Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Science News

ব্যথা লাগবে না ইঞ্জেকশনে? মশার কৌশল শিখে পথ দেখালেন দুই বাঙালি

আমাদের শরীরে যখন মশা হুল ফোটায়, প্রথমে আমরা তা বুঝতেই পারি না। মশা রক্ত খেয়ে উড়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারি। তা হলে কি মশা কোনও বিশেষ কৌশল জানে? যা হুল ফোটানোর সময় আমাদের টের পেতে দেয় না।

ব্যথাহীন ইঞ্জেকশন নিড্ল তৈরির পথে দুই বাঙালি বিজ্ঞানী।

ব্যথাহীন ইঞ্জেকশন নিড্ল তৈরির পথে দুই বাঙালি বিজ্ঞানী।

অরূপকান্তি বেরা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৯:৩৭
Share: Save:

শরীরে সূচ ফোটাতে কার না ভয় লাগে? শিশুরা তো চিল চিৎকার জুড়ে দেয়। কিন্তু জন্মের পর অন্তত দু’তিন বছর ধরে প্রায় নিয়মিতই বিভিন্ন রকমের টিকা দিতে সূচ ফোটাতেই হয় শিশুর শরীরে। আর যাঁরা ইনস্যুলিন নেন, তাঁদেরও বিশেষভাবে তৈরি একটি সূচ (নিড্‌ল) নিয়মিত শরীরে ঢোকাতে হয়।

তাই চিকিত্সকরাও খুব প্রয়োজন না হলে শরীরে সূচ ফোটাতে চান না। যদি এমন সূচ বা ইঞ্জেকশন ব্যবস্থা তৈরি করা যায়, যা একটুও কষ্ট দেবে না বা আপনি বুঝতেই পারবেন না কখন শরীরে ঢুকেছে সূচটি, তা হলে কেমন হয়?

ইঞ্জেকশনে ভয় পাওয়ার সময় আপনি কিন্তু খেয়ালও করেননি, আমাদের বুঝতে না দিয়ে কেউ কেউ হামেশাই ‘সূচ’ ফোটাচ্ছে আমার, আপনার শরীরে। তারা আর কেউ নয়, মশা। আমাদের শরীরে যখন মশা হুল ফোটায়, প্রথমে আমরা তা বুঝতেই পারি না। মশা রক্ত খেয়ে উড়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারি। তা হলে কি মশা কোনও বিশেষ কৌশল জানে? যা হুল ফোটানোর সময় আমাদের টের পেতে দেয় না।

মশার কাছ থেকে শেখা!

মশার সেই কৌশলকে সামনে রেখেই যন্ত্রণাহীন নতুন ইঞ্জেকশন ব্যবস্থা তৈরির পথে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন কয়েকজন বাঙালি বিজ্ঞানী।

কানপুর আইআইটি-র কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক অনিমাংশু ঘটক ও খড়গপুর আইআইটি-র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক সুমন চক্রবর্তী আলাদা আলাদা ভাবে গবেষণা চালিয়েছেন মশার সেই কৌশল বুঝতে। অনিমাংশুর সঙ্গে রয়েছেন তাঁর দুই সহকর্মী কৃষ্ণকান্ত কুন্দন ও সুকুমার লাহা। অনিমাংশু ও তাঁর সহযোগীদের গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘এক্সট্রিম মেকানিক্স লেটার্স’-এ।

আর সুমন তাঁর কাজটি শুরু করেছিলেন জাপানে কানাগাওয়ার তোকাই বিশ্ববিদ্যালের অধ্যাপক কাজুওশি সুচিয়া-র সঙ্গে। এখন সুমন খড়গপুর আইআইটি-তে যন্ত্রণাহীন সূচ তৈরির গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘জার্নাল অফ অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স’-এ ছাপা হয়েছে সুমনদের গবেষণাপত্র।

দু’জনের লক্ষ্য এক হলেও অনিমাংশু ও সুমন আলাদা আলাদা পদ্ধতিতে ইঞ্জেকশনের যন্ত্রণা কমানোর বা নির্মূল করার চেষ্টা করছেন।

মানুষের ত্বকে হুল ফোটাচ্ছে মশা। ফাইল চিত্র।

মশা হুল ফোটালে প্রথমে টের পাই না কেন?

মশা যখন হুল ফোটায় তা আমাদের বুঝতে না পারার অনেকগুলি কারণ রয়েছে।

প্রথমত, মশার হুল খুব সরু।

দ্বিতীয়ত, মশা ‘ভাইব্রেট’ বা কাঁপাতে কাঁপাতে তার হুলটিকে আমাদের শরীরে প্রবেশ করাতে থাকে।

তৃতীয়ত, মশা একই সঙ্গে অনেকগুলি হুল ফোটায়। প্রথমে মনে করা হত, মশা একটি মাত্র হুল ফোটায় আমাদের শরীরে। পরে গবেষণায় দেখা যায়, একটি নয় দু’টি হুল একই সঙ্গে ঢোকায় মশা। আরও পরে গবেষকরা জানান, দু’টি নয়; মশা একই সঙ্গে ছ’টি হুল আমাদের শরীরে ঢোকায়।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে এই কারণগুলির জন্যই মশার হুল ফোটানোর সময় যন্ত্রণা এতটাই অল্প হয় যে, গোড়ার দিকে আমরা তা টের পাই না।

আরও পড়ুন : তিন ‘মহারাক্ষসে’র মধ্যে ধুন্ধুমার লড়াই ব্রহ্মাণ্ডে, এই প্রথম দেখল নাসা

অনিমাংশুর গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়?

ধরা যাক, একটি মোটা সূচকে কোনও বস্তুর মধ্যে ঢোকানো হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যে পরিমাণ বল প্রয়োগ করতে হয়, তা কমে যাবে, যদি সেই মোটা সূচটিকে সরু সরু অনেকগুলি সূচে ভেঙে একসঙ্গে ঢোকানো হয়।

অনিমাংশু পরীক্ষা করে দেখেছেন, একটি সূচকে কোনও বস্তুর মধ্যে ঢোকাতে যে পরিমাণ বল প্রয়োগ করতে হয়, একই মাপের দু’টি সূচকে ঢোকাতে কিন্তু তার দ্বিগুণ বলের প্রয়োজন হয় না। সেই বলের পরিমাণটা হয় একটি সূচ ঢোকানোর বলের ১.৪১৪ গুণ মাত্র।

মশা যখন একই সঙ্গে ছ’টি হুল ফোটায় তখন একটি হুল ফোটাতে যে বল লাগে, তার মাত্র ২.৪৪৯ গুণ বলের প্রয়োজন হয়। যার অর্থ, ছ’টি হুল মশা একসঙ্গে ফোটালেও তা তিনটি হুল ফোটানোর থেকেও কম বল প্রয়োগ করেই সম্ভব হচ্ছে।

অনিমাংশুরা পরীক্ষাগারে কোনও একটি পদার্থের মধ্যে একই সঙ্গে দু’টি সূচ ঢোকানোরও একটি মডেলও বানিয়েছেন।

তবে একাধিক সূচের চেয়েও অনিমাংশুর লক্ষ্য, মশা হুল ফোটানোর সময় যে সেগুলি কাঁপতে কাঁপতে ঢোকায়, সেই কৌশল রপ্ত করে ইঞ্জেকশনের সূচ বানানো।

দেখা গিয়েছে, কোনও বস্তুর মধ্যে সরাসরি কোনও সূচ ঢোকাতে গেলে যে বল প্রয়োগ করতে হয়, তার চেয়ে কম বল লাগে যদি কাঁপতে কাঁপতে সেই সূচটিকে শরীরে ঢোকানো হয়।

অনিমাংশুর লক্ষ্য, বাজারে চালু ইঞ্জেকশনের নিডলগুলির সঙ্গে এমন একটি ‘সিস্টেম’ বা ব্যবস্থা যোগ করা যাতে সেই সূচটি কাঁপতে কাঁপতে শরীরে ঢুকতে পারে। তাতে বল অনেক কম প্রয়োগ করতে হবে। যন্ত্রণাও হবে অনেকটাই কম।

অনিমাংশুর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, একটি সূচকে যদি সরাসরি প্রবেশ করানো হয়, তাতে যে বল লাগে, সেই বল ৬ ভাগের এক ভাগ হয়ে যাবে, যদি সেই সূচটিকে কাঁপতে কাঁপতে ঢোকানো যায় শরীরে।

তবে সূচটি যার মধ্যে ঢোকানো হচ্ছে তার উপাদান, প্রকৃতির উপর অনেকটাই নির্ভর করবে প্রয়োজনীয় বলের পরিমাণ।

বাজার চলতি চার মাপের সূচ।

অনিমাংশু পরীক্ষাটা কী ভাবে করেছেন?

অনিমাংশু পরীক্ষাগারে অনেকটা আমাদের ত্বকের মতোই বিশেষ এক ধরনের ‘জেল’ ব্যবহার করেছেন। তাতে ঢুকিয়েছেন ১.২ মিলিমিটার ব্যাসের একটি সূচ। দেখা গিয়েছে, না কাঁপিয়ে সূচটিকে জেলের মধ্যে ঢোকালে ২.৪ মিলিমিটার থেকে ২.৮ মিলিমিটারের ব্যাসের একটি ছিদ্র তৈরি হয়। আর ১.২ মিলিমিটারের ওই সূচকেই যদি কাঁপতে কাঁপতে জেলের মধ্যে ঢো‌কানো হয়, তা হলে সেই ছিদ্রের মাপটা ১.২ মিলিমিটারের কাছাকাছি থাকবে। তার ফলে, ইঞ্জেকশনের সূচ ফোটালে আমাদের গায়ের চামড়া ও মাংসপেশির মধ্যে তৈরি হওয়া ক্ষতের পরিমাণটা হবে অনেকটাই কম।

অনিমাংশু ‘আনন্দবাজার’কে বলেছেন, ‘‘মশা সাধারণত ২০ থেকে ৩০ হার্জ কম্পাঙ্ক ব্যবহার করে হুল ফোটায়। আমরা দেখেছি, মানুষের শরীরের মতো কোনও উপাদানে সূচ ঢোকানোর সময় যদি ২০ থেকে ৫০ হার্জ কম্পাঙ্ক ব্যবহার করা হয়, তা হলে সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যায়। ক্ষতের পরিমাণ অনেকটা কম হয়। যদিও মানুষের উপর এই পদ্ধতি এখনও প্রয়োগ করা হয়নি।’’

আরও পড়ুন : ১ টাকা খরচেই বাড়িতে বসে সুগার, হিমোগ্লোবিন টেস্ট, যন্ত্র আবিষ্কার খড়গপুর আইআইটি-র

শরীরের বিভিন্ন অংশের জন্য কি প্রয়োজন বিভিন্ন কম্পাঙ্ক?

অনিমাংশুদের লক্ষ্য, সাধারণ একটি ইঞ্জেকশনের সঙ্গে যাতে একটি ‘ভাইব্রেটিং’ যন্ত্র জুড়ে দেওয়া যায়।

সে ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি ধাপ পেরতে হবে। সব মানুষের ত্বকের চরিত্র এক রকম নয়। কারও নরম, কারও একটু শক্ত। কারও ক্ষেত্রে একটু মোটা বা কেউ খুব পাতলা ত্বকের অধিকারী। আবার কোনও একজনের শরীরের বিভিন্ন অংশের ত্বকও আলাদা আলাদা। ফলে, আমাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ওই যন্ত্রণাহীন ইঞ্জেশনের সূচ ফোটানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন কম্পাঙ্কের প্রয়োগ করার প্রয়োজন হবে কি না, সেটাওদেখতে হবে। তবে সার্বিকভাবে এটা পরীক্ষিত সত্য যে কম্পনের সঙ্গে সূচ শরীরে প্রবেশ করালে যন্ত্রণা কম হবে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানী অদিতি চক্রবর্তীও এ ব্যাপারে তাঁর পিএইচডি-র একটি পেপার প্রকাশ করেন ২০১৬ সালে। সেখানে তাঁরা কম্পনের সঙ্গে কোনও বস্তুর মধ্যে সূচ ঢোকালে ঘর্ষণের মাত্রা কম হয় বলে দেখান। তাঁদেরও উদ্দেশ্য ছিল ইঞ্জেকশনের যন্ত্রণাহীন সূচ বানানো। গবেষণাপত্রটি বেরয় আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ এক্স’-এ। তবে অদিতি ও তাঁর সহযোগীরা নির্দিষ্ট কোনও একটি কম্পাঙ্ক নিয়ে কাজ করেননি। তাঁরা বহু কম্পাঙ্কের তরঙ্গ ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু অনিমাংশু খুঁজে বের করেছেন নির্দিষ্ট কোন কম্পাঙ্ক সবচেয়ে বেশি কার্যকর। এটাই অনিমাংশুদের কৃতিত্ব।

অনিমাংশু ঘটক, সুমন চক্রবর্তী, অদিতি চক্রবর্তী (বাঁ দিক থেকে ডান দিকে)

সুমনের লক্ষ্য মাইক্রো নিড্‌ল

যন্ত্রণাহীন ইঞ্জেকশনের যন্ত্রণাহীন সূচ বানানোর জন্য গবেষণা চালাচ্ছেন আইআইটি খড়গপুরেরসুমন চক্রবর্তীও।

তবে তাঁর গবেষণা মূলত ‘মাইক্রো নিড্‌ল’ তৈরি নিয়ে। সেক্ষেত্রে এমন সরু সূচ বানানোর চেষ্টা চলছে, যাতে তা শরীরে ঢোকালে যন্ত্রণা হবেই না বলা চলে।

এই পদ্ধতির সমস্যা কোথায়?

খুব সরু সূচ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হল, এটি ভেঙে যেতে পারে। সুমন ও তাঁর সহযোগীরা এই সমস্যার কথা মাথায় রেখে এমন একটি উপাদান ব্যবহার করছেন যা খুব শক্ত। তাই সুমন মাইক্রো নিডল তৈরির জন্য টাইটেনিয়াম ও টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইড ব্যবহার করেছেন।

স্মার্ট ওয়াচে মাইক্রো নিড্‌ল?

সুমন জানিয়েছেন, এই টাইটেনিয়ামের সূচটিকে এমন একটি স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে, যা সহজেই আমাদের শরীর থেকে রক্ত টেনে নিতে পারবে। রক্তের শর্করার মাত্রা নির্ণয়ের জন্য। সেই সঙ্গে ইনস্যুলিন প্রয়োগের প্রয়োজন হলে তা-ও ঢোকানো যাবে এই সূচের মাধ্যমেই। সুমনদের চেষ্টা এটাকে একটি স্মার্ট ওয়াচের ছোট সিস্টেমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার। যাতে সাধারণ মানুষ সেটা সহজে ব্যবহার করতে পারেন।

যেমন দেখতে হতে পারে মাইক্রো নিড্‌ল যুক্ত স্মার্ট ওয়াচ

বাজারে আনার সমস্যা রয়েছে, তবু...

তবে ওই সিস্টেমটিকে বাজারে আনতে গেলে, এর উত্পাদন খরচ কমাতে হবে। সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

তাই সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, যখন আমি, আপনি এমন এক ধরনের ইঞ্জেকশন ব্যবস্থা বা সূচ পেয়ে যাব, যা আমাদের অজান্তেই শরীরে ওষুধ ঢুকিয়ে দিতে পারবে বা পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য শরীর থেকে টেনে নিতে পারবে রক্ত।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy