চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
চাঁদের মাটি ছুঁয়েছে ভারত। বুধবার সন্ধ্যায় ইসরোর চন্দ্রযান-৩ অভিযান সফল হয়েছে। এই সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের মাটিতে মহাকাশযান নামানো দেশগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে ভারতের নাম। এর আগে কেবল আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের এই কৃতিত্ব রয়েছে। শুধু তাই নয়, আরও একটি ইতিহাস ছুঁয়েছে ইসরো। চাঁদের দক্ষিণ মেরু এত দিন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত ছিল। ভারতই প্রথম দেশ হিসাবে চন্দ্রের এই প্রান্তটিতে পা রাখল। চাঁদের ‘কুমেরু’ আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাই ভারতের।
বুধবার বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে শুরু হয় বিক্রমের অবতরণের প্রক্রিয়া। ঠিক ১৯ মিনিট পরে চাঁদে পা রাখে ল্যান্ডার। এই ১৯ মিনিট ধরে ইসরোর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল গোটা দেশ। বিকেল ৫টা ২০ মিনিট থেকে ইসরো গোটা প্রক্রিয়ার সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সেখানে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ধাপে ধাপে গতি কমিয়ে উচ্চতা হ্রাস করে বিক্রমকে চাঁদের দিকে নামিয়ে আনা হয়। একটি করে ধাপ সম্পন্ন হতেই হাততালি দিয়ে উঠছিলেন বিজ্ঞানীরা। বিক্রমের অবতরণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার পেট থেকে বেরিয়ে আসে রোভার প্রজ্ঞান। ধীর গতিতে কাজ শুরু করেছে সে। প্রজ্ঞানের গতি অতি ক্ষীণ, সেকেন্ডে মাত্র এক সেন্টিমিটার।
চাঁদের থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের কক্ষপথে ছিল বিক্রম। প্রথমে গতি কমিয়ে সেটিকে সাত কিলোমিটারে নামানো হয়। এই পর্যায়ের নাম ‘রাফ ব্রেকিং’। এর পর শুরু হয় ‘ফাইন ব্রেকিং’। ক্রমে ৮০০ মিটার, ১৫০ মিটার, ৬০ মিটার, ১০ মিটারে কমে আসে উচ্চতা। এই পর্যায়ে অনবরত বিক্রমের মধ্যেকার ক্যামেরা এবং সেন্সর অবতরণের জন্য উপযুক্ত জমি খুঁজছিল। যে জমি হবে তুলনামূলক ভাবে মসৃণ, যেখানে খানাখন্দ বা পাথরের টুকরো থাকবে না। ইসরো কথা রেখেছে। ঘড়ির কাঁটা ধরে একেবারে ৬টা ৪ মিনিটেই চাঁদে নেমেছে বিক্রম। এই সাফল্যের পরেই প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা নাড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তার পর দেশবাসীর উদ্দেশে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই ভার্চুয়াল মাধ্যমে ভাষণ দেন তিনি।
গত ১৪ জুলাই দুপুর ২টো ৩৫ মিনিটে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস সেন্টারের ‘লঞ্চিং প্যাড’ থেকে চাঁদের অনাবিষ্কৃত দক্ষিণ মেরুর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল ‘চন্দ্রযান-৩’। ৪০ দিনের মাথায় তার অভিযান সফল হল। অন্য দিকে, রাশিয়াও চাঁদের দক্ষিণ মেরুকে পাখির চোখ করেছিল। পাঁচ দশক পর তারা চন্দ্রঅভিযানে হাত দিয়েছিল। গত ১১ অগস্ট চাঁদের উদ্দেশে রওনা দেয় রাশিয়ার লুনা-২৫। কিন্তু রুশ অভিযান সফল হয়নি। চাঁদের প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে তাদের সঙ্গে ল্যান্ডারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে চাঁদের মাটিতে ভেঙে পড়ে ল্যান্ডারটি। রাশিয়া যা পারেনি, তা-ই করে দেখাল ভারত।
রুদ্ধশ্বাস ১৯ মিনিট
ল্যান্ডার বিক্রমের অবতরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে। ঠিক সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে তা চাঁদের মাটি ছুঁয়েছে। অর্থাৎ, সমগ্র প্রক্রিয়ায় সময় লেগেছে মোট ১৯ মিনিট। এই সময়ে ইসরোর সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশ যেন দম বন্ধ করে ছিল। ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করেছিল দেশবাসী।
ইতিহাসে ভারত
চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে দু’টি ইতিহাস ছুঁয়েছে ভারত। এক, তারা চতুর্থ দেশ হিসাবে চাঁদে মহাকাশযান নামিয়েছে। এর আগে কেবল রাশিয়া, আমেরিকা এবং চিন এই কাজটি সফল ভাবে করতে পেরেছিল। তিন বারের প্রচেষ্টায় চাঁদের মাটি ছুঁতে পারল ভারত। দুই, ভারতই প্রথম দেশ, যে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পা রাখল। এর আগে কোনও দেশ এই কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেনি। দক্ষিণ মেরুটি এত দিন অনাবিষ্কৃত ছিল।
ধাপে ধাপে অবতরণ
চাঁদের মাটিতে পাখির পালকের মতো অবতরণ (সফ্ট ল্যান্ডিং) করেছে চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম। সেটি ৩০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থান করছিল। অবতরণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর ধাপে ধাপে প্রথমে ৭ কিলোমিটার, তার পর ৮০০ মিটার, ১৫০ মিটার, ৬০ মিটার, ১০ মিটারের পর্যায় পেরিয়ে চাঁদে নেমেছে ল্যান্ডার। প্রতি মুহূর্তে তার গতিও সমান তালে কমানো হয়েছে।
ইসরোয় উচ্ছ্বাস
বিক্রম চাঁদের মাটি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসরোর বেঙ্গালুরুর অফিস উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। সকলে উঠে দাঁডি়য়ে হাততালি দিতে শুরু করেন। একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। এই সাফল্যের পর ইসরোর অফিসের সেই উন্মাদনার আঁচ ছড়িয়ে পড়ে দেশবাসীর মনেও।
দেশজুড়ে উল্লাস
চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্যের উদ্যাপন চলছে দেশ জুড়ে। দেশের নানা প্রান্তে মানুষ উৎসব পালন শুরু করেছেন। বিদেশ থেকেও ভেসে আসছে একের পর এক শুভেচ্ছাবার্তা।
কী বললেন মোদী
ভার্চুয়াল মাধ্যমে ইসরোর সরাসরি সম্প্রচারে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ছোট পরিসরের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই আকারে ছোট জাতীয় পতাকা হাতে নিয়েছিলেন তিনি। বিক্রম চাঁদ ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই পতাকা নাড়িয়ে মোদী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। চন্দ্রযান-৩-এর সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী এবং ১৪০ কোটি ভারতবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মোদী বলেন, ‘‘আমরা ভারতে পৃথিবীকে মা বলি আর চাঁদকে বলি মামা। ভারতের শিশুদের মায়েরা এত দিন বলে এসেছেন, ‘চন্দামামা দূর কি হ্যায়’ (ওই দূরে চাঁদমামা)। আমার বিশ্বাস খুব শিগগিরই ভারতের আগামী প্রজন্মের শিশুরা বলবে ‘চন্দামামা ট্যুর কি হ্যায়’ (চাঁদমামা বেড়ানোর জায়গা)।’’ আগের অভিযানের ব্যর্থতার উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘‘হার থেকে শিক্ষা নিয়ে কী ভাবে জয়ী হওয়া যায় তার প্রমাণ দিল এই অভিযান।... বিজ্ঞানীরা ঠিকই বলেছেন ইন্ডিয়া ইজ় নাউ অন দ্য মুন।’’
ছবি পাঠাল বিক্রম
চাঁদের মাটিতে নামার পর কাজ শুরু করে দিল বিক্রম। ইসরোয় পৌঁছল বিক্রম থেকে তোলা প্রথম ছবি। বিক্রমের অবতরণ প্রক্রিয়ার সমাপ্তি পর্বের সেই ছবি প্রকাশ করে ইসরো টুইট করেছে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডারের সঙ্গে মক্স-আইএসটিআরসি (ইসরোর ওয়ার রুম)-র সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হয়েছে।’
আসল কাজ প্রজ্ঞানের
ইসরোর বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করছেন, চাঁদের বুকে ‘আসল কাজ’ শুরু হয়েছে রোভার প্রজ্ঞান চাঁদের মাটিতে নামার পরে। রোভারের সঙ্গে রয়েছে একাধিক দিকনির্দেশক স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা। চাঁদের মাটিতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে প্রজ্ঞান। চাঁদের মাটিতে প্রজ্ঞানই এঁকে দেবে ভারতের জাতীয় পতাকা এবং ইসরোর লোগো। প্রজ্ঞান চাঁদ থেকে যা যা তথ্য সংগ্রহ করবে, তার সব কিছুই পাঠিয়ে দেবে ল্যান্ডার বিক্রমে। বিক্রম সেই বার্তা পাঠাবে পৃথিবীতে।
কী করবে প্রজ্ঞান?
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চাঁদের ভূমিরূপ কী ভাবে তৈরি হয়েছে, কোন কোন উপাদান দিয়ে চাঁদের মাটি তৈরি, তা খতিয়ে দেখে বার্তা পাঠাবে প্রজ্ঞান। আগামী দু’সপ্তাহ ধরে স্পেকট্রোমিটার বিশ্লেষণের মাধ্যমে চাঁদের মাটিতে কোন ধরনের খনিজ বস্তু আছে, তা খুঁটিয়ে দেখবে সে। এই সমস্ত পরীক্ষাগুলি করার জন্য ল্যান্ডার এবং রোভারের সঙ্গে রয়েছে পাঁচটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি।
সাফল্য কামনায় দেশ
বুধবার সকাল থেকেই ভারতের এই চন্দ্র অভিযানের সাফল্য কামনা করে যাগযজ্ঞ হয়েছে দেশের নানা প্রান্তে। কেউ নমাজ পড়েছেন, কেউ বিশেষ পুজোর আয়োজন করেছেন। প্রার্থনা ছিল একটাই, চার বছর আগের ব্যর্থতার গ্লানি এ বার যেন মুছে যায়। তাঁদের প্রার্থনা সফল হয়েছে।
চন্দ্রযান পুরস্কার
চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্য স্মরণীয় করে রাখতে এবং বিজ্ঞানের ছাত্রদের উৎসাহ দিতে ‘চন্দ্রযান পুরস্কার’ ঘোষণা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সেরা ছাত্রকে প্রতি বছর এই পুরস্কার দেওয়া হবে। ছাত্রটি পাবেন এক লক্ষ টাকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy