এ বার ফুটবলেও মহারাজ। খেলা শেষের বাঁশি বাজতেই উল্লসিত সৌরভের পাড়া। শনিবার সন্ধ্যায়। ছবি: শঙ্কর নাগদাস
একশো নিরানব্বই দিনেই আমূল বদলে গেল স্লোগানটা!
পয়লা জুন রাতে কেকেআর আইপিএল ট্রফিটা হাতে নেওয়ার দিন শহর স্লোগান তুলেছিল ‘ইস বার ভি কেকেআর, ইস বার ভি কেকেআর।’
আর শনিবার সন্ধ্যা নামতেই শহরের বিভিন্ন শপিং মল, কফি শপ ও পাড়ার আড্ডা কখনও মুখরিত ‘গোল চাই জেতা চাই/ আইএসএল ট্রফি কলকাতায় চাই।’ কোথাও বা ‘ঢাকের তালে চিত্কার চাই/ গোল হলে গজর্ন চাই।’
ক্ষীণ কটি মডেল থেকে শাহরুখ, সলমনদের বঙ্গজ ক্রীড়াপ্রেমী সংস্করণ তো ছিলই। ছিলেন চিকিত্সক-অভিনেতা-ক্রীড়াবিদ থেকে রাজনীতির ‘হুজ হু’-রাও। বাদ ছিলেন না স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও। আটলেটিকো দে কলকাতার প্রথম বার আইএসএল জয়ের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সমান আপ্লুত। শহরের মাথায় তারকাখচিত ফুটবল ট্যুর্নামেন্টের তাজ স্থাপনের দিনে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া, “কলকাতা কলকাতাই।”
কার্নিভ্যালের মরসুমে ক্রিসমাস ট্রি, কফি, কেক, কুকিজ, সান্তাক্লজ তো থাকেই। বড়দিনের ঠিক আগের স্যাটারডে নাইটে কলকাতা কোমর দোলানো মুডের উপলক্ষও যে পেয়ে গেল এ দিন। প্রথম আইএসএল ট্রফি। আরও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে বললে, একই বছরে একেবারে ‘ডাব্ল’ জয়। আইপিএল এবং আইএসএল।
রাত দশটা। বেকবাগান মোড়ের শপিং মলের সামনে আটলেটিকোর জার্সি গায়ে উদ্দাম নাচে ব্যস্ত ‘জেন ওয়াই’ প্রজন্মের গোটা পনেরো তরুণ-তরুণী। গায়ে কেকেআর-এর লাল-সাদা জার্সি। মুখে ‘এ-টি-কে, এ-টি-কে’ স্লোগান। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি বুঝতে পেরেই এগিয়ে এলেন এঁদেরই এক জন সন্দীপ মুখোপাধ্যায়। গড়িয়ার এই বাসিন্দা কপট রাগ দেখিয়ে প্রথমে বললেন, “মিডিয়ার কেউ কেউ তো আটলেটিকো ড্র কলকাতা বানিয়ে দিয়েছিল আমাদের টিমকে। এ বার তাঁরা কী বলবেন? আজ তো কোনও ড্র, টাইব্রেকার কিছুই হল না। আমরা জিতলাম।” বলেই বান্ধবীর হাত ধরে রাস্তার মধ্যেই শুরু করলেন নাচ। ডিউটিরত পুলিশকর্মীও যা দেখে বিড়বিড় করতে শুরু করলেন, “রাস্তাকে ডান্স ফ্লোর বানিয়ে ফেললে তো খুব মুশকিলের বিষয়!” তার পরেই সঙ্গে থাকা ম্যান প্যাকে নির্দেশ দিলেন জটলা সরানোর।
রাত সাড়ে ন’টা বেহালা চৌরাস্তার মোড়। ঢোল বাজিয়ে তখন এলাকার পরিচিত সৌরভপ্রেমী রতন হালদার উদ্বাহু নাচে মগ্ন। সঙ্গে মুখে ছড়া: ‘সৌরভ আছে, গার্সিয়া আছে/ আমরা আজ রফিকের পাশে।’ আইএসএল ট্রফির প্রতিকৃতি নিয়ে চৌরাস্তার মোড়ে তখন মিছিল বেরিয়েছে। যেখানে হাজির শ’খানেক আটলেটিকোপ্রেমী। কলকাতা ময়দানে লাল-হলুদ তাঁবুর পরিচিত মুখ রতন বলছিলেন, “আজকের আনন্দ রাখার নয়। গোল তো করল আমাদের ক্লাবের ছেলেই। আইপিএল-এর ফাইনাল মাতিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গসন্তান ঋদ্ধিমান। আর আইএসএল-এর ফাইনালের নায়কও আমাদের রফিক।”
পাশ থেকে দেখা দিল মিছিলের এক উত্সাহী মুখ। বলতে শুরু করলেন, “প্রতিটি হোম ম্যাচ এখান থেকে মিনিবাস ভর্তি করে লোক নিয়ে মাঠে গিয়েছি। আজ ফাইনালের উদ্যাপনের জন্যই খরচ হয়েছে হাজার চল্লিশ টাকা। গোটা পাড়ায় আজ ফিস্ট।”
নিজেদের পাড়ার ক্লাব সঙ্ঘশ্রীতে রতনেরা এ দিন এক টুকরো আটলেটিকো মাদ্রিদকেই হাজির করে ফেলেছিলেন। সৌরভ, গার্সিয়া, রফিক, হাবাসদের ফ্লেক্স তো ছিলই। সঙ্গে বাজনা আর আতসবাজির রোশনাই। ক্লাবের সামনে সবুজ কার্পেট পেতে গোলপোস্ট। যেন মুম্বইয়ের ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামটাই হাজির বেহালার আটলেটিকো মালিকের পাড়ায়। সঙ্গে জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখার মৌতাত নিতে হাজির আট থেকে আশি। আর রসনা তৃপ্তির জন্য খিচুড়ি, আলুর দম তো আছেই। রফিকের গোলের পরে এমন চিত্কার শুরু হল যা ‘হোক কলরব’-কেও পাল্লা দিতে পারে।
রাজারহাটের যে হোটেলে আটলেটিকোর আস্তানা ছিল, উত্সব চলল সেখানেও। পানশালায় খেলা দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল। গোল হতেই সেখান থেকে কেউ কেউ টুক করে ঢুকে পড়লেন ডিস্কে। হোটেলের কর্মীরা আবার ব্যস্ত রবিবার দুপুরে টিম হোটেলে ঢুকলে কী ভাবে গার্সিয়া-রফিকদের বরণ করা হবে, তার ব্যবস্থাপনা নিয়ে।
কামারহাটি থেকে কামালগাজির ‘স্যাটারডে নাইট’ এ দিন দুলিয়ে দিল আটলেটিকো দে কলকাতা। আর কনসার্টে? ‘ফাটাফাটি ফুটবল, লেটস ডু সাম হট্টগোল’-এর বাইরে আর কোনও গান থাকতে পারে নাকি? আটলেটিকো দে কলকাতা যে আইএসএলে নতুন রূপকথা লিখেই ফেলল। যার কেন্দ্র চরিত্র বঙ্গসন্তান সোদপুরের ছেলে মহম্মদ রফিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy