার বিচারপতিরা বললেন, বোর্ড তাদের মতো করে সম্প্রচারের দায়িত্ব কাউকে দিতেই পারে। এটা তাদের ব্যাপার। তবে দূরদর্শনও ম্যাচ দেখাক।
হিরো কাপের প্রথম ম্যাচ ছিল মুম্বইয়ে। দু’টো বিশেষ বিমানে ম্যাচ সম্প্রচারের সব জিনিসপত্তর নিয়ে মুম্বইয়ে নামল টিডব্লিউআই এবং ওয়ার্ল্ড টেল সংস্থা। একেবারে সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নোঙর ফেলার মতো ব্যাপার। কিন্তু ক্রিকেটের টিভি-বাণিজ্যের সাড়ম্বর শুরু তার পরেও বিলম্বিত হয়ে পড়ার উপক্রম হল। বিদেশি টিভি সংস্থাকে আটকানোর জন্য তাদের বিমান দু’টিকে বাজেয়াপ্ত করা হল। ভারত সরকারের মদত ছাড়া এটা হওয়া সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে যখন দূরদর্শনের স্বার্থ এর মধ্যে জড়িত।
ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মুখে পড়লাম আমরা। তখন বিদেশি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ হওয়া মানে সিএবি সর্বস্বান্ত হবে। আমি তখনও সিএবি-র আইনি উপদেষ্টা। ডালমিয়াকে বললাম, সুপ্রিম কোর্টে দৌড়নো ছাড়া উপায় নেই আমাদের। তার পরের দিনই আবার ছুটি শুরু হয়ে যাবে আদালতে। তাই রাতারাতি আবেদন লিখে জমা দেওয়া হল সুপ্রিম কোর্টে। মহামান্য বিচারপতি আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে বললেন, সে দিনই শুনানি হবে এবং রাতেই রায় দিয়ে দেওয়া হবে।
বিচারপতি জে এস বর্মার বাড়িতে রাত সাড়ে এগারোটায় আদালত বসল। অন্য বিচারপতি ছিলেন পি বি সবন্ত। পরের দিন দীপাবলি। ছুটিতে যাওয়ার আগে মামলার নিষ্পত্তি না হলে হিরো কাপই ভণ্ডুল হয়ে যাবে। রাত একটায় বিচারপতিরা রায় শোনালেন। মহামান্য কলকাতা হাই কোর্ট প্রথমে যে রায় দিয়েছিলেন, সেটাকেই তাঁরা দু’জনে অবিকৃত রেখে বলে দিলেন, সিএবি বাইরের কাউকে দিয়ে ম্যাচ সম্প্রচার করতেই পারে। শুধু তা-ই নয়, ওঁরা আরও বলে দিলেন, ভোর ৬টার মধ্যে আটকে রাখা দু’টি বিমান এবং টিভি সম্প্রচারের সমস্ত মালপত্র ছেড়ে দিতে হবে। এর পর আর হিরো কাপে বিদেশি সংস্থাকে দিয়ে টিভি সম্প্রচার আটকে রাখা যায়নি।
মাঝরাত পেরিয়ে সেই রায়ের কথা মনে পড়লে আজও শিহরিত হয়ে পড়ি। এর পর ১৯৯৫ সালে আদালত রায় দিল যে, সিএবি বা বোর্ডই ঠিক করবে কাদের দিয়ে ম্যাচ সম্প্রচার করানো হবে। সেই রায় মেনেই আজও টেন্ডার ডাকা হচ্ছে। সে দিন ডালমিয়ার নেতৃত্বে সিএবি-র সেই লড়াইয়ে লাভবান হল ভারতীয় ক্রিকেট ও ভারতীয় বোর্ড-ও।
এর পর ললিত মোদী এসে আইপিএল নামক সুপারহিট টুর্নামেন্ট চালু করেছে ঠিকই। আইপিএলের সাফল্যের সিংহভাগ কৃতিত্ব ললিতকে দিতেই হবে। এখন আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব প্রায় সাড়ে ষোলো হাজার কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু চব্বিশ বছর আগে হিরো কাপকে কেন্দ্র করে সেই লড়াই ছিল আজকের হাইওয়ে তৈরির প্রথম ধাপ।
সেই সময় এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডালমিয়া এবং সিএবি-র লড়াইকে মেনে নিতে পারেননি। কেউ কেউ বলে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ইগোতেও প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল। হিরো কাপের ফাইনালের রাতে হঠাৎ শুনলাম, সেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নাকি খেলা দেখতে আসছেন। কিন্তু বি সি রায় ক্লাব হাউসের ভিআইপি বক্সে তাঁকে আমরা দেখতে পেলাম না। সত্যি-মিথ্যা জানি না, তবে শুনেছিলাম ডালমিয়া নাকি রাতারাতি সব ভুলে সন্ধি স্থাপন করতে চায়নি। তাই ক্লাব হাউসের টিকিটও আর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে পৌঁছয়নি।
আসলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়া কোনও যুদ্ধই যে জেতা যায় না!
(লেখক সিএবি এবং বোর্ডের প্রাক্তন আইনজীবী। হিরো কাপের ঐতিহাসিক মামলায় লড়েছিলেন সিএবি-র হয়ে)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy