সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গাওস্কর, ওয়াড়েকর ও চৌহান। অনুরাগীদের হাত থেকে গাওস্করকে মুক্ত করছে বাউন্সাররা। রবিবার ট্রয়ে। ছবি: স্বরূপ সাহা, অঞ্জন মিত্র।
পঁয়তাল্লিশ বছরের বারুদ জমতে জমতে রোববার রাতে ফেটে পড়ার পূর্বাভাস ছিল।
প্রকাশ্যও হয়ে যেত একাত্তরের যুগ্ম সিরিজ জয়ীদের ভারতীয় বোর্ড থেকে কখনও কোনও সম্মান না পাওয়ার গরল। আড়ালে আবডালে এঁরা এত দিন তীব্র অভিমানে বলেছেন, বিসিসিআই মনে করে কবে কী ঘি খেয়েছিল, এখন সব বুড়ো হাবড়া হয়ে গিয়েছে এদের দেখতে যাব কেন? কর্পোরেট সংস্থাগুলো ওয়াড়েকরের টিম সম্পর্কে অতীতে একই মনোভাব দেখিয়েছে। যতই সুদূরপ্রসারিত হয়ে থাকুক অতীতের কোনও জয়ের মাহাত্ম, কর্পোরেটের ধর্মই হল তারা সেই অতীত নিয়ে বাঁচতে চায় না। ওয়াড়েকরের টিম তাদের কাছে স্রেফ ডায়নোসরের গোষ্ঠী।
রোববার ট্রয় শহরের সান মারিনো ক্লাবে অনুষ্ঠান শুরুর ঘণ্টাখানেক আগেও একাত্তরের অধিনায়ক বলছিলেন, ‘‘বম্বে নামার পরে খোলা মোটরে এয়ারপোর্ট থেকে টিমকে মেরিন ড্রাইভে আনা হয়েছিল। ইন্দিরা গাঁধী বাড়িতে ডেকে চা খাইয়েছিলেন, সব ঠিক। কিন্তু পেয়েছিলাম একুশখানা মালা। এক টাকাও কেউ দেয়নি।’’ ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার যোগ করলেন, ‘‘তখন আমরা টেস্টে ডেইলি অ্যালাওয়েন্স পেতাম ৫০ টাকা করে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটা বেসরকারি টেস্টে আমরা জেতার মুখে ফোর্থ ডে-তে। আমি আর সারদেশাই নাকি সানি, কেউ একটা ব্যাট করছে। হঠাৎ ড্রেসিংরুম থেকে নির্দেশ এল আস্তে খেলো। ম্যাচটাকে ফিফথ ডে অবধি টানো। নইলে লাস্ট দিনের অ্যালাওয়েন্স পাওয়া যাবে না।’’ ফারুখ এর পর আক্ষেপ করলেন, ‘‘একাত্তরে কার্যত আমরা বিশ্বের এক নম্বর টিম। ইংল্যান্ড ছিল এক। তাদের মাঠে গিয়ে হারিয়ে এলাম। তাতেও কারও টনক নড়েনি। সেই পঞ্চাশ টাকা।’’ দর্শক হেসে গড়িয়ে পড়ল যখন ইঞ্জিনিয়ার সখেদে জানালেন, ‘‘সচিনটাকে সে দিন ধরলাম। হ্যাঁ রে এটা সত্যি নাকি যে দিনে তিন-চার কোটি টাকা তুই রোজগার করিস? ও একটু ভেবে বলল, না রোজ হয় না, প্রায় দিন হয়।’’
ওয়াড়েকরের টিমে কারও কারও নিয়মিত অভিমানের বাষ্প জন্মাচিছল জগমোহন ডালমিয়া সম্পর্কে। মনে হচ্ছিল ডালমিয়া ক্রিকেটারদের জন্য এত কিছু করেছেন। পেনশন স্কিম চালু করেছেন। বোর্ডের মোট আয়ের শতকরা ২৬ শতাংশ আজ ক্রিকেটাররা পায়, এর সঙ্গে প্রাইজ মানি। সিকে নায়ডু পুরস্কারের মোটা টাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে প্রাক্তনীদের। কিন্তু এই টিমের জন্য কিছু করার কথা বললেই তাঁর মুখে লেগে থাকে রহস্যজনক নীরবতা। আর শরদ পওয়ারের কাছেও ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস শুরু যেন তিরাশির জুনের লর্ডস থেকে। পওয়ারের বোর্ড মোটা টাকা দিয়েছে একমাত্র কপিলের কাপজয়ীদের।
