Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

আমের মৌতাতে সাহিত্যের স্মৃতিবিলাস

বাংলা সাহিত্যে যেমন আম নিয়ে গল্পের শেষ নেই, তেমনই লোক-ইতিহাসেও। ফিরে দেখলেন আশিস পাঠকবাংলা সাহিত্যে যেমন আম নিয়ে গল্পের শেষ নেই, তেমনই লোক-ইতিহাসেও। ফিরে দেখলেন আশিস পাঠক

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

ইকনমিক জুয়েলারির অক্ষয় নন্দী তাঁর ছোট মেয়েটিকে নিয়ে বিদেশে গিয়েছেন। ফ্রান্সে এক বৃদ্ধা ছোট মেয়েটিকে একটা আঁটি দেখিয়ে বললেন, এই দেখ তোমাদের ভারতবর্ষের ফলের বিচি যার তুল্য ফল আর জীবনে খাইনি। সেই মেয়েটি, অমলাশঙ্কর বড় হয়ে তাঁর স্মৃতিকথায় সে ফলের বিস্তর গুণগান করেছেন।

আমজনতার ঝুলি থেকে খাস বাদশাহি টুকরি, পরম রমণীয় আমের গল্প বৈশাখের ভোরের হাওয়ার মতোই ছড়িয়ে গিয়েছে সবখানে। পৃথিবীতে আর কোনও ফল এত বিচিত্র রঙে আর চেহারায় ধরা দেয় না এবং আর কোনও ফলই এত বৈচিত্র সত্ত্বেও এমন জোরদার ঐক্যে ভারতীয় হয়ে ওঠেনি।

অবিশ্যি আমের জন্মভূমিকে ভারতের বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলতে একদা চেষ্টার কসুর হয়নি। সে চেষ্টায় আমের উৎস-সন্ধানে হানা দেওয়া হয়েছে একেবারে বর্মায়। এমনকী আরও পুবে, শ্যামদেশ বা তাইল্যান্ড, কম্বোজ এবং মালয়েও আমকে ঠেলে দেওয়ার যারপরনাই চেষ্টা হয়েছে। আর এ সবের মূলে ম্যাঙ্গো শব্দটা। পরে অবশ্য শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে গবেষকেরা দেখিয়েছেন ম্যাঙ্গো শব্দটাই আসলে একটা তামিল শব্দের বদলে যাওয়া চেহারা। তামিল ভাষায় আমকে বলে ‘ম্যান-কে’ বা ‘ম্যান-গে’। তা থেকে পর্তুগিজ ম্যাঙ্গা এবং শেষে ইংরেজি ম্যাঙ্গো। কেবল তাই নয়, ‘সবই ব্যাদে আছে’ বিশ্বাসের দেশেও সত্যি সত্যি দেখানো গিয়েছে যে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে আম স্ব-নামে তো আছেনই, তার ওপর আছে তাঁর কাব্যিক নাম ‘রসাল’।

সুতরাং রস যেখানে, রসালো সেখানে। কানু বিনা যেমন গীত নাই, আম বিনাও রস নাই।

নেই গল্পও। রসালো গল্প। বাংলা সাহিত্যে যেমন আম নিয়ে গল্পের শেষ নেই, তেমনই লোক-ইতিহাসেও। সে সব গল্পের বেশ কিছু আমের নাম-রহস্য নিয়ে। গল্প, এবং গল্প হলেও সত্যি। তেমনই গল্পের সূত্রে আমের রাজা ল্যাংড়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এক খোঁড়া ফকির। ফকির থাকতেন হাজিপুরের একটি আমগাছের তলায়। সে গাছটি আবিষ্কার করেছিলেন পটনার ডিভিশনাল কমিশনার ককবার্ন সাহেব। তার পরে সাড়া পড়ে গেল সে গাছকে ঘিরে। চার দিকে সান্ত্রী-সেপাই, মাঝখানে একটি আমগাছ। শ্রীপান্থ লিখেছেন সে গল্প, ‘বোধিদ্রুমের প্রতিটি শাখা নিয়ে যেমন কাড়াকাড়ি, তেমনি হাজিপুরের এই আমগাছের ডাল নিয়েও। হাথুয়া, বেতিয়া, দ্বারভাঙ্গা, ডুমরাও-এর মহারাজারা বরং হাজার হাজার টাকার খাজনা হারাতেও রাজি আছেন, কিন্তু হাজিপুরের আমের ডাল নয়।’


ছবিটি পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা, কল্যাণী দত্তের থোর বড়ি খাড়া বইটি থেকে নেওয়া। প্রকাশক: থিমা।

ল্যাংড়ার নেপথ্যে যদি এক ফকির ফজলি তবে এক রমণীর স্মৃতিবিলাস। গৌড়ের পথে বিস্তীর্ণ এক বনের ধারে ছোট একটি কুটির। সেখানে থাকেন একাকী এক মুসলমান মেয়ে। তাঁর উঠোনে তাঁরই মতো একা একটি আমগাছ। জ্যৈষ্ঠের এক দারুণ দাহনবেলায় মালদহের বিখ্যাত কালেক্টর র‌্যাভেনশ সাহেব সেই বনের ভিতর দিয়ে চলেছেন গৌড়ের দিকে। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে সাহেব সেই গাছের তলায় দাঁড় করালেন ঘোড়া। ভয় পেয়ে মেয়েটি তড়িঘড়ি পিঁড়ি পেতে দিলেন। সাহেব জল চাইলেন। শুধু জল কি আর দেওয়া যায়, মেয়েটি তাই দিলেন একঘটি জল আর রেকাবিতে সেই গাছের একটি আম। সাহেব খেতে গিয়ে চমকে উঠলেন। মালদহের কালেক্টর তিনি, আম খেয়েছেন বহু, কিন্তু এমন আম কখনও খাননি। মেয়েটিকে কাছে ডাকলেন, জিগ্যেস করলেন নাম। আর সেই মেয়ের নামেই নাম হয়ে গেল সেই গাছের আমের, ফজলি।

ভালবাসাকে পিঁড়ি পেতে দেওয়ার মতোই আমকেও চিরকাল বড় যত্নে পাতে তুলেছে বাঙালি। থোড় বড়ি খাড়া-য় সেই এলাহি যত্নের আম খাওয়া আর খাওয়ানোর গল্প করেছেন কল্যাণী দত্ত। 'নিজের কিংবা বন্ধুর বাগানের সরেস আম জালতি দিয়ে পাড়িয়ে ঘরে এনে পাতার শ্যেয় শুইয়ে পাশ ফিরিয়ে ফিরিয়ে তোয়ের করা হত। তুলোয় মোড়া চালানি আম থাকত শুধু জামাইমার্কা কুটুমদের জন্যে।' এবং সে আম কাটারও বিধিনিষেধ আছে। লোহার ছুরি কিংবা বঁটি দিয়ে কাটলে দাগ ধরে আমের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, তাই বাখারি কিংবা তাল নারকোলের বালদোর ছুরি দিয়ে কাটতে হবে আম। তার আগে কাঁসার গামলা বা বালতিতে সে সব আমেদের জলক্রীড়া। এক পাত্রে দশ-বারোটির বেশি ভাল আম রাখা যাবে না, রাখলে তাদের আঠা ছাড়বে না। কল্যাণী দত্ত জানাচ্ছেন, বোঁটা কেটে আমের মুখে দাগ দিয়ে রাখা হত গুণমান অনুসারে। এবং তিন নম্বরি আম অর্থাৎ শিলপড়া বা দাগি আম সে কালে গিন্নিরা নাকি কাজের লোকেদের সঙ্গে ভাগ করে খেতেন।

অর্থাৎ দেবভোগ্য আম আমজনতার জন্য নয়। মুর্শিদাবাদের ভুবনভোলানো তুলোয় মোড়া ‘কোহিতুর’ কোনও পুণ্যবান ক্বচিৎ চেখে দেখার সুযোগ পেতেন। কিন্তু সে যুগের নামকরা ভোজনরসিকেরা বেছে বেছে আম খেতেন ও খাওয়াতেন। ভারতচন্দ্র কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তো আছেনই, তালিকায় আছেন খাস কলকাত্তাইয়া কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ললিতকুমার বাঁড়ুজ্যে, রাখালদাস বাঁড়ুজ্জে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, ব্যবসায়ী বটকৃষ্ণ পাল। দেবেন্দ্রনাথ সেনের কবিতা উথলে উঠেছিল একদা, আম্রপ্রেমে, 'মধুর মধুর, যেন পদ্মমধু ভ্রমর ঝঙ্কৃত/কনকিত পাকা আম নিদাঘের সোহাগে রঞ্জিত।' আর রবীন্দ্রনাথের আম্রপ্রেম তো ছড়িয়ে আছে তাঁর রচনাবলি জুড়ে। শিশুশিক্ষার যে-কটা বই তিনি লিখেছেন তার প্রায় সবকটিতেই ফলের নাম মানেই আম। বীথিকা-র নিমন্ত্রণ কবিতায় লিখছেন, ‘বেতের ডালায় রেশমি-রুমাল–টানা/অরুণবরন আম এনো গোটাকত।’

আমকে এমন ভাল না বাসলে সাহিত্যের আসল-নকলের তফাত বোঝাতে গিয়েও কি না রবীন্দ্রনাথের অমিত রায় বলে, “কবিমাত্রের উচিত পাঁচ-বছর মেয়াদে কবিত্ব করা, পঁচিশ থেকে ত্রিশ পর্যন্ত। এ কথা বলব না যে, পরবর্তীদের কাছ থেকে আরো ভালো কিছু চাই, বলব অন্য কিছু চাই। ফজলি আম ফুরোলে বলব না, ‘আনো ফজলিতর আম।’ বলব, ‘নতুন বাজার থেকে বড়ো দেখে আতা নিয়ে এসো তো হে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

mango ashis pathak bengali literature history
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE