Advertisement
E-Paper

রোবট, কিন্তু জীবন্ত

রুবিক’স কিউব নিয়ে খেলা। তা থেকেই এল ভ্রূণ থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রাণী তৈরির কৌশলরুবিক’স কিউব নিয়ে খেলা। তা থেকেই এল ভ্রূণ থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রাণী তৈরির কৌশল

জেনোবট।

জেনোবট।

অর্ঘ্য মান্না

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:৩৪
Share
Save

আর্নো রুবিক তখন হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড আর্ট-এ সদ্য চাকরি পেয়েছেন। সেটা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়। ইউরোপ জুড়ে স্থাপত্য ও ডিজ়াইন নিয়ে নানান রকম পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। রুবিকও সেই জোয়ারে গা ভাসালেন। তৈরি করে ফেললেন এক অদ্ভুত ত্রিমাত্রিক পাজ্ল গেম। এটি আসলে একটি কিউব বা ঘন, যা বিশ্বজুড়ে পরিচিত হবে ‘রুবিক’স কিউব’ নামে। কিউবটি চার রঙের একাধিক ছোট ছোট কিউব জুড়ে তৈরি। ছোট কিউবগুলির প্রত্যেকটির আয়তন সমান। ছোট চার রঙের কিউবগুলি থাকবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, এলোমেলো ভাবে। একটি রঙের কিউবকে সাজিয়ে বড় কিউবের একটি তলে নিয়ে আসাটাই চ্যালেঞ্জ।

বাজারে আসার পরেই দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে রুবিকের কিউব। সেই জনপ্রিয়তায় আজও ভাটা পড়েনি। বুদ্ধির গোড়ায় শান দিতে এই কিউব নিয়ে খেলেন ছোট-বড় সকলেই। পরবর্তী কালে অন্য আকারের রুবিক ইউনিট বাজারে এসেছে। যেমন, পিরামিডাকার রুবিকের খেলনা। সেগুলিও ছোট ছোট জ্যামিতিক ইউনিট দিয়ে তৈরি। বিশুদ্ধ গণিত নিয়ে যাঁরা কাজকর্ম করেন, তাঁরাও রুবিকের তৈরি পাজ্ল নিয়ে খুব উৎসাহী। রুবিকের কিউব সমাধান করা, অর্থাৎ চারটি তলে বা সারফেসে একই রঙের ছোট ছোট কিউব সাজিয়ে ফেলার একটা নিয়ম রয়েছে। সেই নিয়ম জানলে সহজেই কেল্লাফতে করা যায়। না হলে ভরসা করতে হয় ভাগ্যের উপর। ভাগ্যের উপর ভরসা করে থাকা কোনও ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন প্রোব্যাবিলিস্টিক বা স্টোকাস্টিক। সে ক্ষেত্রে প্রোব্যাবিলিটি বা সম্ভাব্যতার উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু কোনও ঘটনা নিয়ম মেনে হলে, তখন তাকে বলা হয় ডিটারমিনিস্টিক। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট পথে চলবে ঘটনাপ্রবাহ। রুবিক কিউব পাজ্ল-এর সমাধান করাটা আপাতদৃষ্টিতে প্রোব্যাবিলিস্টিক মনে হলেও, আসলে এটি খেলার নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে।

ঠিক যেমন নিয়ম রয়েছে প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত সমস্ত কাণ্ডকারখানার। প্রকৃতির নানাবিধ চমকে দেওয়ার মতো কাজকর্মের একটি হল, কোনও একটি প্রাণীর ভ্রূণ থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রাণী দেহ তৈরি হওয়া। ঘটনাটি শুরু হয় একটি মাত্র কোষ থেকে, যাকে বলা হয় জাইগোট। তার পরে কোষ বিভাজন এবং একাধিক কোষ সম্পন্ন ভ্রূণ তৈরি। আসল জটিলতা এর পরেই। কোষগুলি হাঁটতে শুরু করে নিজ নিজ রাস্তায়। কোনও ভুলচুক নেই। স্নায়ুতন্ত্রের জন্য নির্ধারিত কোষ, পেশির জন্য নির্ধারিত কোষ, অন্য যে কোনও অঙ্গ গড়ে তোলার নির্ধারিত কোষ একজোট হয়ে তৈরি করে ফেলে দেহ। কেউ গুলিয়ে ফেলে না নিজের কাজ, কেউ অন্য কারও রাস্তায় হাঁটে না। এ এক বিস্ময় বটে! যেন কোনও এক অদৃশ্য খেলোয়াড় খেলতে বসেছে কোষের তৈরি রুবিকের কিউব নিয়ে। হরেক রকমের কোষ একের পর এক সাজিয়ে শেষ করেছে খেলা। আর্নো রুবিকের তৈরি পাজ্ল সমাধানের যেমন একটা নিয়ম রয়েছে, তেমনই প্রকৃতির এই অদ্ভুত খেলারও নিজস্ব নিয়ম রয়েছে। সেই নিয়মেরই খোঁজ বিশ্বজুড়ে করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানী জোস বোনগার্ডও এই কাজে ব্রতী প্রায় দুই দশক ধরে।

নতুন বছরের শুরুতেই বিজ্ঞান মহলে বোমাটা ফাটিয়েছেন বোনগার্ড। তিনি ও তাঁর গবেষক দল তৈরি করে ফেলেছেন পৃথিবীর প্রথম জীবন্ত রোবট। এই রোবটের নাম ‘জেনোবট’। আফ্রিকার বিশেষ প্রজাতির ব্যাঙ জেনোপাস লেভিস-এর ভ্রূণ থেকে আলাদা করা স্টেম সেল থেকে এই রোবট তৈরি হয়েছে, তাই এমন নাম। এর আগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ভর করে ধাতব রোবট তৈরি হয়েছে। কিন্তু জীবন্ত কোষকে কাজে লাগিয়ে রোবট, এই প্রথম। ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’ জার্নালে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হতেই বিজ্ঞানমহলের নজর এখন বোনগার্ডের কর্মকাণ্ডের উপর। এক সাক্ষাৎকারে বোনগার্ড বলেছেন, “সম্পূর্ণ নতুন প্রাণ তৈরি করতে পেরেছি আমরা। জেনোবট জীবিত কোষ দিয়ে তৈরি, কোনও ধাতু দিয়ে নয়। এদের নিজস্ব বুদ্ধি রয়েছে, রয়েছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। সবচেয়ে বড় কথা এই রোবট নিজেরাই নিজেদের ক্ষত সারিয়ে ফেলে। পৃথিবীকে এক নতুন প্রজাতি উপহার দিল আমাদের গবেষণা।” কী ভাবে তৈরি হল এই অদ্ভুত রোবট? নেপথ্যে সেই রুবিকের কিউব নিয়ে খেলা। বোনগার্ড ও তাঁর গবেষকদল ধরতে পেরেছেন জাইগোট থেকে ভ্রূণের পূর্ণাঙ্গ গঠনের সময় প্রকৃতির রুবিক’স কিউব নিয়ে খেলার নিয়ম।

জোস বোনগার্ডের পিএইচ ডি-র গবেষণা সুইৎজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তাঁর মেন্টর ছিলেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক গবেষণার দিকপাল রল্ফ ফাইফার। পিএইচ ডি-র সময় রোবটের দেহ গঠনের বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মস্তিষ্কের বিবর্তন নিয়ে কাজ করেছিলেন বোনগার্ড। তখন থেকেই বুদ্ধিমান প্রাণীর বিবর্তন নিয়ে উৎসাহী তিনি। তাঁর গবেষণার যন্ত্রপাতি মূলত গাণিতিক সূত্র, গবেষণাগার হল কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক। কেরিয়ারের শুরুটা হয়েছিল তাত্ত্বিক গবেষণা দিয়েই। ২০০৬ সালে ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মরফোলজি, ইভোলিউশন অ্যান্ড কগনিশন ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর পদে যোগ দেন বোনগার্ড। সেই বছরই ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘হাও দ্য বডি শেপস দ্য ওয়ে উই থিঙ্ক: আ নিউ ভিউ অব ইন্টেলিজেন্স’। দেহ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার বিকাশে কোনও সম্পর্ক রয়েছে কি না, সেটাই অনুসন্ধান করেছেন বোনগার্ড। রোবটের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আগেই কাজ করেছেন। তাঁকে টানছিল বুদ্ধিমান জীবন্ত প্রাণী গড়ে ওঠার রহস্য কোথায় লুকিয়ে? সেই রহস্যের সমাধান কি রয়েছে ভ্রূণ গঠনের সময় প্রকৃতির রুবিক’স কিউব খেলার মধ্যে?

উত্তর জানতে বোনগার্ডের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এক বিশেষ দল—কম্পিউটার ডিজ়াইনড অর্গ্যানিজ়ম (সিডিএ)। সদস্য চার জন, ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্যাম ক্রিগম্যান, টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালেন ডিসকভারি সেন্টারের বিজ্ঞানী ডগলাস ব্ল্যাকিস্টোন ও মাইকেল লেভিন, এবং বোনগার্ড নিজে। এই দল প্রথমেই যে কাজটা করেছে তা হল, একটি অ্যালগরিদম তৈরি করা, যার নাম ‘ইভোলিউশনারি অ্যালগরিদম’। ব্যাপারটা কী? মোদ্দা কথা হল, কম্পিউটারে একের পর এক গাণিতিক সূত্রের সাহায্যে তাঁরা ছকে নিয়েছেন বহুকোষী উন্নত প্রাণী তৈরির সময় প্রকৃতি ঠিক কত রকম ভাবে রুবিক কিউবের খেলাটা খেলতে পারে। আর এই খেলায় ইভোলিউশন বা বিবর্তন কী ভাবে কাজ করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আদিম মানব থেকে আধুনিক মানুষের বিবর্তনের মতো দীর্ঘ সময়কালকে ধরেননি তাঁরা। তাঁরা নজর দিয়েছেন মাইক্রোইভোলিউশনে। কোনও একটি পপুলেশন বা জনগোষ্ঠীর জিন ফ্রিকোয়েন্সি চারটি কারণে পরিবর্তিত হতে পারে— জেনেটিক মিউটেশন, ন্যাচরাল সিলেকশন, এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে জিনের প্রবাহ এবং কোনও কার্যক্ষম জিনের হারিয়ে যাওয়া বা নতুন করে জেগে ওঠা। এগুলির কারণেই ঘটে মাইক্রোইভোলিউশন। প্রাচীন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার হঠাৎ করে সংক্রামক হয়ে ওঠা মাইক্রোইভোলিউশনের অন্যতম উদাহরণ। এ ক্ষেত্রে, খুব কম সময়েই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াটি নিজের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন না করেও সম্পূর্ণ নতুন এক প্রজাতির মতো আচরণ করে। তখন তার রকমসকম বুঝে উঠতে বেগ পেতে হয়। জাইগোট থেকে বহুকোষী ভ্রূণ, তা থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী তৈরি হওয়াটাও মাইক্রোইভোলিউশন বলেই ধরে নিয়ে নিজেদের অ্যালগরিদম তৈরি করে সিডিএ দল।

অ্যালগরিদম অনুযায়ী, একাধিক রুবিক’স কিউব-কে এলোমেলো করে নিজের মতো সেজে উঠতে দেওয়া হয়। ধরে নেওয়া হয়, এক একটি কিউব ব্যাঙের এক একটি স্টেম সেল। শতাধিক রুবিক’স কিউবের গঠন তৈরি করে কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সেই কিউবগুলিতে মাইক্রোইভোলিউশনের শর্তাবলী প্রয়োগ করতেই দেখা যায় কম্পিউটারের স্ক্রিনে প্রাণ পেয়েছে আর্নো রুবিকের তৈরি কিউব। সেই কিউব নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে, চলাফেরা করতে পারে এবং নিজেদের ক্ষত নিজেরাই সারাতে পারে। অ্যালগরিদমের কেরামতি এ বার হাতকলমে পরীক্ষা করে দেখার পালা। জেনোপাস লেভিস-এর ভ্রূণ থেকে স্টেম সেলকে আলাদা করে বিশেষ একটি তরলে রাখা হয়। কোষ সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় অ্যালগরিদমে গড়ে ওঠা রুবিক কিউবের ছবি অনুযায়ী। তার পরেই ম্যাজিক! স্টেম সেলগুলি নিজেরাই রুবিক কিউব খেলার মতো সেজে ওঠে বিশেষ প্যাটার্নে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে জেনোবট, পৃথিবীর প্রথম জীবন্ত রোবট। সিডিএ প্রকাশিত ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, দিব্যি হেঁটে দলে বেড়াচ্ছে এই ছোট্ট রোবট। শুধু তাই নয়, ধারালো টুইজারের ফলা দিয়ে আহত করলে নিজে থেকেই সেরে যাচ্ছে রোবটের ক্ষত।

বোনগার্ড ও তাঁর তিন সঙ্গীর গবেষণা প্রমাণ করেছে, নানাবিধ কোষের একসঙ্গে জুড়ে যাওয়া, তার পরে সেগুলির পরিবর্তন, নিজেদের মতো করে সেজে উঠে ভ্রূণ থেকে বুদ্ধিমান প্রাণীতে রূপান্তর— এই ব্যাপারটি মোটেই সম্ভাবনার উপর নির্ভরশীল নয়। এ ক্ষেত্রে রুবিক’স কিউব সাজায় প্রকৃতি। শুধুমাত্র সেই খেলার নিয়মটা জানার অপেক্ষা।

তবে এই গবেষণায় জন্ম হয়েছে নতুন বিতর্কের। এই ধরনের রোবট তৈরির সার্থকতা কোথায়? প্রকাশিত গবেষণাপত্রের প্রথম পাতাতেই সে কৈফিয়ত দিয়েছেন বোনগার্ডেরা। এই রোবট কাজে লাগবে ক্যানসারের মতো জটিল রোগ সারাতে। টিউমারে সরাসরি ওষুধ পৌঁছে দেওয়া যাবে এই রোবটে ভর করে। এ ছাড়াও মাইক্রোপ্লাস্টিক গিলে নিতে পারবে এই জেনোবট। কিন্তু এই রোবট যদি কোনও দিন মানুষের মতো বিবর্তনের রাস্তা ধরে আরও বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে? মানুষের অস্তিত্বই বিপন্ন করে তোলে? মেরি শেলির লেখা উপন্যাসে ভিক্টর ফ্রাঙ্কেস্টাইন যে ভুলটা করেছিলেন, একই ভুল করার পথে হাঁটছেন না তো বোনগার্ডেরা?

রুবিক যখন তাঁর পৃথিবীবিখ্যাত খেলনা আবিষ্কার করেছিলেন, তখন স্বপ্নেও ভাবেননি যে, বুদ্ধির ব্যায়াম থেকেই এক দিন পাওয়া যাবে প্রাণ সৃষ্টির কৌশল।

teacher manna dey Xanadu 2.0

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}