আচমকা ডালমিয়ার মৃত্যুর খবরের আকস্মিকতায় পুরো গরলটাই যেন জুড়িয়ে গেল। হাজার খানেক দর্শক ঠাসা প্রেক্ষাগৃহে সংবর্ধনা নিতে উঠে একবারের জন্য কেউ বিসিসিআই নিয়ে কথা তুললেন না। বরঞ্চ হাসিঠাট্টায়-রঙ্গরসিকতায় এটাকে আরও একটা জমাটি ক্রিকেট অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হল। মূল থিম থেকে খানিকটা সরে গিয়েই।
শুরু হয়েছিল অবশ্য একাত্তর দিয়েই। ওয়াড়েকর এই প্রথম বোধহয় প্রকাশ্যে বললেন, রাজা পটৌডির থেকে মধ্যবিত্ত একজন মানুষ হিসেবে ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন্সি নিতে তাঁর কী সমস্যা হয়েছিল। টিমে কেউ কেউ রাজমহিমায় এমন আচ্ছন্ন ছিলেন যে নতুন ক্যাপ্টেনকে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। এর পর রসিকতা করলেন, ‘‘পটৌডির এত জনপ্রিয়তা ছিল কেন? শর্মিলাকে বিয়ে করার জন্য তো। আমি কম যাই কোথায়? আমার স্ত্রীও তো রেখা। কে বেশি ফেমাস আপনারাই বলুন না! শর্মিলা না রেখা?’’ হলে হাসির রোল উঠল।
গাওস্কর তুললেন একনাথ সোলকারের কথা। যাঁকে অনুষ্ঠান সম্পর্কিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে একটা আবেগপ্রবণ চিঠি লিখেছেন ওয়াড়েকর। বলেছেন, ‘‘এক্কি কিছু দিন বাদেই ওপরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। তখন তোমায় বলব আমেরিকার সংবর্ধনার রাতে কী কী হল। এখনকার মতো বলি ওভালে নটের ক্যাচটা আর জামাইকায় তোমার সারদেশাইয়ের সঙ্গে পার্টনারশিপ না হলে কিছুই ঘটত না।’’ টিমমেটরা জানালেন বয়কট সেই সিরিজে আউট হওয়ার পরেও দাঁড়িয়ে আছেন দেখে সোলকার নাকি তাঁকে বলেন আন্টিকে গিয়ে বোলো যে তুমি আউট ছিলে। গাওস্কররা অবাক, আন্টি বললি কেন হঠাৎ? সোলকার নির্বিকার, জানিস না ওর গার্লফ্রেন্ড ওর চেয়ে অনেক বেশি বয়সি।
গাওস্করকে অন্যতম অ্যাঙ্কর ইঞ্জিনিয়ার চেপে ধরলেন রজার বিনির গল্পটা সবাইকে বলো। গাওস্কর বললেন আজ নয়। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার নাছোড়বান্দা। হল হাসিতে ফেটে পড়ল গল্পটা শুনে। যে পাকিস্তানের সঙ্গে পেশওয়ার ম্যাচে ফিল্ডিং করার সময় হঠাৎ বিনি দৌড়ে এল আমার কাছে। স্কিপার আমাকে আউটফিল্ড থেকে সরাও। পাঠানরা আমায় ক্রমাগত লং অন বাউন্ডারি থেকে ছোট ছোট ফল ছুড়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য বিনির প্রশস্ত পশ্চাদ্দেশ। ওই সাইজের জন্য ড্রেসিংরুমে কোনও রসিক টিমমেট তাঁর নামকরণ করেছিল জ্যাকি। জ্যাকফ্রুট মানে কাঁঠালের অবয়বের সঙ্গে মিল রেখে। গাওস্কর বললেন, ‘‘তখন আমি দ্রুত বিনিকে সরিয়ে মদনলালকে পাঠালাম। একটু পরে দেখি মদনও ছুটে ছুটে আসছে। তোকেও কি ওরা ফল ছুড়ছে নাকি? না, তার চেয়েও খারাপ। বলছে পাথর মারবে। বলছে হয় যে ছিল ওই নাদুসটাকে পাঠা নয় তো পাথর খা।’’
বেঙ্গসরকর শোনালেন বন্ধু জাভেদ মিঁয়াদাদের গল্প। শারজার সেই শেষ বলে ছক্কার ব্যাট নাকি জাভেদ আমিরশাহিতে অন্তত পঁচিশ জনকে বিক্রি করেছেন। বেঙ্গসরকর বললেন, ‘‘প্রত্যেকে জানে চেতন শর্মাকে শেষ বলে মারা ছক্কার গর্বিত স্মারক তার বাড়িতে। অথচ সত্যিটা হল, আসল ব্যাটটা আছে জাভেদের নিজের কাছে।’’ আর এক বন্ধু দিলীপ দোশী কেমন ফিল্ডার ছিলেন? বেঙ্গসরকর জানালেন অ্যাডিলেডে দোশীর ফিল্ডিংয়ের কাহিনি। অ্যাডিলেডের দীর্ঘতম স্ট্রেট বাউন্ডারিতে গ্রেগ চ্যাপেল ড্রাইভ করেছেন। দোশী বল ধরতে ধরতে ব্যাটসম্যান দৌড়ে চার নিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ দোশী লাথি মেরে বল বাউন্ডারি করে দিল। বেঙ্গসরকর বললেন এটা কী করলি? ওরা তো চার নিয়েই নিয়েছে। দোশী বলেন, ‘‘কারণ আছে। আমার থ্রোয়ের জন্য আর একটা বাড়তি রান নিত।’’ হলে আবার তুমুল হাসি।
তাঁর পরিবার ছাড়া কেউ বোধহয় জানত না যে বেঙ্গসরকরের গানের গলা এত ভাল। ড্রেসিংরুমে কপিল সহ কোন কোন টিমমেট একই গান গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে গেয়ে আসছেন তাঁর প্যারোডি শোনালেন তিনি।
কেউ বোধহয় এটাও জানত না মার্কিন দেশে ক্রিকেটারদের নিয়ে যে এই পরিমাণ আবেগ জমে রয়েছে। সই শিকারি আর সেল্ফি তুলিয়েদের উপদ্রবে অনুষ্ঠান চালানো যাচ্ছিল না। দুশো-আড়াইশো ডলার দিয়ে টিকিট কেটে আসা অভিজাত দর্শক চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগের তারকাদের জন্য এমন হামলে পড়বে কেউ ভাবেইনি। সবচেয়ে মাদকতা অবশ্য বেঁটে লোকটিকে ঘিরেই। রাত্তির এগারোটা নাগাদ অনুষ্ঠান শেষ হতেই চার দিক থেকে অনুরাগীদের ভিড়ে অবরুদ্ধ হয়ে গেলেন গাওস্কর। শেষ পর্যন্ত মুস্কো দু’জন বাউন্সার পাঠিয়ে তাঁকে বার করতে হল। ওয়াড়েকর তখনও অস্ফুটে বলছেন, ‘‘আর একটু থিমের ভিতর থাকলে ভাল হত। ফারুখটা এখনও এমন চ্যাংড়া না।’’ কিন্তু তাঁর মনোভাবে কিছু আসে যায় না। জনতা বিনোদন চায় আর মুম্বইয়ের চলতি ভাষায় তাঁদের পয়সা উসুল।
ডালমিয়ার জন্য মৌন পালন হল এক মিনিট। তার সুর ধরেই যেন চেতন চৌহান বললেন, ‘‘গাওস্করকে দেখলেই এখন জড়িয়ে ধরি। শুধু ও নয়, ষাট বছরের বেশি পরিচিত যে কোনও মানুষকে দেখা হলেই জড়াই। এই বয়সি আমরা সবাই আসলে ম্যান্ডেটরি ওভার খেলছি। হঠাৎ আম্পায়ার আঙুল তুলে দেবে। বলবে ওভার শেষ।’’
এত হাসি-ঠাট্টার মধ্যেও সবাই চুপ হয়ে গেল। আরও একবার চুপ হল যখন মার্কিন দেশে সংবর্ধনার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ডালমিয়ার চিঠি পড়ে শোনানো হল। যেখানে তিনি লিখেছেন নির্দিষ্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট না থাকলে আপনাদের ওখানে ঘুরে যেতাম। দারুণ উদ্যোগ নিয়েছেন ওয়াড়েকরদের সংবর্ধনা দিয়ে।
সংযোজক বললেন, ‘‘কে জানত ঠিক এই দিনটাতে মৃত্যুর সঙ্গে উনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে বসে রয়েছেন।’’ ওই আবহে পঁয়তাল্লিশ বছরের গরলও পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে এতে আর আশ্চর্য কী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy