অ্যালঝেইমার’স্ ডিজিজে আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্ক। কাজে নেমেছে কুরকুমিন (সবুজ রং)।
আবার কামাল করে দিল আমাদের ঘরের হলুদ! হলুদ যে অনেক মারণ রোগের প্রতিকারক, তা বোধহয় কারও অজানা ছিল না। বিশেষ করে, মস্তিষ্কের বার্ধক্যজনিত রোগ, যেমন- আলঝেইমার’স, পারকিনসন’স বা হান্টিংটন’স-এর মতো দুরারোগ্য রোগ-প্রতিরোধে এর জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু শুধু প্রতিরোধই নয়, আমার-আপনার আলঝেইমার’স ডিজিজ হয়েছে কি না, এ বার এই হলুদ দিয়েই তা নির্ণয় করা যাবে! হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। কিন্তু ভাবছেন, কী ভাবে তা সম্ভব? বিষয়টার একটু গভীরে যাওয়া যাক।
আলঝেইমার’স ডিজিজ হল মস্তিষ্কের এমন একটা বার্ধক্যজনিত রোগ, যাতে রোগী সব কিছু বেমালুম ভুলে যান। ধরুন, রাতে ঘরের দরজা খুলে চাবিটা কোথায় রেখেছেন, সকালে হাজারো চেষ্টা করেও তা মনে করতে পারছেন না। বা, ধরুন, সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতরাশ করেছেন কি না, সেটাও কিছু ক্ষণ পরেই বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। আর এর ভয়াবহ রূপটা কী হতে পারে, জানেন? নিকট আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব এমনকি, নিজের ছেলেমেয়েকেও চিনতে না-পারা।
কেন হয় এমনটা?
দেখা গিয়েছে, মস্তিষ্কের যে জায়গাগুলো আমাদের বুদ্ধি, স্মৃতি বা চিন্তাশক্তির জন্যে দায়ী, সেখানে ‘অ্যামাইলয়েড বিটা প্রোটিন’ (এবিটা) নামে একটা বিশেষ ধরনের প্রোটিন অনেক দিন ধরে জমতে থাকে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ইনিই হলেন আমাদের স্মৃতিবিভ্রমের জন্য আদত খলনায়ক। আমাদের স্মৃতিবিভ্রমের জন্য আসলে কলকাঠি নাড়ে এই প্রোটিনটিই। এই প্রোটিন যখন মস্তিষ্কে বহু দিন ধরে জমতে-জমতে অত্যধিক মাত্রায় পৌঁছয়, তখন তা মস্তিষ্কের ওই বিশেষ জায়গার নিউরোনগুলোকে মেরে ফেলে। যার জেরে সেই ব্যক্তির মনে রাখার ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। তবে এটা সাধারণত একটা নির্দিষ্ট বয়সের (৬০ থেকে ৬৫ বছর) পরেই শুরু হয়।
অ্যালঝেইমার’স ডিজিজ কী? দেখুন সহজে বোঝার ভিডিও।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে হলুদই বা কী করতে পারে?
উত্তর খুঁজতে আমি ও আমার সহযোগীরা প্রাথমিক ভাবে ইঁদুরের মস্তিষ্কে আলঝেইমার’স ডিজিজের উপসর্গগুলি তৈরি করে ওই ইঁদুরগুলোকে কিছু দিন ধরে নিয়মিত হলুদ খাইয়ে যাই। তার পর অত্যাধুনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় ওই ইঁদুরগুলির মস্তিষ্কের কিছু কলা ও কোষ পরীক্ষা করে দেখি যে, ওই হলুদ শুধু যে রক্ত আর মস্তিষ্কের যাবতীয় বাধা পেরিয়ে মস্তিষ্কের কলা ও কোষে পৌঁছেছে তা নয়, ওই ইঁদুরগুলির মস্তিষ্কের মধ্যে যে অত্যধিক পরিমাণে ‘এবিটা’ প্রোটিন জমে রয়েছে, তার সঙ্গেই লেগে রয়েছে সেই হলুদ। আসলে হলুদের মধ্যে ‘কুরকুমিন’ নামে এমন একটি উপাদান রয়েছে, যাদের খুব পছন্দের জিনিস ‘এবিটা’ প্রোটিন। এই প্রোটিনটাই জমে থাকে আলঝেইমার’স রোগীর মস্তিষ্কে। শুধু তাই নয়, এই কুরকুমিন ওই ‘এবিটা’ প্রোটিনের সঙ্গে খুব শক্তপোক্ত বাঁধনও গড়ে তুলতে পারে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি যে সব ‘অ্যামাইলয়েড ডাই’ দিয়ে মস্তিষ্কের কলা ও কোষে ‘এবিটা’ প্রোটিন জমেছে কি না, তা ধরা হয়, তার চেয়ে এই কুরকুমিন অনেক অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী। এমনকী, নিউরোনের ভেতরেও যে ‘এবিটা’ প্রোটিনটা জমে রয়েছে, তাকেও চিহ্নিত করতে পারে হলুদের এই উপাদানটি।
‘এবিটা’ প্ল্যাক্স চিহ্নিতকরণ কুরকুমিন ও ‘এবিটা’ নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি দিয়ে (বাঁয়ে),
ইঁদুরের শরীরে কুরকুমিন প্রয়োগের দু’দিন পর ওই ইঁদুরগুলির মস্তিষ্কের কলার
‘এবিটা’র সঙ্গে কুরকুমিন লেগে রয়েছে (ডান দিকে)।
তির চিহ্ন ‘এবিটা’ প্ল্যাক্সকে নির্দেশ করছে।
----------------------------------------
মজার বিষয় হল, হলুদের এই কুরকুমিন স্বতস্ফূর্ত ভাবে সবুজ আলো বিচ্ছুরণ করতে পারে। তাই কুরকুমিনের এই শক্তিশালী সবুজ আলো বিচ্ছুরণের ক্ষমতা আর ‘এবিটা’ প্রোটিনের প্রতি তার বাড়তি আসক্তি, এই দুই ক্ষমতাকেই কাজে লাগিয়ে এ বার আলঝেইমার’স রোগীর মস্তিষ্কে জমে থাকা ‘এবিটা’ প্রোটিনটিকে সহজে চিহ্নিত করা যাবে। এটাই তুলে ধরেছি আমরা আমাদের গবেষণাপত্রে। এই গবেষণা থেকে আরও একটা জিনিস স্পষ্ট হয়েছে যে, কুরকুমিন মস্তিষ্কের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ‘এবিটা’ প্রোটিনকে ( যেমন, কোর, নিউরাইটিক, ডিফিউজ এবং বার্ন-আউট প্লাক) চিনতে পারে। যা এত দিন অন্য কোনও ‘অ্যামাইলয়েড ডাই’ দিয়ে এতো স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। এমনকী, আলঝেইমার’স রোগীর মস্তিষ্কে সবচেয়ে টক্সিক (বিষাক্ত) যে ‘এবিটা’ প্রোটিনটি রয়েছে, সেই ‘অ্যামাইলয়েড অলিগোমার’কেও বেশ স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করতে পারে এই কুরকুমিন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মস্তিষ্কে ‘এবিটা’ প্রোটিন জমেছে কি না, তা বোঝার জন্য এখন যে অ্যান্টিবডি ব্যবহার করা হয়, তা বেশ ব্যয়বহুল। আর সেই নির্ণয়-পদ্ধতিটিও বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। অন্য দিকে হলুদ অনেক সস্তা। আর তা দিয়ে খুব সহজেই, দ্রুত মস্তিষ্কে ‘এবিটা’ প্রোটিনকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে।
‘এবিটা’র জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডির (লাল রং) মতো কুরকুমিন (সবুজ)।
তা ‘এবিটা’ প্রোটিনের সঙ্গে লেগে রয়েছে। তির চিহ্ন ‘এবিটা’ প্ল্যাককে বোঝাচ্ছে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------
কিন্তু কুরকুমিন দিয়ে এই ‘এবিটা’ প্রোটিনকে সফল ভাবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আসল বাধাটা হল, তার রাসায়নিক চরিত্র। আসলে, কুরকুমিন খুবই ‘লিপোফিলিক’। শরীরের কলা-রসে এটি খুব কম দ্রবীভূত হয়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তা মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছতে পারে না।
তা হলে কী করা যায়?
বিশিষ্ট বিজ্ঞান-জার্নালে প্রকাশিত বাঙালি বিজ্ঞানীর গবেষণাপত্র।
সমাধান খুঁজতে আমরা ইন্ডিয়ানাপোলিসের ‘ভার্দুর সায়েন্স’ নামে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওই সংস্থাটি ‘সলিড লিপিড ন্যানো-পার্টিকলের এর সঙ্গে কুরকুমিনকে যোগ করে বানিয়েছে ‘ন্যানো-কুরকুমিন’। এই ‘ন্যানো-কুরকুমিন’ সাধারণ কুরকুমিনের চেয়ে একটু আলাদা। ‘এবিটা’ প্রোটিনের প্রতি তার আসক্তি সাধারণ কুরকুমিনের চেয়ে অনেকটাই বেশি। তাই ‘এবিটা’ প্রোটিনের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে এটা অনেক বেশি পরিমাণে সবুজ আলো বিচ্ছুরণ করতে পেরেছে। তার ফলে অ্যালঝেইমার’স রোগীর মস্তিষ্কে জমা ‘এবিটা’ প্রোটিনের উপস্থিতি অনেক সহজে ও অনেক দ্রুত ধরতে পেরেছে এই ন্যানো-কুরকুমিন’। এমনকী, ইঁদুরগুলির ওপর পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, এই ‘ন্যানো-কুরকুমিন’ অ্যালঝেইমার’স রোগ-প্রতিরোধে অনেক বেশি কার্যকরী। আশ্চর্যের বিষয় হল, অ্যালঝেইমার’স রোগের উপসর্গযুক্ত ইঁদুরগুলির মস্তিষ্কের কোষ ও কলা কেটে বাইরে যখন এই ‘ন্যানো-কুরকুমিন’ দিয়ে ‘এবিটা’ প্রোটিনকে চিহ্নিত করা হয়, তখন আমরা দেখেছি, এমনকী, এক ন্যানো-মোলার পরিমাণ ‘ন্যানো-কুরকুমিন’ও ওই ‘এবিটা’ প্রোটিনকে চিহ্নিত করতে পেরেছে।
আরও পড়ুন- ক্লাসে কোন আলো পেলে অঙ্কে বেশি মার্কস পেতে পারে স্কুলের ছাত্ররা?
কিন্তু এতো না হয় গেল, ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা। মানুষের মস্তিষ্কের কলা ও কোষ নিয়ে তো আর এতো কাটাকুটি করা চলে না।
তা হলে উপায় কী?
আসলে অ্যালঝেইমার’স রোগীর ক্ষেত্রে এই ‘এবিটা’ প্রোটিনটি শুধুই যে মস্তিষ্কে জমা হয়, তা নয়। চোখের রেটিনাতেও তার উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি আমরা। আর রেটিনায় ‘এবিটা’ প্রোটিনের উপস্থিতি তো মস্তিষ্কে ওই প্রোটিন জমা হওয়ারই প্রতিচ্ছবি। তাই কুরকুমিন খাইয়ে রেটিনা স্ক্যান করেও ধরা যেতে পারে অ্যালঝেইমার’স রোগ। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই অভিনব পদ্ধতি বাস্তবে কতটা কাজে লাগানো যেতে পারে? প্রথমত, যে সব পরিবার অ্যালঝেইমার’স ডিজিজের জিন বহন করছে, বা যাদের ক্ষেত্রে সুদূর ভবিষ্যতে এই রোগের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদেরও প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত করা যাবে।
কুরকুমিন দিয়ে অ্যালঝেইমার’স রোগীর রেটিনায় অ্যামাইলয়েড বিটা প্রোটিন
নির্ণয় (সৌজন্যে: শ’ন ফ্রস্ট, সিডার সিনাই হাসপাতাল, লস এঞ্জেলেস)।
------------------------------------------------------------------------------------------
কিন্তু এতে আখেরে কী লাভ হতে পারে?
সাধারণত বেশির ভাগ অ্যালঝেইমার’স ডিজিজে আক্রান্ত রোগীর রোগ নির্ণয় করা হয় ‘ব্রেন ইমেজিং’ ( এমআরআই, সিটি বা পিইটি বা পেট স্ক্যান) পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে। কিন্তু আধুনিক গবেষণা বলছে, ওই সময়ে রোগীর মস্তিষ্কে যা ক্ষতি হওয়ার, তা তো হয়েই গিয়েছে। কারণ, এই রোগের লক্ষণ ধরা পড়ার বহু আগেই (২০ থেকে ৩০ বছর) এই প্রোটিনটি অ্যালঝেইমার’স রোগীর মস্তিষ্কে জমা হতে শুরু করে। সেখানে ‘ব্রেন ইমেজিং’ করে এই রোগ-নির্ণয় করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। তাই সে ক্ষেত্রে কুরকুমিন খাইয়ে রেটিনাল স্ক্যান এ ব্যাপারে অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে। এ ছাড়াও যেখানে সুযোগ রয়েছে, সেখানে ‘পেট’ স্ক্যানে’ কুরকুমিনকে ‘প্রোব’ হিসেবে ব্যবহার করেও অ্যালঝেইমার’স রোগ নির্ণয় করা যেতে পারে।
তা হলে আগামী দিনে হলুদ দিয়ে অ্যালঝেইমার’স রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা কি শুরু হতে চলেছে?
ছবি সৌজন্যে: সেন্ট্রাল মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy