পুরোপুরি খাঁটি না হলেও পুরনো দিনের হারিয়ে যাওয়া কিছু রান্না আছে, যা চট করে রেস্তরাঁর মেনুতে আপনি পাবেন না। ছবি: সংগৃহীত
বছরের আর পাঁচটা দিন বাঙালিয়ানা থাকুক আর না-ই থাকুক, নববর্ষের দিন কিন্তু খাঁটি বাঙালি সাজতেই হবে। গত কয়েক বছরে নববর্ষের কয়েক দিন আগে থেকে সমাজমাধ্যম খুললেই শাড়ি আর পাঞ্জাবির রমরমা, রেস্তরাঁগুলিতে নববর্ষ ‘স্পেশাল’ মেনুর বাড়বাড়ন্ত! নববর্ষের দিন রেস্তরাঁর বাইরে সাবেক ধুতি-পাঞ্জাবি, শাড়িতে তরুণ-তরুণীদের লম্বা লাইনে প্রতীক্ষা করার ছবিও চোখে পড়ে। নববর্ষের দিন যে খাঁটি বাঙালি খাবার খেতে হবে। ধুতি-পাঞ্জাবি বা লালপাড় সাদা শাড়ি পরে পুরুষ এবং মহিলারা পরিবেশন করে যাবেন পোলাও- মাংস, মাছের পাতুরি, চাটনির মতো খাঁটি বাঙালি খাবার।
তবে আদৌ কি খাঁটি বাঙালি খাবার বলে কিছু আছে? সত্যি বলতে, কোনও দেশের রন্ধনশৈলী আদি-অকৃত্রিম ধারায় অনাদি কাল ধরে চলে আসছে, এ কথা মোটেই বলা যায় না। বাঙালির খাওয়াদাওয়ার ইতিহাস নিয়ে চর্চা করলে দেখা যাবে, কিছুই আর খাঁটি নেই। এই যে ‘খাঁটি, অকৃত্রিম’ বাঙালি রান্নায় আলু দেওয়া হবে, টম্যাটো দেওয়া হবে, লঙ্কা দেওয়া হবে, এগুলি বাংলার মাটিতে ফলত নাকি? মা-দিদিমার রান্নাতেও এখন রেস্তরাঁর শেফদের ‘ফিউশন টাচ্’! সৌজন্যে অবশ্যই সমাজমাধ্যম!
পুরোপুরি খাঁটি না হলেও পুরনো দিনের হারিয়ে যাওয়া কিছু রান্না আছে, যা চট করে রেস্তরাঁর মেনুতে আপনি পাবেন না। মা-ঠাকুরমাদের হেঁশেলে সেই রান্নার চল থাকলেও এখনকার গৃহিণীরা সেই রান্না ভুলতে বসেছেন। সেই জন্য সময়কে খানিকটা দায়ী করা যায় বটে। ব্যস্ত জীবনে হারিয়ে যাচ্ছে সেই সব রান্নার অতুলনীয় স্বাদ। নববর্ষের দিনে হারিয়ে যাওয়া কিছু সাবেকি রান্নার খোঁজ করল আনন্দবাজার অনলাইন। বাড়ির মা থেকে রেস্তরাঁর শেফ— সকলেই ভাগ করে নিলেন নিজেদের ছেলেবেলার নববর্ষের গল্প। সেই সঙ্গে নিজেদের মায়ের হাতের কিছু হারিয়ে যাওয়া রান্নার প্রণালীও।
৬ বালিগঞ্জ প্লেসের শেফ সুশান্ত সেনগুপ্ত ফিরে গেলেন নিজের ছেলেবেলায়। শেফ বলেন, ‘‘আমরা ছিলাম প্রবাসী বাঙালি। আমার মা ছিলেন ঢাকার মেয়ে। খাঁটি বাঙাল। পশ্চিমবঙ্গে না থাকলেও আমরা কিন্তু দিল্লিতে নিজেদের মতো করেই উদ্যাপন করে নিতাম। মনে পড়ে, মা পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বাড়িতে পায়েস বানাতেন। দুপুরে ডাল, ভাজা, মাছ, মাংসের পদ দিয়ে হত জমিয়ে ভূরিভোজ। তবে বিকেলবেলাটি ছিল ভারী মজার! মা সে দিন ঘুগনি বানাতেন। বিকেলে বন্ধুরা বাড়িতে এলে পায়েস আর ঘুগনি দিয়েই হল বছরের প্রথম দিন উদ্যাপন। মায়ের হাতের রান্নার জবাব নেই। মনে পড়ে মা বানাতেন ছানার ডেভিল। নববর্ষের দিন সন্ধেবেলা ঘুগনির সঙ্গে দারুণ জমত সেই ডেভিল। ছোলার ডালের গোলার বাইরে ছানার মোড়ক। সেই স্বাদ ভোলার নয়। মা ছোলার ডাল সেদ্ধ করে জল ঝরিয়ে নিতেন। কড়াইতে ঘি নিয়ে তাতে কালোজিরে, হিঙের ফোড়ন দিতেন। তার পর আদা কুচি আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে কষিয়ে সেদ্ধ করা ছোলার ডাল, নুন, মিষ্টি দিয়ে শুকনো করে পুর বানিয়ে নিতেন। এ বার ঠান্ডা করে ডিমের কুসুমের মতো গড়ে নিতেন। ছানার সঙ্গে লঙ্কা কুচি, আদা কুচি, নুন আর চিনি দিয়ে ভাল করে মেখে, বড় গোল্লা বানিয়ে তার মধ্যে ছোলার ডালের পুর ভরে অ্যারারুটের মিশ্রণে ডুবিয়ে ছাঁকা তেলে ভেজে তুলতেন। সেই স্বাদ আজও মুখে লেগে রয়েছে।’’
ইউটিউবার মালা ঘোষ। ‘জ়িরোওয়াট’ কিচেন চ্যানেলে অনুরাগীদের সঙ্গে তাঁর অভিনব সব রান্না ভাগ করে নেন তিনি। রান্না করা তাঁর শখ বলা যায়। ফিউশন রান্না করতেই তিনি বেশি ভালবাসেন। মোচা, এঁচোড়, থোড় থেকে শুরু করে উচ্ছের রেজ়ালা, বড় আলু দিয়ে মুরগির লাল ঝোল থেকে বোয়ালের রসা— ছেলেকে সব ধরনের রান্নাই রেঁধে খাওয়ান তিনি। কথায় কথায় মালা বলেন, ‘‘নববর্ষের দিন মা হরেক রকম পদ রাঁধতেন। সকালে কখনও কখনও পান্তাভাত দিয়ে শুরু হত খাওয়াদাওয়া। ছোলা ভেজানো, শসা কুচোনো, পেঁয়াজ কুচোনো, ডিমের অমলেট আর মোটা আলু ভাজা দিয়ে মায়ের হাতে মাখা পান্তা ভাতের স্বাদই আলাদা! দুপুরে থাকত মোচা, থোড়, এঁচোড়ের মতো পদ। বিশেষ কোনও দিনে মা বানাতেন চিংড়ির পুর দিয়ে পটলের দোরমা আর ডুমুরের তরকারি। এখনকার দিনে ডুমুরের স্বাদ ভুলতে বসেছে মানুষ। বাজারেও খুব বেশি মেলে না। তবে মাঝেমাঝে বাজারে দেখা মিললেও মিলতে পারে এই সব্জির। মাকে দেখতাম ডুমুর কেটে আগের দিন রাতে জলে হলুদ দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে। তার পর রান্নার সময় ভাল করে ধুয়ে নুন হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করে নিতেন তিনি। ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর বেশ করে চটকে নিয়ে শুরু হল রান্নার পর্ব। কড়াইতে জিরে, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ছোট ছোট ডুমো করে কেটে রাখা আলু দিয়ে ভেজে তুলে রাখতেন। একটি বাটিতে জিরের গুঁড়ো, লঙ্কার গুঁড়ো, গলুদ গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো জলে গুলে তেলে ঢেলে দিতেন। মশলা ভাল করে কষে এলে নুন, চিনি আর নারকেল কোরা দিয়ে আরও খানিক ক্ষণ রান্না করে সেদ্ধ করা ডুমুর দিয়ে ঢেকে দিতেন। রান্না মাখা মাখা হয়ে এলে ঘি আর গরম মশলা গুঁড়ো ছড়িয়ে গরম ভাতের সঙ্গে পাতে পড়ত সেই তরকারি। স্বাদ আরও বেড়ে যেত নারকেলের বদলে তরকারিতে যদি পড়ত ভেজে রাখা কুচো চিংড়ি। এই রান্না আমি এখনও করি। তবে মায়ের হাতকে টেক্কা দেওয়া কি অত সহজ! ’’
সপ্তপদী রেস্তরাঁর কর্ণধার রঞ্জন বিশ্বাসও আড্ডার ছলে ভাগ করে নিলেন নিজের ছেলেবেলায় তিনি কী ভাবে নববর্ষ কাটাতেন। রঞ্জন বলেন, ‘‘নববর্ষ মানেই তো দোকানে দোকানে পুজো আর হালখাতা! নববর্ষের সকালবেলাটা নিরামিষ পদই বেশি হত বাড়িতে। চাপড় ঘণ্ট, থোড়, লাউ দিয়ে মটর ডাল আরও কত কী! রাতে অবশ্য থাকত মাছ আর মাংসের মেলবন্ধন। মনে পড়ে, মা বানাতেন মাছের মইলু। কাতলা কিংবা ভেটকি দিয়ে টক-মিষ্টি-ঝালের সেই পদ ছিল মায়ের হাতের তৈরি খাবারের মধ্যে অন্যতম সেরা। গরমের দিনে এই খাবার ছিল অমৃত। মা ভেটকি মাছে নুন, কাঁচালঙ্কা বাটা, আদাবাটা আর তেঁতুলের রস মাখিয়ে নিতেন। এ বার কড়াইতে কালো সর্ষে, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিতেন। একটি পাত্রে টক দই, হলুদ গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো নিয়ে ভাল করে ফেটিয়ে ফোড়নের মধ্যে দিয়ে দিতেন। এ বার ঝোল ফুটে উঠলে মশলা মাখানো মাছ, চেরা কাঁচা লঙ্কা, নুন, চিনি দিয়ে ঢেকে রাখতেন বেশ কিছু ক্ষণ। মাছ সেদ্ধ হয়ে এলে উপর থেকে নারকেলের দুধ ছড়িয়ে পরিবেশন করতেন গরম গরম ভাতের সঙ্গে। মায়ের রান্না করা এই পদ এতই প্রিয় আমার, যে আমার রেস্তরাঁর মেনুতেও রেখেছি এই খাবার। নাম দিয়েছি মাধুরী!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy