কোটি কোটি বছর আগে এই ভারত ভূখণ্ডই ছিল ভয়ঙ্কর ডাইনোসরদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের জায়গা।দাপিয়ে বেড়ানোর জন্য।
মুনি, ঋষি, বেদ, পুরাণের এই দেশকেই, ক্রেটেশিয়াস যুগে তাদের প্রজননের জন্য সবচেয়ে বড় ওর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিল ডাইনোসররা।
দেখুন গ্যালারি- দাক্ষিণাত্যে আবিষ্কৃত ডাইনো-যুগ
সাড়ে ৬ কোটি থেকে ৬ কোটি ৭০ লক্ষ বছর আগে, পৃথিবীর সেই আদিম ক্রেটেশিয়াস যুগে মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের সুবিস্তীর্ণ এলাকাই ছিল গোটা বিশ্বে ডাইনোসরদের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র আর প্রিয়তম বিচরণ ভূমি।
এক সময় যাকে দাক্ষিণাত্য বলা হতো, ‘উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগে’, নর্মদা, মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী নদীর সুবিস্তীর্ণ উপকূল, পূর্বঘাট পর্বতমালার পাদদেশ ও তার সংলগ্ন সুবিশাল এলাকা আর পশ্চিম কচ্ছ উপকূল ঘেঁষা গুজরাতের একটি বড় অঞ্চলকেই তাদের প্রজননের জন্য, শিশুদের বেড়ে ও বড় হয়ে ওঠা আর তাদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য বেছে নিয়েছিল ডাইনোসররা। আশ্রমিক শান্তি আর আধ্যাত্মিক সভ্যতা-সংস্কৃতির এই ভারত ভূখণ্ডকেই কোটি কোটি বছর আগে তাদের ও তাদের শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা বলেই বেছে নিয়েছিল ডাইনোসররা।
দাক্ষিণাত্যে হদিশ মেলা ডাইনোসরের পায়ের ছাপ।
দাক্ষিণাত্যে হদিশ মেলা ডাইনোসরের ডিমের জীবাশ্ম।
লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর অ্যাডভান্স্ড স্টাডিজ ইন জিওলজি’র এমেরিটাস অ্ধ্যাপক, বিশিষ্ট ভূতত্ববিদ এই দাবি করে জানিয়েছেন, ‘‘২০১১-র এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের একটি সুবিস্তীর্ণ এলাকায় খনন ও অনুসন্ধান চালিয়ে ক্রেটেশিয়াস যুগের ডাইনোসরদের ডিমের প্রচুর জীবাশ্মের হদিশ মিলেছে। শাকাহারী (Harbivorous) ও মাংসাশী (Carnivorous)- দু’ধরনের ডাইনোসরের কম করে শ’খানেক প্রজাতির ডিমের জীবাশ্মের সন্ধান মিলেছে ওই সুবিস্তীর্ণ এলাকায়।পাওয়া গিয়েছে প্রায় দু’হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ডাইনোসরদের ‘বাসা’ (Nest)-রও সন্ধান।ডাইনোসরদের এত বড় বাসা পৃথিবীর আর কোথাওই মেলেনি এত দিন। ওই বাসা থেকেই পাওয়া গিয়েছে হাড়গোড়, খুলি, কঙ্কালের জীবাশ্মও।’’
দাক্ষিণাত্যে হদিশ মেলা ডাইনোসরের ডিমের জীবাশ্ম।
ঠিক কোন কোন এলাকায় ছিল ক্রেটেশিয়াস যুগে ডাইনোসরদের প্রজননের জায়গাগুলি?
সম্প্রতি কলকাতায় সফর করে যাওয়া বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ সাহানি এক একান্ত সাক্ষাৎকারে আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, ‘‘এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল কচ্ছ উপকূল। নর্মদা নদীর পূর্ব পাড় থেকে মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর পর্যন্ত এলাকা। নাগপুরের দক্ষিণাংশে একটি বিস্তীর্ণ এলাকা। যাকে ‘ডেকান ট্র্যাপ’ বলে, সেই মহারাষ্ট্র লাগোয়া মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যা আরব সাগর থেকে অনেকটাই দূরে। ডাইনোসরদের বাসা ছিল আরও দক্ষিণে- তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও।’’
আরও পড়ুন-কচ্ছে মিলল ডায়নোসরের ডানার জীবাশ্ম
সেই আদিম ক্রেটেশিয়াস যুগে কেমন ছিল ডাইনোসরদের বৃহত্তম প্রজনন ক্ষেত্রের প্রকৃতি ও আবহাওয়া?
ভূতত্ত্ববিদ সাহানি জানাচ্ছেন, ‘‘খুব গরম। অগ্নিগর্ভ। যেন অসম্ভব গরম একটা কড়াই। ছিল প্রচুর জীবন্ত আগ্রেয়গিরি। সেই সব আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে দিন-রাত বেরিয়ে আসত গনগনে লাভাস্রোত। কুচকুচে কালো ধোঁয়া। যার ফলে, বাতাসে প্রতিনিয়তই মিশত কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস। সেই উত্তপ্ত লাভাস্রোত, আগুন আর ধোঁয়ায় জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যেত বিস্তীর্ণ, গহন বনাঞ্চল। তবু যেহেতু ওই এলাকায় ছিল প্রচুর নদী আর হ্রদ, তাই মূলত, তার ভরসাতেই ওই সব এলাকায় বসতি গড়ে উঠেছিল ডাইনোসরদের। যেখানে শাকাহারী ডাইনোসরদের একটি প্রজাতি ‘টিট্যানোসরাস’দের দাপাদাপিই ছিল সবচেয়ে বেশি। যারা বিশাল বিশাল গাছ খেয়ে বাঁচত। মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের ওই সুবিস্তীর্ণ এলাকায় ‘টিট্যানোসরাস’দের ডিমের জীবাশ্মের হদিশ মিলেছে সর্বাধিক। ডাইনোসরদের বাসায় বড় বড় গুহার মতো গর্তে (Cave) এক সঙ্গে থাকা ১২/১৪টি ডিমের জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে। ডিমগুলোর বাইরের খোলটা খুবই শক্তপোক্ত। যা লোহার আঘাতেও ভাঙে না। প্রায় গোলাকৃতি সেই ডিমের ব্যাস গড়ে ১৬ থেকে ২০ সেন্টিমিটার। ওই এলাকায় একই সঙ্গে মিলেছে কিছুটা লম্বাটে, কিছুটা উপবৃত্তাকার ডিমের জীবাশ্মও। সেগুলো মাংসাশী ডাইনোসরের। তাদের আশপাশে মিলেছে সুবিশাল টিকটিকি, গিরগিটি এমনকী, কুমিরের ডিমের জীবাশ্মও। যাদের হদিশ মিলেছে আগ্নেয়গিরির দু’টি লাভাস্রোতের মাঝামাঝি স্তরে বা একেবারে নীচে। বোঝা যাচ্ছে, নিরাপত্তার জন্য তাদের বাসায় নরম মাটি বা বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে বা বড় বড় গুহার মধ্যে ডিমগুলোকে রেখে দিত ডাইনোসররা।’’
ক্রেটেশিয়াস যুগে ডাইনোসরদের বিচরণ ক্ষেত্র।অধুনা রাজামুন্দ্রির কাছে।
কীসের ভয়ে?
সাহানি জানাচ্ছেন, ‘‘তা না হলে ডাইনোসরদের ডিমগুলো খেয়ে ফেলত ‘ড্রায়োসরাস’ নামে দৈত্যাকার প্রজাতির কুমিররা। ওই কুমিররাও ডেরা বাঁধত ডাইনোসরদের বাসার কাছাকাছি।’’
মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে সদ্য আবিষ্কৃত এলাকাগুলোকে কেন ক্রেটেশিয়াস যুগের ডাইনোসরদের ‘বৃহত্তম বিচরণ ভূমি’ বলা হচ্ছে?
ভারত ভূখণ্ডের যেখানে (লাল চিহ্নিত) ছিল ডাইনোদের স্বর্গ।
বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ সাহানির জবাব, ‘‘মহারাষ্ট্রের খুব ছোট্ট একটা গ্রাম পিস্দুরায় হদিশ মিলেছে ‘টিট্যানোসরাস’ প্রজাতির ডাইনোসরের পেটের জীবাশ্মও। যার নাম-‘কপরোলাইট’। সেই পেটের জীবাশ্মের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, তারা ছিল তৃণভোজী ডাইনোসর।প্রাপ্তবয়স্ক ‘টিট্যানোসরাস’দের যকৃৎ লম্বায় হতো দশ থেকে পনেরো সেন্টিমিটার। ‘টিট্যানোসরাস’দের যকৃতের যত গুলি জীবাশ্মের হদিশ মিলেছে এখনও পর্যন্ত, তার সবগুলোতেই রয়েছে বড় ঘাস বা বৃক্ষের অংশবিশেষ। সবচেয়ে চমকদার ঘটনা হল, দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, কলম্বিয়া, বলিভিয়ায় যে বড় বড় ঘাসের (সাভানা বা পম্পাস) দেখা মেলে, তাদেরও হদিশ পাওয়া গিয়েছে ‘টিট্যানোসরাস’দের যকৃতের জীবাশ্মগুলোর ভেতরে।এর থেকে বোঝা যায়, ক্রেটেশিয়াস যুগে লাতিন আমেরিকা ছিল গন্ডোয়ানাল্যান্ডেই (এক সময়ের দাক্ষিণাত্য যার অংশবিশেষ)। তাই লাতিন আমেরিকার ওই বিশেষ প্রজাতির ঘাস তখন মিলত সেই সময়ের দাক্ষিণাত্যেও। গন্ডোয়ানাল্যান্ডের সেই অখণ্ড ভূখণ্ডের ধারে-কাছে তখন সমুদ্র না থাকায় ডাইনোসররা তখন অধুনা মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের সুবিস্তীর্ণ এলাকা থেকে অনায়াসেই ছুটোছুটি করতে, দাপিয়ে বেড়াতে পারত লাতিন আমেরিকায়। যেন এ-পাড়া থেকে ও-পাড়ায়! তাই ‘ভারতীয়’ ডাইনোসরদের জীবাশ্মের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে তাদের সঙ্গে ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনায় হদিশ মেলা ডাইনোসরদের জীবাশ্মের হুবুহু মিল পাওয়া গিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy