Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Copper Coupon

কাগজের ‘তাম্রমুদ্রা’

চালু হয়েছিল শুধু দিনাজপুর জেলায়। যুদ্ধের সময় ধাতুর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সহজলভ্য বস্তু দিয়ে তৈরি করা হত আপৎকালীন মুদ্রা। তখন বিশ্বের নানা স্থানে মুদ্রা তৈরি হয়েছিল রেশম, কাঠ, কাপড় বা চামড়া দিয়ে।

নিদর্শন: কাগজে ছাপা এক আনা ও দুই আনার ‘কপার কুপন’।

নিদর্শন: কাগজে ছাপা এক আনা ও দুই আনার ‘কপার কুপন’।

সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৪
Share: Save:

সোনার পাথরবাটি। যার আভিধানিক অর্থ অলীক বস্তু। অনেকটা এই রকমই আর একটি শব্দবন্ধ ‘কপার কুপন’। সোনার কেল্লা যেমন সোনার তৈরি নয়, তেমনি কপার কুপনও তামা দিয়ে তৈরি নয়। নামে কপার কুপন হলেও এগুলি আদতে শক্ত কাগজ, বোর্ড (এডমন্ডসন স্টাইল) প্রভৃতি দিয়ে তৈরি হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের অন্তত ৩১টি রাজ্যে এই ধরনের মুদ্রা চালু থাকলেও পূর্ব ভারতে শুধুমাত্র দিনাজপুরের বাইরে অন্য কোথাও এমন মুদ্রা চালু হয়েছিল বলে জানা যায়নি। তা ছাড়া দিনাজপুর ছিল একটি জেলা, রাজ্য নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কেন কাগজের তৈরি মুদ্রা চালু হয়েছিল, আর তাকে কপার কুপনই বা কেন বলা হত, সেই কাহিনি জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।

যুদ্ধ মানেই ধাতুর টানাটানি। অস্ত্র তো বটেই, যুদ্ধের শিরস্ত্রাণ থেকে সাঁজোয়া গাড়ি, সব কিছু তৈরি করতেই প্রয়োজন ধাতু। ধাতুর অভাবেই ব্রিটিশ ভারতে প্রথম ছাপা হয়েছিল কাগজের ১ টাকা, ১৯১৭ সালে। ব্রিটিশ ভারতে তখন মুদ্রার ধাতুতেও বদল আনা হয়েছিল। ২ আনা, ৪ আনা ও ৮ আনার মুদ্রা রুপোর বদলে কপার-নিকেল মিশ্র ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়। তখন ১৬ আনা বা ৬৪ পয়সায় ১ টাকা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে ধাতুর অভাবে সবচেয়ে বেশি বৈচিত্রপূর্ণ মুদ্রা তৈরি হয়েছিল ইউরোপে, মূলত জার্মানিতে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের বিভিন্ন রাজ্য ও ছোটখাটো প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, যেমন পুরসভাকেও মুদ্রা তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এই ধরনের মুদ্রাকে জার্মান ভাষায় বলা হয় ‘নটগেল্ড’, বাংলায় ‘আপৎকালীন মুদ্রা’। সেই সময় যে সব জিনিস সহজলভ্য ও সস্তা ছিল, তা দিয়েই মুদ্রা তৈরি করেছিল সেই সব রাজ্য, জেলা ও শহর। সেই সব উপকরণের তালিকায় নানা ধরনের কাগজ ও কার্ড তো ছিলই, এ ছাড়াও ছিল রেশম (জার্মানির বিয়েলফিল্ড রেশমের জন্য বিখ্যাত, এখানে দু’টি রেশমের টুকরো আলাদা করে ছেপে সেলাই করে নোট হিসাবে ব্যবহার করা হত), সেরামিক (জার্মানির স্যাক্সনিতে সেরামিক কারখানা ছিল, সেখানে সেরামিকের মুদ্রা তৈরি করা হয়েছিল), বাটার পেপার (অস্ট্রিয়ার গ্রিস অ্যাম ব্রেনারের জনসংখ্যা ছিল এক হাজারের কম, কেক তৈরিতে যে অর্ধস্বচ্ছ কাগজ ব্যবহার করা হয় তার উপরেই নোট ছাপানো হয়েছিল) প্রভৃতি। এই তালিকায় কাঠ থেকে চামড়া, প্রায় কিছুই বাদ ছিল না। শক্ত কাগজে কয়েন ছাপিয়ে তা গোল করে কেটেও নেওয়া হত, সেগুলি বেশ বর্ণময় দেখতে হত। এই সব মুদ্রা চালু ছিল শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক এলাকার গণ্ডির মধ্যে। জার্মানি, অস্ট্রিয়া-সহ বিভিন্ন দেশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময় থেকে ১৯২০-র দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই বন্দোবস্ত চালু ছিল। মুদ্রাস্ফীতির পরে অর্থনীতি স্থিতিশীল হলে এই অবস্থা লুপ্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে আবার নটগেল্ড চালু হয়।

ব্রিটিশ আমলে ভারতের অনেক দেশীয় ও করদ রাজ্যেরই নিজস্ব মুদ্রা ছিল, যেমন টঙ্ক, কচ্ছ, জয়পুর, যোধপুর, ‘গবালিয়র’ (মুদ্রায় এই বানানই লেখা হত), সাইলানা প্রভৃতি। সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সীমানার মধ্যে ব্রিটিশ মুদ্রার পাশাপাশি এই সব মুদ্রা চলত, এগুলির মান মোটামুটি ব্রিটিশ ভারতের মুদ্রার সমতুল্য ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৩১টি রাজ্য নিজেদের এলাকায় খুচরো মুদ্রার জোগান বজায় রাখতে সেই সময়ে চালু ছোট মুদ্রার সমান মানের মুদ্রা ছাপায়। কাগজের মুদ্রা বলতে ১ টাকা এবং তার চেয়ে বেশি মূল্যের নোটই সাধারণ ভাবে চালু ছিল। ১ টাকা ও তার চেয়ে চেয়ে কম মূল্যের মুদ্রা ধাতুর (তামা বা তামার সংকর) তৈরি হত। দেশীয় রাজ্যগুলির মুদ্রা ১ পয়সা, আধ আনা, ১ আনা, ২ আনা প্রভৃতি মানের ছিল। ব্রিটিশ আমলে এই সব মুদ্রা তামা বা তামার সংকর দিয়ে তৈরি হত বলে এই সব মুদ্রার সমান মানে তৈরি কাগজের মুদ্রা বা কুপন, লোকমুখে ‘কপার কুপন’ নামে পরিচিত হয়ে যায়। পশ্চিমের ৩১টি রাজ্য ছাড়াও হায়দরাবাদ ও কাশ্মীরে কাগজের মুদ্রা চালু ছিল। এগুলি কপার কুপন নয়, কারণ এই দুই রাজ্যের কাগজের মুদ্রার মান ১ টাকা বা তার চেয়ে বেশি ছিল। রাজ্য নয়, তবু দিনাজপুর জেলাতেও এমন মুদ্রা চালু হয়েছিল। অধিকাংশ কপার কুপনের কোনও এক দিকে টাকার মতো ক্রমিক সংখ্যা লেখা থাকলেও দিনাজপুরে কপার কুপনে কখনও কোনও ক্রমিক সংখ্যা ছাপা হয়নি।

দিনাজপুরের কপার কুপনে ব্রিটিশ আমলের ১ পয়সা (তখন লেখা হত ওয়ান কোয়ার্টার আনা), ১ আনা ও ২ আনার যে দিকে মুদ্রামান লেখা থাকত, সেই দিকের ছবি ছাপা হত। এই মুদ্রা ১৯৪২-৪৩ সালে চালু থাকলেও, ২ আনার মুদ্রায় সাল লেখা রয়েছে ১৯৩৯। মানে, যিনি এটির নকশা করেছিলেন তাঁর হাতের কাছে যে মুদ্রাটি ছিল, তাতে ১৯৩৯ লেখা ছিল। ওই সালের সঙ্গে মুদ্রার প্রকৃত সালের কোনও সম্পর্ক নেই। ১ আনা মুদ্রায় ১৯৪২ সাল ছাপার কারণও তাই। কয়েনের অপর দিকে রাজার নাম ও ছবির বদলে, কপার কুপনের অপর দিকে জমিদারির মনোগ্রাম (একটি ঢালের দু’পাশে একটি সিংহ ও একটি একশৃঙ্গ কাল্পনিক ঘোড়া বা ইউনিকর্ন), যা অনেকটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মনোগ্রামের মতো এবং একেবারে উপরে ‘ওঁ’ চিহ্ন ছাপা হত। ১৭৮৬ সালে দিনাজপুর জেলা তৈরির পরে সেটিই ছিল অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে বড় জেলা। ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে অধুনা উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলা নিয়ে গঠিত এই জেলাকে মহারাজার জেলা বলা হত। বিশাল এই প্রশাসনিক এলাকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কপার কুপন প্রচলন করা হয়েছিল। কপার কুপনের আরও একটি নাম ‘ক্যাশ কুপন’।

এক আনা মূল্যের মুদ্রাটির ছবি কুপনে রয়েছে, সেখানে রোমান ও দেবনাগরী হরফ ছাড়াও বাংলা, তেলুগু ও ফারসি হরফ ব্যবহার করা হয়েছে। কয়েনে এক সঙ্গে এতগুলি হরফ এ দেশে প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯০৬ সালের ১ আনা মুদ্রায়। ব্রিটিশ ভারতে প্রথম যে ১ আনা মুদ্রা চালু হয়, সেই মুদ্রায় সপ্তম এডওয়ার্ডের ছবি ছাপা হয়। এক আনার এই ধরন চালু ছিল ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। রুপোর দামের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে (১৯১৮-১৯২০) কপার-নিকেলের ২ আনা, ৪ আনা ও ৮ আনার মুদ্রা তৈরি করা হয়। তখন ব্রিটিশ ভারতের মুদ্রায় পঞ্চম জর্জের ছবি ছাপা হত। এই তিনটি মুদ্রা এবং আরও পরে ১৯৪২-১৯৪৭ সালের (ষষ্ঠ জর্জের আমল) আধ আনা বা দুই পয়সাতেও এই পাঁচটি হরফ লেখা হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আম্বিয়ারা, ইন্দরগড়, ওয়াঙ্কানের, কালাত, খাদাল, গোন্দল, চুড়া, জয়সলমের, জশদান, জাওরা, জুনাগড়, টঙ্ক, ধর, নওলগড়, নবনগর, বাজানা, বলবন, বামরা, বিলকানা, বিলখা, বিকানির, বিঠলগড়, বুঁদি, ভরতপুর, মুলী, মংরোল, মেঙ্গানি, রাজকোট, রামগড়, সাইলানা ও সায়লা কাগজের মুদ্রা চালু করে, এর বাইরে আরও চারটি রাজ্যের নিজস্ব মুদ্রাব্যবস্থায় কাগজের পয়সা নয়, টাকা চালু ছিল— কচ্ছ, কাশ্মীর, মহীশূর ও হায়দরাবাদ। মহীশূর এক বারই কাগজের মুদ্রা প্রকাশ করেছিল। বাকি রাজ্যগুলি ধাতব মুদ্রার বাইরে শুধু কপার কুপনই প্রকাশ করে। এর মধ্যে সায়লা রাজ্য এডমন্ডসন স্টাইলে কুপন প্রকাশ করে। আগে ভারতীয় রেলে কার্ডবোর্ডের উপরে যে টিকিট ছাপা হত, এই ধরনের টিকিটের ‘স্টাইল’-এর উদ্ভাবকের নাম অনুসারে এই টিকিটকে ‘এডমন্ডসন স্টাইল’ বলে। সোজা কথায়, রেলের টিকিটের কার্ডবোর্ডে মুদ্রার মান ছেপে সেটাই সায়লা রাজ্যে মুদ্রা হিসাবে চালু করা হয়েছিল। আপৎকালীন এই সব মুদ্রা স্থানীয় ছাপাখানায় ছাপা হত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও বিশ্বের নানা দেশে নানা পরিস্থিতিতে আপৎকালীন মুদ্রার প্রচলন হয়েছে, তবে স্বাধীন ভারতে এখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। ১৯৪৭ সালের পরে শুধু হায়দরাবাদ নিজস্ব মুদ্রা চালু রেখেছিল, ১৯৫০ সাল পর্যন্ত।

অন্য বিষয়গুলি:

World War 2 History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy