প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরা এই দেশ। আর ততটাই বৈচিত্র্যময় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের দেহের গঠন কিংবা জিন-চরিত্র। এই বৈচিত্রকে জানা-বোঝা ও যাবতীয় তথ্য একত্রিত করে একটি বায়ো-ব্যাঙ্ক তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে। ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক অনুমোদিত সেই ‘জিনোমইন্ডিয়া’ প্রকল্পের প্রথম গবেষণাপত্রটি মঙ্গলবার প্রকাশিত হল ‘নেচার জেনেটিক্স’ জার্নালে।
গবেষণায় যুক্ত বিজ্ঞানীরা জানালেন, তাঁদের তৈরি বায়ো-ব্যাঙ্কে জমা পড়েছে অনেক তথ্য, যা ক্যানসার থেকে ডায়াবিটিস, কিংবা আচমকা এসে পড়া কোনও মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে।
১৪০ কোটির দেশের বাসিন্দাদের কোনও জিন-তথ্যভান্ডার ছিল না। রোগনির্ণয়, চিকিৎসা, ওষুধ তৈরি বা রোগীর জন্য ঠিক নিরাময় নির্বাচনে নির্ভর করতে হত ইউরোপের তথ্যভান্ডারের ওপর। অথচ ইউরোপীয়দের সঙ্গে এ দেশের মানুষের শারীরিক ও জিনগত পার্থক্য অনেক। তাঁদের শরীরে যে ওষুধ কাজ দেয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই ভারতবাসীর জন্য অকার্যকর, এমনকি ক্ষতিকরও প্রমাণিত হয়। এই গবেষণার অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী কল্যাণীর ‘বায়োটেকনোলজি রিসার্চ ইনোভেশন কাউন্সিল-ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স’ (ব্রিক-এনআইবিএমজি)-এর অনলাভ বসু বলেন, ‘‘২০১৫-২০১৬ সাল থেকেই জিন-তথ্যভান্ডার তৈরির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আমাদের দেশের নিজেদের একটা ডেটাবেস প্রয়োজন। ২০টি প্রতিষ্ঠানের দেড়শোরও বেশি বিজ্ঞানী গত পাঁচ বছর ধরে জঙ্গলের ভিতরে জনজাতি গোষ্ঠীর কাছে গিয়েছেন, রাজনৈতিক ভাবে অশান্ত এলাকায় গিয়েছেন, পাহাড়ি এলাকায় ঘুরে ঘুরে বাসিন্দাদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছেন।’’ তিনি আরও জানান, কোভিড অতিমারির জেরে এই কাজ আরও দুরূহ হয়ে পড়েছিল।
এই কর্মকাণ্ডে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল ব্রিক-এনআইবিএমজি। এ ছাড়া হায়দরাবাদের সিএসআইআর-সিসিএমবি, দিল্লির সিএসআইআর-আইজিআইবি এবং বেঙ্গালুরু আইআইএসসি-র ‘সেন্টার ফর ব্রেন রিসার্চ’ মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ভারতের ভিন্ন ভিন্ন ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চলের ৮৩টি পৃথক জনগোষ্ঠীর ২০ হাজার মানুষের থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এই ৮৩টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে ৩০টি আদিবাসী জনজাতি। প্রত্যেকের উচ্চতা, ওজন, রক্তে শর্করার মাত্রা, লিভার বা যকৃতের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখা হয়। পাশাপাশি গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ১০ হাজার জনের ‘হোল জিনোম সিকোয়েন্স’ সংক্রান্ত তথ্য, সামাজিক-জনসংখ্যাগত এবং জৈবরাসায়নিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
এই গবেষণার ‘ফার্স্ট অথর’ বিজ্ঞানী চন্দ্রিকা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এ দেশের মানুষের মধ্যে কোন ধরনের রোগের ঝুঁকি রয়েছে, রোগপ্রতিরোধ কী ভাবে করা যায়, এ সবের জবাব দেবে এই তথ্যভান্ডার। এ ছাড়া, রোগীবিশেষে চিকিৎসা (পার্সোনালাইজ়ড ট্রিটমেন্ট) করা সম্ভব হবে। স্বাস্থ্যনীতি তৈরিতে সাহায্য করবে জিন-তথ্য ভান্ডারটি।’’ এ প্রসঙ্গে গবেষণায় যুক্ত আর এক বিজ্ঞানী নিধান বিশ্বাস জানান, সংগৃহীত সমস্ত তথ্য ফরিদাবাদের ‘রিজিওনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি’কে দেওয়া হয়েছে। দেশের যে কোনও প্রান্তে যে কেউ এই তথ্যভান্ডার ব্যবহার করতে পারবেন। তাঁর কথায়, ‘‘এর জন্য সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়েছে। ১৮ কোটি ডিএনএ ভেরিয়েন্টের জিন তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে দারুণ সাফল্য।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)