গর্বিত: কোম্পানির নবতম উপহারের সামনে দাঁড়িয়ে সিইও সুন্দর পিচাই । ছবি: এএফপি
কোন মেশিন বানানোর চেষ্টা করছে আইবিএম, ইনটেল, মাইক্রোসফ্ট এবং গুগল? বানাতে কোট কোটি ডলার ঢালছে নাসা, সিআইএ, চিন সরকার, এমনকি আমাজনের মালিক জেফ বেজোস? যা মানুষের হাতে এলে মিটবে অনেক জটিল সমস্যা? অথবা আসবে ব্যাঙ্কিং বা ই-কমার্স ভেঙে পড়ার মতো ভয়ঙ্কর বিপদ? আর, সবচেয়ে বড় কথা, সে মেশিন হাতে এলেও বিজ্ঞানীরা বুঝবেন না তার ভেল্কিবাজি?
এক কথায়, এত সব প্রশ্নের উত্তর: কোয়ান্টাম কম্পিউটার, যা নিয়ে দুনিয়াজুড়ে এখন হইচই। কারণ, তা নাকি তৈরি হয়ে গিয়েছে। কে আগে বানিয়ে ফেলবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, তা নিয়ে গত দু’দশক ধরে চলছিল এক রুদ্ধশ্বাস কম্পিটিশন। সে প্রতিযোগিতায় নাকি ফার্স্ট হয়েছে গুগল। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে যে ‘নেচার’ জার্নাল, তাতে ৭৮ জন বিজ্ঞানী এক পেপার লিখেছেন। পেপারের নির্যাস স্পষ্ট। ওঁরা কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানিয়ে ফেলেছেন।
কম্পিউটার তো আমরা সবাই সব সময় দেখছি বা ব্যবহার করছি। অনেকের পকেটে যে স্মার্টফোন, তা-ও তো আদতে অত্যাধুনিক কম্পিউটার। যতই স্মার্ট হোক আজকের কম্পিউটার, তা কিন্তু কাজ করে— স্মৃতিতে তথ্য ভরে রাখা বা গণনা করতে করতে এগিয়ে যাওয়া— যুক্তি দিয়ে। যুক্তি মানে প্রশ্নের উত্তর। হ্যাঁ কিংবা না। যন্ত্র তো যুক্তি বোঝে না, বোঝে ইলেকট্রিক সুইচের অন কিংবা অফ। অন যদি ১ হয়, অফ তবে ০। এ ভাবে ১ আর ০ ব্যবহার করে যে কোনও সংখ্যা লেখা যায়। ১=০০; ২=০১; ৩=১০; ৪=১১;...। ওই যে সুইচের অন বা অফ দশা—১ বা ০ — ওটাকে তথ্যপ্রযুক্তির পরিভাষায় বলে ‘বিট’। এখনকার কম্পিউটার তথ্য নাড়াচাড়া করতে ও ভাবেই ইলেকট্রিক সুইচের অন-অফ (১-০) ব্যবহার করে।
ই-ব্যাঙ্কিং কি ভেঙে পড়বে
ই-ব্যাঙ্কিং বা ই-কমার্স এখন দাঁড়িয়ে আছে স্রেফ যৌগিক আর মৌলিক সংখ্যার ওপর। দুই মৌলিক সংখ্যা ১৯ এবং ৩১। ওদের গুণফল যে যৌগিক সংখ্যা, তা কত? ৫৮৯। ১৯ এবং ৩১ থেকে ৫৮৯ পাওয়া সহজ। কিন্তু ৫৮৯ থেকে ১৯ এবং ৩১ খুঁজে পাওয়া? তা সময়সাপেক্ষ। কেননা ৫৮৯-কে সমানে ভাগ করে যেতে হবে ২, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩, ১৭ ইত্যাদি পর পর মৌলিক সংখ্যা দিয়ে। ১৯-এ এসে দেখা যাবে, ওই মৌলিক দিয়ে ৫৮৯ বিভাজ্য। ৫৮৯ ছোট একটা যৌগিক সংখ্যা বলে কিছুটা হয়তো তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে ১৯ এবং ৩১। ৫৮৯ তো মাত্র তিন অঙ্কের সংখ্যা। যৌগিক সংখ্যাটি ৩০০ বা ৪০০ অঙ্কের হলে তার মৌলিক উৎপাদক খুঁজে বের করতে সুপার কম্পিউটারেরও হাজার হাজার বছর লাগে।
ওই যে প্রকাণ্ড যৌগিকের মৌলিক উৎপাদক বের করতে সময় লাগে— ওটাই ই-ব্যাঙ্কিং বা ই-কমার্সের মূলে। ব্যাঙ্ক বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জানে যৌগিক সংখ্যা। গ্রাহক তার পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে জানে সে যৌগিকের মৌলিক উৎপাদক। শ্যাম রামের অ্যাকাউন্টে ঢুকতে বা তাঁর কেনা মাল হাতাতে পারে না শুধু এই কারণে যে, যৌগিকের মৌলিক উৎপাদক সে জানে না। খুঁজে বের করতে শ্যামের লাগবে হাজার হাজার বছর।
এখন, কোয়ান্টাম কম্পিউটারে যে হেতু অনেক গণনা এক ধাপে করে ফেলা যায়, সে হেতু তা মানুষের হাতে এসে গেলে ই-ব্যাঙ্কিং এবং ই-কমার্স ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
সে সর্বনাশের থেকে পরিত্রাণের উপায় সন্ধান এখন কেড়ে নিয়েছে বিজ্ঞানীদের রাতের ঘুম।
আর কোয়ান্টাম কম্পিউটার? এখনকার কম্পিউটারের তুলনায় তা প্রায় অসীম ক্ষমতাবান। ক্ষমতার উৎসে ওই কোয়ান্টাম। কী ভাবে? তা হলে বলতে হয় এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর কথা। রিচার্ড ফিলিপ ফাইনম্যান। যিনি ১৯৮১ সালের মে মাসে ক্যালটেক-এ এক বক্তৃতায় প্রথম (অবশ্য, কারও কারও মতে, আইডিয়াটার জনক বিজ্ঞানী পল বেনিয়ফ; কৃতিত্ব কার, সেটা চুলচেরা বিশ্লেষণের ব্যাপার) কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির প্রস্তাব দেন। পরের বছর ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব থিয়োরেটিক্যাল ফিজিক্স’-এ ছাপা হয় সেই বক্তৃতা। ‘সিমুলেটিং ফিজিক্স উইথ কম্পিউটরস’। কম্পিউটারে ফিজিক্সের অনুকরণ। কোন ফিজিক্স? অবশ্যই কোয়ান্টাম ফিজিক্স। যা কিনা আদ্যন্ত অদ্ভুতুড়ে।
কতটা? কোয়ান্টাম নিশ্চিত করে কোনও কিছু বলে না। বলে শুধু সম্ভাবনার কথা। কোনও কিছু ঘটতে পারে, আবার না-ও পারে। কোনও কণা কোথাও থাকতে পারে, আবার না-ও পারে। কোথায় কখন থাকার সম্ভাবনা কতটা, সেটুকুই কেবল বলা যায়। আসলে, কণাটা এক জায়গায় এক দশার বদলে থাকে অনেক জায়গায় অনেক দশায়। তা হলে শনাক্ত করলে কণাটা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ধরা দেয় কেন? শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া নাকি কণাটাকে ওই জায়গায় থাকতে বাধ্য করে। যাহ্ বাবা! আমাদের চার পাশের জগতে আমরা এ রকমটা দেখি না। দেখি বা না-দেখি, কোনও কিছু কখনও কোথায় আছে অথবা নেই, তার মাঝামাঝি কিছু আবার হয় নাকি? বলা হয়, আমাদের জগতে নাকি বস্তু বড়সড়, তাই ও রকম দেখা যায় না। কণাদের রাজ্যে নাকি ও রকমটাই দস্তুর।
কোয়ান্টামের জগৎটা কত অদ্ভুতুড়ে, তা বোঝাতে বিজ্ঞানী আরউইন শ্রয়েডিংগার আমাদের এক পরীক্ষার কথা ভাবতে বলেছিলেন। ধরা যাক, একটা ডালাবন্ধ বাক্সের মধ্যে রয়েছে চারটে জিনিস। কিছু তেজস্ক্রিয় পদার্থ, একটা হাতুড়ি, পটাশিয়াম সায়ানাইড-ভর্তি শিশি এবং একটা বেড়াল। এমন ব্যবস্থা, যাতে একটা কণা তেজস্ক্রিয়তা ছড়ালেই হাতুড়ির ঘা পড়বে শিশিতে। তা ভেঙে পটাশিয়াম সায়ানাইড ছড়াবে বাক্সে। মরবে বেড়াল। এখন, কণা থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো কোয়ান্টামের ব্যাপার। হতেও পারে, না-ও পারে। মানে, সম্ভাবনা ৫০-৫০। সম্ভাবনার খেল। হাতুড়ির ঘা শিশিতে পড়তে পারে, না-ও পারে। পটাশিয়াম সায়ানাইড বন্ধ বাক্সে ছড়াতে পারে, না-ও পারে। বেড়াল মরতে পারে, না-ও পারে। সুতরাং, কোয়ান্টাম ফিজিক্স অনুযায়ী, বন্ধ বাক্সে একটা থেকে দুটো বেড়াল। একটা জ্যান্ত, অন্যটা মরা। আর, বাক্সের ডালা খুললে? তখন দুটো থেকে ফের একটা। হয় জ্যান্ত অথবা মরা।
কম্পিউটার কোয়ান্টাম ফিজিক্সের নিয়ম মেনে কাজ করলে ওই একসঙ্গে জ্যান্ত এবং মরা বেড়ালের মতো সুইচ অন অথবা অফ-এর বদলে একসঙ্গে অন এবং অফ দুই অবস্থাতেই থাকবে। ফলে, ১ আর ০ দিয়ে চার বারে যে চারটে ধাপের কথা আগে বলেছি (০০, ০১, ১০ এবং ১১), তার সবগুলো দশা এক ধাপেই কোয়ান্টাম কম্পিউটারে সম্ভব হবে। ধরা যাক, সাধারণ কম্পিউটারে তিনটে সুইচ। তো, ওই যন্ত্রে কোনও ধাপে সুইচগুলোর একটা দশা যদি ১০১ হয়, তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ওই এক ধাপে সুইচগুলোর দশা হতে পারে একটার বদলে আটটা (০০০, ০০১, ০১০, ১০০, ১০১, ১১০, ০১১ এবং ১১১)। তিন সুইচওয়ালা সাধারণ কম্পিউটার যে কাজ করবে আট ধাপে, তা কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেরে ফেলবে মাত্র এক ধাপেই। বোঝা যাচ্ছে, সুইচের সংখ্যা বাড়লে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে কোয়ান্টামের কম্পিউটারের কর্মক্ষমতা। প্রসেসরের মধ্যে জায়গার অভাবে সুইচের সংখ্যা বাড়ানো ক্রমেই কঠিন হচ্ছে বলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানো জরুরি হচ্ছে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার তার ভেল্কি দেখাবে কী করে? কেমন করে তা করবে এক ধাপে একসঙ্গে অনেক ধাপের কাজ? উত্তর জানে না কেউ। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডেভিড ডয়েশ দিয়েছেন এক ব্যাখ্যা। ওঁর মতে, কাজ করার সময় কোয়ান্টাম কম্পিউটার এক থেকে হয়ে যায় বহু। এক-এক কম্পিউটার এক-এক ব্রহ্মাণ্ডে। নির্দিষ্ট একটা ব্রহ্মাণ্ডে কম্পিউটার সামলায় এক ধাপ। ও ভাবে বহু ব্রহ্মাণ্ডে বহু ধাপ। এ ভাবে বহু ধাপ একসঙ্গে। এ ভাবে আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ড শাখাপ্রশাখা মেলে বহু বহু ব্রহ্মাণ্ডে পরিণত হওয়া আজগুবি শোনালেও, তা বিশ্বাস করেন অনেকে। নানা কারণে এখন বহু বিশ্বের আইডিয়া এসে পড়ছে। বিজ্ঞান সত্যিই বিচিত্র!
ব্যাখ্যায় দরকার কী, কাজ হলেই হল। ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখছি, গুগল-নির্মিত কোয়ান্টাম কম্পিউটার কাজ করেছে ৫৩টা বিট নিয়ে। অতগুলো বিট ২০০ সেকেন্ডে এত ধাপ এগিয়েছে, যে পরিমাণ এগোতে সুপার কম্পিউটারের লাগত ১০,০০০ বছর! কর্মদক্ষতায় এই যে সাধারণ কম্পিউটারকে টপকানো, একেই ২০১১ সালে বিজ্ঞানী জন প্রেসকিল বলেছিলেন ‘কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি’। ওই লক্ষ্যেই সবাই ছুটছে। কী এমএনসি, কী সদ্যজাত স্টার্টআপ। বিনিয়োগ? বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। কোয়ান্টাম কম্পিউটার সোনার খনি যে। তাই শুরু হয়েছে এক গোল্ড রাশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy