Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Durga Idol

সেই সব শিল্পীরা

সে ছিল অন্য এক কলকাতা। সপ্তমী বা নবমীতেও তখন প্রতিমার গায়ে রং-তুলির শেষ প্রলেপ। প্রতিযোগিতায় হারজিত নয়। শিল্পীর আত্মতৃপ্তিই শেষ কথা বলে জানতেন সুনীল পাল, গোপেশ্বর পাল, অশোক গুপ্তরা। তাঁরা দেখিয়েছিলেন কেমন করে ফর্ম ভাঙতে হয়। লোকে বলত ‘আর্টের ঠাকুর’। এখনকার থিমপুজোর দিনে তাঁদের প্রতিমাকাহিনি যেন রূপকথা। ঋজু বসুসে ছিল অন্য এক কলকাতা। সপ্তমী বা নবমীতেও তখন প্রতিমার গায়ে রং-তুলির শেষ প্রলেপ। প্রতিযোগিতায় হারজিত নয়। শিল্পীর আত্মতৃপ্তিই শেষ কথা বলে জানতেন সুনীল পাল, গোপেশ্বর পাল, অশোক গুপ্তরা। তাঁরা দেখিয়েছিলেন কেমন করে ফর্ম ভাঙতে হয়। লোকে বলত ‘আর্টের ঠাকুর’। এখনকার থিমপুজোর দিনে তাঁদের প্রতিমাকাহিনি যেন রূপকথা। ঋজু বসু

অশোক গুপ্তের নির্মিত দুর্গাপ্রতিমা।

অশোক গুপ্তের নির্মিত দুর্গাপ্রতিমা।

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২০ ০০:৩০
Share: Save:

বোধন হয়ে গিয়েছে সময়মতো। তবু প্রতিমাশিল্পীর ঘুম নেই। শহরের নামী কোবরেজ-বাড়ির ছেলে, ঘুম তাড়ানোর কী এক অ্যালোপ্যাথি বড়ি গিলে রাতবিরেতে প্যান্ডেলে অস্থির পায়চারি করছেন। তাঁর টেনিয়া-বাহিনী, পাড়ার ছেলে নিমাই, কাজল, রজত, তপু, পুপাইরা সভয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে জল মাপছে। ঠাকুরটা তো দিব্যি লাগছে! কিন্তু সে কথা বলবে কে! যা রগচটা অশোকদা, কে জানে মাথার ভেতরে কোন পোকা নড়ছে।

ভোর সাড়ে চারটেয় অবশেষে তাঁর ভাবনায় স্থিত হলেন অশোক গুপ্ত। ভারা বেঁধে নিজেই ফের উঠলেন প্রতিমার মুখের কাছে। তার পর কুড়ুলের ঠুক-ঠুকে হননকার্য। এর পরের ঘণ্টাতিনেকে তৈরি হল কিছু রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত। বোধন হয়ে গিয়েছে তো কী! স্বয়ং শিল্পীর মনে হয়েছে, ঠাকুরের মুখটা সব-কিছুর সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। তাই সপ্তমীর ভোরে প্রতিমার মুখ ভেঙে চুরমার। খড়ের গায়ে নতুন করে মাটি লেপে, ঝড়ের গতিতে ব্লো-ল্যাম্পে তা শুকিয়ে ফেলার পালা। রঙের মুনশিয়ানায় ঝটপট সকালটা ভরে ফেলে, চোখ এঁকে ভারা থেকে নামলেন শিল্পী। তখন সকাল সাড়ে সাতটা-আটটা। পাড়ার খুদেরা জুলজুলে চোখে নায়কের দিকে তাকিয়ে। শিল্পী যেন কিছুই হয়নি, এমন ভাব করে কাকে টাকা দিয়ে সবার জন্য কেজিটাক জিলিপি আনতে বলে দিলেন। কলাবৌ স্নানের সময় তত ক্ষণে এগিয়ে এসেছে। শুধু সপ্তমী কেন, কখনও বা নবমীতেও এই রকম টুকটাক ফাইনাল টাচ দিয়েছেন শিল্পী। উত্তর কলকাতার রাজবল্লভপাড়ায় ‘জগৎ মুখার্জী পার্ক’-এ ফি-বছর এমন বিচিত্র নাটকীয় কাণ্ড।

, ৯৬০-৭০’এর কলকাতার মেজাজটাই আলাদা। শিল্পীর প্রাণান্তকর ডেডলাইন নেই। দেবীপক্ষ পড়তেই থিম-প্যান্ডেল-লাইটিং মিটিয়ে ভিভিআইপি দিয়ে উদ্বোধনের হিড়িক ছিল না। থিমপুজো শব্দটাই অজানা। কুমোরটুলির সাবেক একচালা ঠাকুর এবং তখনকার পুজোর ‘উত্তমকুমার’ রমেশ পালের জলজ্যান্ত ‘মান্‌ষেরা’ প্রতিমা বাদ দিলে দু’-চারটি পুজো বাঁধা গতের বাইরে হাঁটার সাহস পেত। ধ্রুপদী বাগবাজার সর্বজনীনের কাছেই জগৎ মুখার্জী পার্ক, গৌরীমাতা উদ্যান, রাজবল্লভ পাড়ার ‘কড়ুরী বাড়ি’, ষড়ঙ্গ ক্লাবে নিজস্ব স্বাক্ষর রাখেন অশোক গুপ্ত। থিম-শিল্পীদের তখন পোঁছে কে! লোকে বলত, আর্টের ঠাকুর। পাহাড়ি ঝড়ের আবহে অসুরদলন। ফুল হাতে অসুরের সমর্পণ। শরীরী বিভঙ্গে গৎ-ভাঙা শিল্পীর মনের দুর্গা। মূর্তি না পেন্টিং, ঠাহর করতে হিমশিম মুগ্ধ চোখ। থিমের ভাস্কর্য-চিত্রকলা-কাব্যসুষমার মিশেলে অশোকবাবুর রাশভারী ‘অ্যাটিচুড’ও লেপ্টে থাকত।

তবে সে-যুগের মনটাকে ধরতে আর একটু পিছোতে হবে। স্বাধীন দেশ, আধুনিক কলকাতার ভিতরে এক আশ্চর্য গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারাবাহিকতাও মিশে আছে বাঙালির শারদ সৃষ্টিশীলতার সেই বিস্মৃত প্রত্যুষে।

শোভাবাজারে অবিনাশ কবিরাজদের বাড়ির ছেলে অশোকবাবু পারিবারিক সমৃদ্ধির সোনার খাঁচায় হাঁসফাঁস করছিলেন। চালু নিয়মের নিগড়ে বন্দি হতে না-পারা স্বাধীন সত্তা মাথা তুলল তাঁর কিশোরবেলাতেই। সহোদর ভাই আত্মঘাতী হওয়ায় তীব্র আঘাত পেয়েছিলেন অশোক। এর পরই কিছু মনোমালিন্যের জেরে গৃহত্যাগী। তখন তিনি বড়জোর চোদ্দো-পনেরো। গুরু, ভাস্কর সুনীল পালের স্নেহচ্ছায়াই তাঁর আশ্রয়। দীর্ঘ দিন থাকতেনও পাতিপুকুরে ‘সুনীলদা’র বাড়িতে। বাগবাজারের পুজোর মতো ভিড় কখনওই হয়নি জগৎ মুখার্জী পার্কে অশোক গুপ্তের পুজোয়। কিন্তু সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী, ‘চাইনিজ় ওয়াল’ গোষ্ঠ পাল, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের মতো অনেকেই অশোকের মূর্তি, ছবি, পোর্ট্রেটের গুণগ্রাহী। পাড়ার ছেলেরা, যাদের অনেকেই আর্ট কলেজের হবু শিক্ষার্থী— অশোকদা-অন্ত-প্রাণ! দিনভর ঠাকুরের কাজের সময়ে নাগাড়ে দেবব্রত বিশ্বাসের গান বাজত। অশোক কাজ করছেন নিজের খেয়ালে। আবহ থেকে ছোট ছোট ডিটেলিং— সব কিছুতে মূর্ত শিল্পীর অভিমান।

এই অভিমানেও মিশে সুনীল পালেরই উত্তরাধিকার। তা বুঝতে সদ্য-স্বাধীন দেশের একটি অজানা গল্পে ডুব দেওয়া যায়। ঔপনিবেশিক গরম-ভাব মেজাজের এক জাঁদরেল আমলা এবং তরুণ শিল্পীর গল্প। গাঁধী-হত্যার পরে ব্যারাকপুরের গাঁধীঘাটের মাটির মূর্তিমালা গড়তে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় আনকোরা সুনীল পালের উপরেই ভরসা করেছিলেন। প্রথমে ঠিক হয় রিলিফের মাপ হবে ছয় বাই দুই ফুট। শিল্পীর বাজেট ছিল ছ’হাজার টাকা। গাঁধী জীবনের নানা অধ্যায়, দক্ষিণ আফ্রিকা-পর্ব, অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান— সব কিছু মেলে ধরার পরিকল্পনায় দৈর্ঘ্য বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ ফুট। তবে শিল্পের মাপ বাড়লেও সরকার টাকা বাড়াতে রাজি হয়নি। বলা হয়, শিশু-রাষ্ট্রের এর বেশি সাধ্য নেই। সুনীলবাবু কাজটা দেশের কাজ বলে মেনে নিয়ে তাতেই খুশি ছিলেন। কিন্তু ছ’মাসের কাজের মেয়াদ বাড়ছিল চড়চড়িয়ে। ক্ষুব্ধ পূর্ত সচিব শিল্পীকে কড়া চিঠি লিখে ‘উচিত ব্যবস্থা’ (নেসেসারি অ্যাকশন) নেওয়ার হুমকি দিলেন। সুনীল পাল সাত্ত্বিক বিনয়ী মিতভাষী। কিন্তু মেরুদণ্ডের ঋজুতায় ঘাটতি নেই। সময়োচিত ‘ফোঁস’টুকু করতে তিনি কসুর করেননি।

সুনীল পালের হাতে গড়া দুর্গামূর্তির ছবি

সুনীল পাল্টা চিঠি লেখেন, ‘‘আপনাদের রাষ্ট্র শিশু হতে পারে, ভারতবর্ষের শিল্প শিশু নয়। তার গুরুত্ব বজায় রাখার দায়িত্ব শিল্পীর।
কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করাই এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত অ্যাকশন নেওয়া!’’— দেরির কারণ বিশদে বুঝিয়ে শিল্পীর এই স্পর্ধিত আত্মমর্যাদাবোধ আজকের কর্তাভজা আমলে বিরল। ২০২০ সুনীল পালের শতবর্ষের বছর। পুজোর মঞ্চে নতুন কিছু করার তাগিদটা বাঙালির মধ্যে চারিয়ে দিতেও সুনীল পাল-অশোক গুপ্তরা পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন।

পোটোপাড়ার আর্ট ফর্ম বা কুমোরের কাজে আর্ট কলেজ-দীক্ষিত শিক্ষিত মননের ছাপ নিয়ে অবশ্য যুগে যুগে নানা দ্বিধার ছায়া পড়েছে। ১৯৪৫-এ ভবানীপুরের কাঁসারিপাড়ায় সুনীল পালের দুর্গা বাঙালির প্রতিমাকল্পের পথে একটি দিকচিহ্ন। ক্লাসিক ভাস্কর্যের ঢঙে সেই দুর্গাকে দেখে পাথরের মূর্তি ভেবে লোকে তাজ্জব। উচ্ছ্বসিত কর্মকর্তারা সে-ঠাকুর ভাসান না দিয়ে সাত দিন রেখে দিলেন। শোনা যায়, পরে সোৎসাহে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সে-প্রতিমার ফোটো দেখিয়ে কিন্তু সুনীল বকুনিই খেয়েছিলেন।

ছবি দেখে অবন ঠাকুর বলে ওঠেন, ‘‘এ তো আর্টওয়র্ক, প্রতিমা হল কই! আর্টিস্টদের এই দোষ, তারা সব কিছুতে পার্মানেন্ট ভ্যালু দিতে চায়।’’ আসল দুর্গাকে ব্যক্ত করা অত সোজা নয় তাই কুমোরদের মতো খড়মাটির প্রতীক করাই ঠিক, বুঝিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। এই শিক্ষার প্রেরণা বুকে ভরেই সুনীল এর পরে নানা ছাঁদে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন।

নিছক ক্লাসিকের ছায়া নয়! কুমোরটুলির পুরনো ঢং থেকে বাঁকুড়া, বীরভূম, মানভূম, ত্রিপুরার ফোক আর্ট, নেপালে তিব্বতি মন্দিরে রং করা মূর্তি, এমনকি মিশরীয় ছবির সরলতা থেকেও শিক্ষা নেওয়ার কথা লিখেছেন সুনীলবাবু, যা তাঁর প্রতিমাশিল্পে নতুন ভাব আরোপ করেছিল।

শোভাবাজার হাটখোলায় তেলচিটে ‘বিজলী কেবিন’-এর ভ্যাপসা গন্ধে রোজকার আড্ডায় আধার পাচ্ছে আধ্যাত্মিক শিকড়মণ্ডিত শিল্প-ভাবনার সুরভি। সুনীলের বন্ধু মধুসূদন দাঁয়ের পুত্র কলা-সমালোচক প্রশান্ত দাঁ সে-সব স্মৃতি সঙ্কলিত করেছেন। প্রতিমায় ভারতীয় চিত্রকলার ধাঁচ, অপরূপ দেবীভাবের দুর্গা আর একটা ভয়ঙ্কর যুদ্ধের আবহ তখন সুনীলের শৈলীর ছাপ। সেটা প্রচারের যুগ নয়। তবু লোকমুখেই সাড়া পড়েছিল। হাটখোলা বা বিডন পার্ক ছাড়া কুমোরটুলির খাস পট্টিতেও ঠাকুর গড়ার ডাক পেয়েছেন সুনীলবাবু। তথাকথিত কুমোরেরা তাঁকে নিজেদের লোক মনে করে ডাকছেন, কেউ কেউ অনুপ্রাণিত হচ্ছেন— এটুকু বরাবর পরম সৌভাগ্য মেনেছেন সুনীল। তবে কলকাতার বারোয়ারি মণ্ডপে খুব বেশি দিন
ঠাকুর গড়েননি তিনি। সুনীল পালের প্রতিমা-ভাবনার স্বাক্ষর খোদাই হয়ে আছে পুরুলিয়ায় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে। তরুণী সরস্বতী সেখানে ফুটতে উন্মুখ পদ্মের গায়ে পা রাখছেন। এ পদ্ম শিক্ষার্থীর হৃদয়ের প্রতীক। সরস্বতীর অধিষ্ঠানের অপেক্ষায় সে বুক পেতে দিয়েছে। রূপ-রস-ভাবের মিলমিশে প্রতিমা-ভাবনার এই ধারাই আজকের বারোয়ারি পুজোও বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সুনীল পালের ‘ডান হাত’ অশোক গুপ্ত অর্ধশতক আগেও বলতেন, পুজোটা তাঁর কাছে বচ্ছরকার প্রদর্শনীর মঞ্চ। শিল্পকাজের যাবতীয়
স্বপ্ন বছরে একটি বার প্রতিমার রূপকল্পে তিনি উজাড় করে দিতেন। মণ্ডপে নানা রঙের সমন্বয়, আলো-আঁধারির ব্যালেন্স— হাঁ করে গিলতেন তরুণ শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য, ভাস্কর বিমল কুণ্ডু, চিত্রশিল্পী সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় থেকে আজকের সনাতন দিন্দা। অশোকদার পাঠশালায় এমন কত একলব্য নিঃশব্দে নাড়া বেঁধেছেন! দক্ষিণ কলকাতায় এক বারই ঠাকুর করেছিলেন অশোকবাবু। ১৯৬৫-র চুনী গোস্বামী অভিনীত বাংলা ছবি ‘প্রথম প্রেম’-এ (নায়ক বিশ্বজিৎ) সেই ঠাকুর অনেক ক্ষণ ধরে দেখিয়েছিল। গর্বে বুকের ছাতি ফুলে উঠেছিল অশোকদার সে দিনের ছায়াসঙ্গীদের। বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরিতে অশোকের আঁকা রবীন্দ্রনাথ বা তারাপদ চক্রবর্তীর বাড়ির দেওয়াল-জোড়া সরস্বতীও অমল-স্মৃতি।

ভাস্কর: সুনীল পাল ও প্রতিমাশিল্পী: অশোক গুপ্ত।

কুমোরটুলির সাবেক মহল্লা আবহমান কলকাতার একটা দিকচিহ্ন। পুজো-শিল্পে নতুনের আবাহন তবু বার বারই বহিরাগতদের কাছ থেকে এসেছে। আর্ট কলেজ-শিক্ষিত সুনীল পাল বা অবিনাশ কবিরাজদের ঘরের অশোক গুপ্তদের আগে গোপেশ্বর পালদের গল্পও ভুললে চলবে না। আজকের কুমোরটুলিতে ভাস্কর জি পাল স্ট্রিটে তাঁর নাম জড়িয়ে থাকলেও একেবারে শেষ জীবনে ঠাকুর গড়ার কাজে তিনি হাত লাগিয়েছিলেন।

১৮৯০-এ কৃষ্ণনগরে জন্ম গোপেশ্বরের। কুমোরের ঘরে জন্মেও অন্য ছাঁদের ভাবনার জন্য নিজের মামাদের চক্ষুশূল তিনি। চিরকেলে পুতুল-শিল্পের আঙ্গিক থেকে পা বাড়িয়ে সেই তরুণ তখন মাটির তালকে জীবন্ত করে তোলাই ধ্যানজ্ঞান করেছেন। জি পালের নানা কিংবদন্তি ধুলোর মতো ওড়ে কুমোরটুলির বাতাসে। বিলেতের ভারত-মেলায় শামিল হতে জাহাজে কালাপানি পার হয়ে কুমোরপাড়ায় একঘরে হয়েছিলেন। জাহাজের থার্ড ক্লাসের যাত্রী। তিনিই মাটির তাল হাতে নিমেষে ক্যাপ্টেনের মূর্তি গড়ে তাক লাগিয়ে দিলেন। জি পালের সাবেক স্টুডিয়োটা কুমোরটুলির পটুয়াপাড়ার বাইরে। উল্টো দিকে, কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটে। সেখানে ধুলো-জমা ফোটো-ফ্রেমে আজও পড়া যায় বিলেতের ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার কাটিং। ওয়েম্বলির প্রদর্শনীতে ভারতীয় প্যাভিলিয়নে ‘লাইটনিং স্কাল্পটর’-এর কথা। হাতের টোকায়, মোচড়ে বা ক্ষিপ্র চড়চাপাটিতে তিনি ৪৫ সেকেন্ডে মাটির ঘোড়ার মাথা বা ৩০ সেকেন্ডে কুকুরের মুখ হুবহু ফুটিয়ে তুলতেন।

জি পালের স্টুডিয়ো বা সামান্য দূরে রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে রমেশ পালের স্টুডিয়োয় ঢুকলে এখনও গা ছমছম করে। ছবির ফ্রেম বা সারি
বেঁধে বসে থাকা মূর্তির লাইনে শ্রীরামকৃষ্ণ যেন খালি গায়ে সত্যিই বসে। জি পালের রামকৃষ্ণ বেলুড়
মঠের মন্দিরে রয়েছেন। তার দু’দশক বাদে তৈরি রমেশ পালের রামকৃষ্ণ বরাহনগরের রামকৃষ্ণ সেবায়তন মঠে আসীন। শিল্পীর স্টুডিয়োয় টেবিলে কাচের নীচে রাখা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের শংসাপত্র। এমন দিব্য বিভামণ্ডিত মুখাভাস তিনি কখনও দেখেননি বলে উদ্বেল হয়েছিলেন। রমেশ পালও কুমোরের ঘরের ছেলে নন। সাবেক পুব বাংলার বিক্রমপুর থেকে এসে কুমোরের পেশাকেই আপন করলেন।

জি পালের স্টুডিয়োর একটি তাকে এখনও পড়ে আছে তাঁর প্যান্ডেলের মহিষাসুরমর্দিনীর খুদে খুদে মাটির রেপ্লিকা। তাতে সিংহ ও অসুরের মুখোমুখি দ্বৈরথ কিংবা দুর্গার পদদলিত অসুরের নানা বিভঙ্গ। সেই প্রথম একচালা ভেঙে দুর্গা ও তাঁর ছেলেমেয়েদের আলাদা প্রতিমা গড়া শুরু। মাটির প্রতিমা ভাসান দিলেও প্রতি বছর তার পুঁচকে প্রতিকৃতি করে রাখতেন গোপেশ্বর। ৮৫ বছরের পুরনো স্টুডিয়োর তাক সেই ইতিহাস ধরে রাখছে। জি পাল বা রমেশ পাল— দু’জনের দুর্গাই জীবন্ত, মানুষের মতো। ১৯৫০-৬০’এর দশকের দমকলের পুজোয় রমেশ পালের ঠাকুর দেখার উন্মাদনায় এক সময়ে পুজোটাই বন্ধ হয়ে গেল। পোটোপাড়ার ট্র্যাডিশন ভেঙে নতুন কিছু সৃষ্টির ইতিহাসে ওঁরাও জ্বলজ্বল করছেন।

কলকাতার পুজোর গত জন্মের ইতিহাসে আর এক শিল্পীর কথাও মনে করার। বাগবাজার, কলেজ স্কোয়ার, একডালিয়া, ম্যাডক্স স্কোয়ারের বাইরে ১৯৮০-র দশকে ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছিল মহম্মদ আলি পার্কও। সৌজন্যে আর এক বিস্মৃত শিল্পী, অলোক সেন। কুমোরটুলির অনতিদূরে নন্দরাম সেন স্ট্রিটে তাঁর স্টুডিয়ো এখন ভূতের বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে। শৈলেন্দ্র সরকার স্কুলে পড়ার সময়ে ইতিহাস ক্লাসে অলোককে দেখেও তাক লাগত সহপাঠী-মাস্টারমশাইদের। শিবাজির কথা শুনতে শুনতে মগ্ন ছাত্রটি কখন মাটির শিবাজি গড়ে ফেলেছে।

আর্ট কলেজ ঘোরা অলোক টানা সাড়ে তিন দশক আমৃত্যু লেগে ছিলেন মহম্মদ আলি পার্কের সঙ্গেই। পুজোর দুর্গা, কালী, সরস্বতীই ক্রমশ তাঁর জীবিকা হয়ে ওঠে। শিল্পী বিমল কুণ্ডুর মতো অনেকেই উঠতি বয়সে ভরাট গলার পাজামা-পাঞ্জাবিধারী এই পুজো-শিল্পীকে সঙ্গত করে কাজ শিখেছেন। ‘তারে জ়মিন পর’ ছবির চিত্রশিল্পী সমীর মণ্ডলের ক্যানভাস দেখে অনেক দিন বাদে অলোক সেনকে মনে পড়ছিল, এ কালের কৃতী থিম-শিল্পী, ভাস্কর পার্থ দাশগুপ্তর। রমেশ পাল-জমানায় জনপ্রিয় মানুষ-সুলভ বড় প্রতিমার মধ্যেও একটেরে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার চেনাত অলোকবাবুকে। সেই সঙ্গে চোখ টানত তাঁর অসুর। সচরাচর ভয়াল বিকট-দর্শন নয়। বরং নিপাট ভদ্রলোকসুলভ, সুদর্শন। অশুভ শক্তি কোনও ভিন গ্রহের কেউ নয়। একাধিক অসুরের মধ্যে নানা সামাজিক অবিচার নিয়ে বার্তায় সে-যুগে অলোক সেনের পুজোর খ্যাতি কলকাতার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

২০০৫-এ অলোক সেনের অকালমৃত্যুর পরে ২০০৯-এ চলে যান অশোক গুপ্ত। ২০১২-য় দীর্ঘ জীবনে যবনিকাপাত রমেশ পাল ও সুনীল পালের। একটা সময়ে উৎসবের জৌলুস যাঁদের জড়িয়ে থাকত, অস্বাভাবিক নিচু তারে বাঁধা তাঁদের মৃত্যু। অথচ তখন কলকাতার থিমপুজোর এক যুগান্তকারী অধ্যায় শুরু হয়েছে। পুজোর প্রতিযোগিতা, স্পনসরশিপ, শিল্পীদের কয়েক লক্ষ টাকার প্যাকেজ— এ সব অতীতের সেই সব দিকপাল স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। কিন্ত বাঁধা গতে গা না-ভাসিয়ে উটকো নিন্দেমন্দ থোড়াই কেয়ার করে নতুন একটা শিল্পভাষার খোঁজেই তাঁরা মশগুল ছিলেন বরাবর।

পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন অশোক গুপ্তর শেষটা তাঁর পুজোর মাঠের সঙ্গী, পাড়ার স্নেহভাজনরাই ঘিরে ছিল। কয়েক বছর ধরে সরকারি হাসপাতালে অশোকদার চিকিৎসার সময় পুপাই ওরফে গৌতম মিত্রই তাঁর অন্যতম গার্জেন। জীবনের সোনালি অধ্যায়ে এই সহচরদের নিয়েই পুজো শেষে কেদার-বদ্রী, বেতলা বা অমরকণ্টকে যেতেন অশোকদা। প্রকৃতির মধ্যে পরের বারের পুজোর রসদের জন্য হাত পাতা। অশোকদার গোটা মশলার ছক-ভাঙা রান্না, গাড়ি চালানো, শখের ডাক্তারির গল্প— এখনও ভক্তদের মুখে-মুখে। এ বার জগৎ মুখার্জী পার্কের থিমও অশোক গুপ্তেরই স্মৃতি-তর্পণ।

শিল্পের প্রতি অহৈতুকী টান এবং সামাজিক সেতুবন্ধ— এই দুয়ের যোগসাধনেই বিস্মৃত নায়কদের ছায়া গাঢ় হয় পুজোর ক্যানভাসে।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Idol
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy