ছবি-শাটারস্টক।
মানসিক চাপজনিত ভয়ঙ্কর একটি রোগ সারানোর পথ দেখালেন বাঙালি বিজ্ঞানীরা। রোগটির নাম ‘পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)’।
যে রোগে বহু মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভেঙে পড়ার ঘটনা চোখে দেখার পর। আফ্রিকার দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ ও ইরাক, সিরিয়ায় জঙ্গি সন্ত্রাসের ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী হওয়ার পরেও যে রোগে আক্রান্ত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে থেকেও এই ভয়ঙ্কর মানসিক চাপজনিত রোগে আক্রান্ত হন অনেকেই।
এই মানসিক চাপজনিত রোগ হলেই আমাদের দেহে কর্টিজল হরমোনের মাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। অথচ, দেখা গিয়েছে, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে থাকা কোনও রোগীর অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা দূর করতে যদি কর্টিজল দেওয়া হলে তা হলে তাঁর পিটিএসডি-তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
এটা কেন হয়? তার উত্তর এত দিন পাওয়া যাচ্ছিল না।বাঙালি বিজ্ঞানীদের কৃতিত্ব, তাঁরা সেই জটিল ধাঁধার জট খুলে ফেলেছেন। দেখিয়েছেন, কেন ‘বিষ’ দিয়েই ‘বিষক্ষয়’ হয়!
এর ফলে এই ভয়ঙ্কর রোগ সারানোর আরও কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কারের পথ এ বার খুলে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
অভিনব গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে ‘নেচার’ গ্রুপের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল- ‘নিউরোসাইকোফার্মাকোলজি’তে। গত সপ্তাহে। গবেষণাটি হয়েছে বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (এনসিবিএস)’-এর অধ্যাপক ও ‘সেন্টার ফর ব্রেন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিপেয়ার’-এর অধিকর্তা সুমন্ত্র (সোনা) চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণাগারে। গবেষকদলের অন্যতম সদস্য এনসিবিএস-এর প্রবহন চক্রবর্তী ও পোস্ট ডক্টরাল গবেষক সিদ্ধার্থ দত্ত। প্রবহন এখন ফ্রান্সের মতঁপেলিয়ারে ‘ইনস্টিটিউট অব ফাংশনাল জিনোমিক্স’-এর গবেষক। গবেষকদলের আরও এক সদস্য ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রুস ম্যাকওয়েন। যিনি জানুয়ারিতে প্রয়াত হয়েছেন।
গবেষণাপত্র ও চার গবেষক: (বাঁ দিক থেকে) সিদ্ধার্থ দত্ত, প্রবহন চক্রবর্তী, সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায় ও ব্রুস ম্যাকওয়েন।
পিটিএসডি কী? কতটা ভয়ঙ্কর?
খুব ভয়ঙ্কর কোনও ঘটনা বা অস্বাভাবিক মাত্রার কোনও মানসিক চাপের সাক্ষী হওয়ার পর থেকে শুরু হয় এই পিটিএসডি। তা সে যুদ্ধ হতে পারে। হতে পারে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভেঙে পড়ার মতো কোনও ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। ধর্ষিতাদেরও অনেকেই আক্রান্ত হন এই রোগে। হতে পারে কোনও খুনের ঘটনার সাক্ষী হওয়ার পর। এমনকী, হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে থেকেও এই ভয়ঙ্কর মানসিক চাপজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন রোগী।
যত দিন যায়, ততই এই রোগ গ্রাস করে রোগীকে। রোগীর ব্যবহারে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। রোগীর ভয়, উদ্বেগ আর অনিদ্রা খুব বেড়ে যায়। যার প্রভাব রোগীর উপর থেকে যায় দীর্ঘ দিন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফেরা বহু সেনা আক্রান্ত হয়েছেন এই রোগে। আফ্রিকার দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ ও ইরাক, সিরিয়ায় জঙ্গি সন্ত্রাসের ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী হওয়ার পরেও বহু মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এই রোগে।
‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রি’র একটি গবেষণাপত্র বলছে, লাতুর ভূমিকম্পের পর এলাকার ২৩ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন পিটিএসডি-তে। আর ১৯৯৯ সালে ওড়িশার সুপার সাইক্লোনের পর পিটিএসডি-তে আক্রান্ত হয়েছিলেন এলাকার ৪৪.৩ শতাংশ মানুষ।
এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে দেখা যায়, কর্টিজল হরমোন (একটি ‘স্টেরয়েড’) দেওয়া হলে পিটিএসডি থেকে সারিয়ে তোলা যায় রোগীকে। কিন্তু রোগী কেন সেরে উঠছেন, তা বুঝে ওঠা কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি। আমাদের দেহের কোথায় কী ভাবে এই রোগের উৎপত্তি হচ্ছে, তা জানা যায়নি বলে।
বাঙালি গবেষকদের কৃতিত্ব, তাঁরাই প্রথম দেখালেন, এই রোগের উৎপত্তির সময় আমাদের মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ ‘অ্যামিগডালা’য় কী কী পরিবর্তন ঘটে। অ্যামিগডালাই আমাদের ভয়, রাগ, আনন্দ, দুঃখ, অভিমান, সব রকমের অনুভূতির প্রাণকেন্দ্র।
বিষে বিষে বিষক্ষয়!
একটি অত্যন্ত জটিল ধাঁধার জটে এত দিন আটকে ছিলেন বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা। সুমন্ত্রের কথায়, ‘‘দেখা গিয়েছে, পিটিএসডি রোগীর শরীরে কর্টিজল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায় অস্বাভাবিক ভাবে। এ বার সেই রোগীর অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা কমাতে যদি তাঁকে কর্টিজল দেওয়া হয়, তা হলে সেরে উঠছেন সেই পিটিএসডি রোগী। যে ‘বিষ’ (কর্টিজল)-এর জন্য এই ভয়ঙ্কর রোগ, সেই ‘বিষ’ দিলে পিটিএসডি রোগী কী ভাবে সেরে উঠছেন, সেটাই এত দিন কারও বোধগম্য হচ্ছিল না।’’
বাঙালি গবেষকরাই প্রথম দেখালেন, কেন ও কী ভাবে এই বিষ দিয়ে বিষক্ষয় হয়। তাঁরা এটাও প্রথম দেখালেন, এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার এমনকী, ২৪ ঘণ্টা পর কর্টিজল দেওয়া হলেও সেরে উঠছেন রোগী।
কী ভাবে চালানো হয়েছে গবেষণা?
প্রবহন জানাচ্ছেন, মানসিক চাপজনিত রোগের ‘মডেল’ হিসাবে গবেষণাগারে প্রথমে ইঁদুরদেরর উপর তীব্র মানসিক চাপ তৈরি করা হয়। আগের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এমন ভয়ঙ্কর ঘটনার পরপরই ইঁদুরের আচার, আচরণে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না। অস্বাভাবিকতা দেখা যায় ঘটনার ১০ দিন পর। এর পর আমাদের যে ভাবে চিকিৎসা করা হয়, সেই ভাবেই মানসিক চাপের ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর পানীয় জলের সঙ্গে কর্টিজল মিশিয়ে খেতে দেওয়া হয় কয়েকটি ইঁদুরকে। আর বাকি কয়েকটি ইঁদুরকে দেওয়া হয় শুধুই পানীয় জল। তাতে কর্টিজল মেশানো হয়নি।
কী দেখা গেল পরীক্ষায়?
সুমন্ত্র জানাচ্ছেন, যে ইঁদুরগুলিকে কর্টিজল মেশানো জল খাওয়ানো হয়েছিল, প্রচন্ড মানসিক চাপের অভিজ্ঞতার ১০ দিন পরেও তাদের আচার, আচরণে (যা পিটিএসডি রোগের উপসর্গের সঙ্গে মিলে যায়) কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। তারা ১০ দিন পরেও স্বাভাবিক আচরণ করেছে। একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করতেও দ্বিধা করেনি।
কিন্তু যে ইঁদুরগুলিকে শুধুই জল খাওয়ানো হয়েছিল, সেগুলি ১০ দিন পরেই পিটিএসডি-তে আক্রান্ত হয়েছে। এমনকী, অন্য ইঁদুরের সঙ্গে মেলামেশা করতেও ভয় পাচ্ছে।
প্রবহনের কথায়, ‘‘দেখেছি, প্রচণ্ড মানসিক চাপ বা ‘স্ট্রেস’-এর ২৪ ঘণ্টা পরেও ইঁদুরদের কর্টিজল মেশানো জল খাওয়ালে পিটিএসডি হচ্ছে না। আগে জানা ছিল, ঘটনার ১ ঘণ্টার মধ্যেই কর্টিজল দিতে হয়। আমরাই প্রথম দেখালাম, মানসিক চাপের ২৪ ঘণ্টা পরেও কর্টিজল দেওয়া হলে তা ইঁদুরদের রোগ নিরাময়ে কার্যকরী হয়।’’
যা হচ্ছে, অ্যামিগডালায়
সুমন্ত্র জানাচ্ছেন, গবেষকরা দেখেছেন, কোনও ভয়ঙ্কর ঘটনার পর মস্তিষ্কে যাবতীয় অনুভূতির প্রাণকেন্দ্র অ্যামিগডালার চেহারা, চরিত্র, গঠনে কিছু রদবদল ঘটে। আর ১০ দিন পর তা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যাতে পিটিএসডি-তে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তার পর সেই রোগ উত্তরোত্তর বেড়ে চলে।
আরও পড়ুন- ভয়ঙ্কর স্মৃতি মুছে ফেলার পথ দেখালেন শান্তিনিকেতনের সোনা
আরও পড়ুন- আজীবন অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী
‘‘আমরাই প্রথম দেখালাম, ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর কর্টিজল দেওয়া হলে ১০ দিন পর আর পিটিএসডি-তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকছে না’’, বলছেন সুমন্ত্র।
পিটিএসডি কী ও কেন? বুঝে নিন ভিডিয়োয়
এ বার প্রয়োজন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল
কলকাতার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বলছেন, ‘‘কাজটা ইঁদুরের উপরে হলেও এই প্রথম জানা গেল, ওষুধ প্রয়োগের জন্য মস্তিষ্কের মূল কোন অংশটিকে টার্গেট করতে হবে। এটাও জানা গেল, প্রচণ্ড মানসিক চাপের ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরেও কোনও ওষুধ পিটিএসডি কমানোর সহায়ক হতে পারে। তবে এই কাজটা এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানুষের উপর পরীক্ষা করে দেখতে হবে। চালাতে হবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও। সেখানেও সফল হলে পিটিএসডি রোখার জন্য অনেক কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কারের পথ খুলে যাবে।’’
একই অঙ্গে দুই রূপ!
ইংল্যান্ডের রেডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সত্যিই খুব আশ্চর্যজনক। কোনও দুর্ঘটনা বা কঠিন পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ অনুভব করার সময় মস্তিষ্কে যে ধরনের যৌগিক পদার্থের (‘কেমিক্যাল্স’) নিঃসরণ হয়, ঠিক সেই রকম পদার্থই যে খাওয়ার জলের সঙ্গে মিশিয়ে শরীরে ঢোকালে ২৪ ঘন্টার মধ্যে সম্পূর্ণ উল্টো প্রভাব ফেলতে পারে, এ কথা জানা ছিল না। এই কাজটি নতুন দিগন্ত খুলে দিল ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের জন্য। নতুন কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কারের সম্ভাবনারও ইঙ্গিত দিল।’’
ভীষ্মদেবের প্রশ্ন, ইঁদুরে যা দেখা গিয়েছে, তা কি এ বার মানুষেও দেখা যাবে? এ বার মানুষের উপরেও পরীক্ষা চালিয়ে দেখতে হবে, ২৪ ঘন্টার পরেও যদি এই ‘ট্রিটমেন্ট’ করা হয়, তাতে কি মানসিক চাপের প্রভাব কমে যাবে?
ভারতে স্নায়ুবিজ্ঞান ও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষার শীর্ষ কেন্দ্র বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেল্থ অ্যান্ড নিউরো-সায়েন্সেস (নিমহ্যান্স)’-এর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানাচ্ছেন, এটি একটি উল্লেখযোগ্য ও পথদেখানো গবেষণা।
তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের জানা ছিল, মানসিক চাপের ফলে আমাদের দেহে এক ধরনের স্টেরয়েডের (কর্টিজল) মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়। আর সেই মাত্রা বাড়লে আমাদের মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ করতে শুরু করে। যা কর্টিজলের বেড়ে যাওয়া মাত্রা আবার কমিয়ে আনে। কিন্তু সেই কর্টিজলই বাইরে থেকে শরীরে ঢোকানো হলে মস্তিষ্ক যে উল্টো ভাবে ক্রিয়া করে, সেটা এই গবেষকরাই প্রথম দেখাতে পেরেছেন। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও যদি গবেষকরা সফল হন, তা হলে পিটিএসডি রোখার জন্য নতুন কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কারের দরজাটা খুলে যেতে পারে।’’
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
ভিডিয়ো সৌজন্যে: আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy