Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস,পর্ব ২৯

পরিক্রমণ

কাচ ভাঙার শব্দে চমকে ফিরে তাকায় শিমরন। উঠে দাঁড়িয়ে কফির কাপটা দেওয়ালে ছুড়ে মেরেছে তিয়াষা। তার পর অনেক ক্ষণ গুম হয়ে বসেছিল সে।সমানে অকথ্য ভাষায় কানের কাছে গজগজ করে যাচ্ছিল বিপাশা। কখনও এ ঘরে কখনও ও ঘরে, কখনও বারান্দায়, যেখানে যেখানে অরুণ যাচ্ছে, তার পিছন পিছন বিপাশা অনর্গল মন্দ কথার ফুলঝুরি ছড়াতে ছড়াতে চলেছে।

রাজশ্রী বসু
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১০
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তিয়াষা। চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে আটকে ফেলে। মানসিক ভাবে সে এতটাই ভেঙে পড়েছে যে অফিস যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। তিয়াষা যে থাকার জায়গা বদলেছে তা একমাত্র জানত অফিসে সহকর্মী শিমরন। সে তিয়াষার খোঁজ নিতে চলে আসে তার নতুন ঠিকানায়। তিয়াষার যন্ত্রণার বাঁধ ভেঙে যায় তার সামনে।

আগে থেকে কিছু জানা না থাকলেও তিয়াষার কথা শুনে অনেকটাই পরিষ্কার এখন শিমরন। কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘‘আর কী?’’

“আর... আর তো কিছু না। এ সবই ঘটে গেল গত এক মাসের মধ্যে। যে দিন অভিরূপের বেলটা হল, তার আগের রাত থেকেই নিখোঁজ হয় পিয়াস। আমি ও বাড়ি থেকে চলে আসার প্রায় দেড় মাস পর। আর... সেই যে সে দিন কোর্ট থেকে চলে গেল অভিরূপ, তার পর থেকে সেও আর আসেনি এখানে। প্রথম কয়েক দিন ফোনে কথা হয়েছে। রোজই বলেছে আসবে আসবে, কিন্তু আসেনি। এখন তো আর...’’ কথার মাঝখানে দুম করে থেমে যায় তিয়াষা, যেন হঠাৎ ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়া কোনও লাইট যা এত ক্ষণ টিমটিম করে জ্বলছিল... যার আয়ু এইমাত্র শেষ হয়ে গেল।

“এইখানটায় আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। কে পিয়াস? তার সঙ্গেও কি তোর কোনও ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট ছিল?”

“ওরা আর আমরা বালুরঘাটে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। আমার বন্ধু রিচার ভাই পিয়াস। এখানে সেলিমপুরের ফ্ল্যাটটা ওদেরই। প্রথমে আমি থাকতে এলাম। তার পর বিসিএস পাশ করে পিয়াস এসে জয়েন করল...”

“তোরা একই সঙ্গে থাকতিস? এনি অ্যাফেয়ার?” প্রায় গোয়েন্দার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে শিমরন।

“আমি তো বরাবর ওকে ভাইই ভেবে এসেছি। কিন্তু ওর আলাদা কনসার্ন ছিল। অভিরূপকে ও মেনে নিতে পারেনি।’’

উত্তেজিত ভঙ্গিতে তিয়াষাকে থামিয়ে দেয় শিমরন, “পিয়াসের ব্যাপারটা আলাদা। কিন্তু অভিরূপ কেন এ ভাবে পাল্টে যাবে! এমন নিশ্চয়ই নয় শুধুমাত্র বেল পাওয়ার জন্যই সে তোকে ব্যবহার করেছে। ওটা সে তোকে ছাড়াও পেতে পারত...

তা হলে?”

“আমি জানি না ... আমি জানি না গো...’’ শুকনো চোখের সাদা জমি থেকে বড় বড় অদৃশ্য মুক্তোদানা ঝরিয়ে কান্নাভরা গলায় বলে তিয়াষা।

“আচ্ছা... সে সব পরে হবে, এখন ওঠ, চট করে তৈরি হয়ে নে। তোকে অফিস যেতে হবে, কাজ করতে হবে। মনে রাখিস, এই জায়গাটা কেউ দেয়নি তোকে। শুধুমাত্র একটা লোকের ক্রুয়েলটির জন্য নিজেকে শেষ করতে পারবি না তুই। চল ওঠ।’’

“অফিস!’’

“হ্যা‌ঁ হ্যাঁ অফিস, চল ওঠ... সবাই ওয়েট করছে তোর জন্য... সাধনদাকে আমি বলেই এসেছি তোকে আজ নিয়ে তবে ঢুকব।’’

তিয়াষা ওঠে। স্নান করে। নিজেকে ধূসর রঙের শিফন শাড়িতে আর কালো স্লিভলেস ব্লাউজ়ে সাজায়। একপিঠ খোলা চুলের অবাধ্য বিচরণ সংহত করে ক্লাচারের শাসনে। চুপচাপ গলা দিয়ে নামায় শিমরনের এনে দেওয়া ব্ল্যাক কফি আর কেকের টুকরো। সব করে তিয়াষা। শিমরনের সব কথা মেনে নেয় একটাও আপত্তি না করে। একটাও শব্দ নেই গোটা ফ্ল্যাটের কোথাও। এই শান্ত শীতল তিয়াষাকে দেখে ভিতরে ভিতরে আশ্চর্য লাগলেও শিমরন এই ভেবে আশ্বস্ত হয় যে সে একবারে ওকে নিয়েই বেরোবে। ওকে রেখে দিয়ে চলে যেতে হবে না।

তিয়াষা কথা বলছিল না। কিন্তু ওর সারা মন জুড়ে কথার সমুদ্র। চোখের তারার তিরিতিরি কাঁপনে টুকরো টুকরো অসমাপ্ত কথার অশ্রু-ছোঁয়া সমাপতন। হাতের আঙুলে কথার অদৃশ্য ঢেউ।

সে আমাকে বলেছিল, তোমার নিঃশ্বাসে মিশে গিয়েছে শতবর্ষের আলোর ঝরনা, তোমার চুলে ঢেউ খেলে আসে আদমের সুপ্ত স্পর্শ। তোমার চোখে সুনিবির মদিরার তীব্র হলকা যে আমায় দিবানিশি কেবলই পোড়ায় আর পোড়ায়। বলেছিল, এক দিন এক ঘণ্টা এক সেকেন্ডও কেন ছেড়ে থাকতে পারি না, কী জাদু দিয়ে আমার মতো নীরস মানুষটাকে বশ করলে। বলেছিল, সে আমাকে প্রেম এনে দেবে, যা শুধু রঙিন বাবল হয়ে ক্ষণিক পরেই মিলিয়ে যাবে না শূন্যে, সারারাত সারাদিন সারাক্ষণ সারাজীবন আমায় ঘিরে থাকবে, আমাকে প্রতি মুহূর্তে ভরে রাখবে। সে বলেছিল... সে বলেছিল... সে— কথাগুলো ভাবতে থাকে তিয়াষা।

“কী রে? আবার কী ভাবতে বসলি? নে কফিটা তাড়াতাড়ি শেষ কর,’’ শিমরন নিজের কাপটা ঠকাস করে টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে জানালার পর্দাগুলো টেনে দিতে থাকে। টেনে টেনে বন্ধ করতে থাকে হাট করে খুলে থাকা জানালার পাল্লা।

তিয়াষার ধূসর রঙ শাড়ির আঁচল কাঁধ বেয়ে মাটিতে লুটোপুটি। আর কফির কাপ নিয়ে বসে থাকা সেই মূর্তির বুক ছুঁয়ে উঠে আসা কথার স্রোত সারা মেঝেময় ভাঙা স্বপ্নের আলপনা হয়ে আঁকিবুঁকি কাটতেই থাকে, কাটতেই থাকে।

বেল হয়ে যাওয়ার পর সবাই মিলে কোর্টরুমের বাইরে এলাম আমরা। তখনও পর্যন্ত তো কত খুশি ছিলাম বল? সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়েও আমার কাঁধ জড়িয়ে রেখেছিলে তুমি। আমি ভাবছিলাম সে দিন রাতেই আমরা রেজিস্ট্রির দিনটা ঠিক করে ফেলব। ওই সমস্ত ভবিষ্যতের কথা, বিয়ের কথা, এ সব তো আমরা কোনও দিন আগে আলোচনাই করিনি। আমি জানতাম তুমি আমারই, ঠিক যেমন সূর্য পশ্চিম আকাশের। সারা দিনের পথ পরিক্রমার পরে তাকে ফিরতেই হবে নিজস্ব গগনে। তেমনই জীবনের প্রথমটা কিছু ভ্রষ্ট পথে চলে গেলেও তুমি তো আমারই কাছে ফিরে এসেছ। এই আসাটাকে আইনের বাঁধনে যে কোনও দিন বেঁধে নেওয়া যাবে। আমার কোনও তাড়া ছিল না।

কিন্তু সেই যে তুমি বন্ধুদের দেখতে পেলে, সেই যে তুমি যেন মুহূর্তে পাল্টে গেলে, সেই যে আমার পরিচয় দিতে গিয়ে কী অনায়াসে তুলে নিয়ে এলে লাইফ ডেলি-র রিপোর্টার তিয়াষাকে, সেই যে আমায় অরুণের গাড়িতে উঠতে বলে কী অনায়াসে তুমি চলে গেলে অন্যদের নিয়ে, সেই দিন... সেই দিনই বোধহয় তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। সেই ছিল আমার প্রথম ধাক্কা।

কিন্তু বোকা আমি, মূর্খ আমি, তখনও বিশ্বাস করিনি আমার ভাঙা আয়নাটাকে। তার পরেও বার বার ভাঙা কাচেই মুখ দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছি। আমার অজস্র মেসেজের একটারও রিপ্লাই আসেনি। তোমাকে অনলাইন দেখতে পেয়ে কনট্যাক্ট করতে গিয়েছি, তুমি অফলাইন হয়েছ সঙ্গে সঙ্গে। হাসপাতালে ছুটে গেলেই শুনতে পেয়েছি তুমি ওটি-তে। বসে থেকে থেকে চলে এসেছি। ফোন করলে দু-এক বার ধরেছ, দায়সারা জবাব দিয়েছ। তার পর থেকে ফোন কাটতে শুরু করেছ। কিন্তু কেন? কেন অভিরূপ? এ ভাবে কেন চলে গেলে? কেন আমাকে বলে গেলে না? কেন এই অপমান? তোমাকে ভালবেসে এই অপমানটাই আমার একমাত্র পাওনা ছিল? না কি এটা পিয়াসের অভিশাপ? কিন্তু... ঈশ্বর জানেন, পিয়াসকে একটা দিনের জন্যও ঠকাইনি আমি... তা হলে কেন... কেন বুঝছ না আমার কত কষ্ট হচ্ছে? কেন এ ভাবে আমার সব কিছু শেষ করে দিচ্ছ!”

কাচ ভাঙার শব্দে চমকে ফিরে তাকায় শিমরন। উঠে দাঁড়িয়ে কফির কাপটা দেওয়ালে ছুড়ে মেরেছে তিয়াষা। অনেক ক্ষণ গুম হয়ে বসেছিল। এখন দেওয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়া কফির দাগটার দিকে, মেঝের ওপর ভাঙা কাপের টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে হিংস্র চোখে। যেন ওইখানে, ওই কাচের টুকরোগুলোর মধ্যে মিশে আছে অভিরূপ। শরীর কাঁপছে থরথর করে। গরম নিঃশ্বাসের হলকায় যেন পুরে ছারখার হয়ে যাবে ফ্ল্যাটের সব সজ্জা। ভিতরের সব আগুন এই মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে চাইছে নিষ্ফলা আক্রোশের রূপ ধরে। শিমরন মুহূর্তের হতবাক অবস্থা কাটিয়ে ছুটে এসে তিয়াষাকে জড়িয়ে ধরে বুকের ভিতর। ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে ফিরিয়ে আনতে চায় ওকে।

“অ্যাই...অ্যাই তিয়াষা... এ রকম করছিস কেন? শোন...তাকা...তাকা আমার দিকে... এ দিকে তাকা... উফ... এ রকম করবি জানলে কিছুতেই আমি একা আসতাম না... আয়... এখানে বোস এসে...আয়...এখানে বোস,’’ টেনে টেনে তিয়াষাকে নিয়ে আসতে চায় বিছানার দিকে শিমরন। ঠেলে বসাতে চায় তাকে। তিয়াষার এই অবস্থা অনুমান করতে পারেনি শিমরন। তাই সে বেশ চিন্তিত, কিছুটা ভীতও। কিন্তু বহু চেষ্টার পর, বহু সাধ্যসাধনার পর শিমরন তিয়াষাকে অফিসে নিয়ে আসতে পেরেছিল। তবে ওর সঙ্গে যে এসেছিল সে ঠিক সেই পুরনো তিয়াষা নয়। তিয়াষার সুগঠিত নদীর মতো শরীরে লেগে থাকত বিদ্যুৎ, গহন অন্ধকারের মতো একঢাল চুলে লেগে থাকত নেশা ভরা ছন্দ, যার হেঁটে যাওয়ায় মিশে থাকত হিমালয়ের শিখর জয়ের হাতছানি। শুধু মাত্র সেই শরীরটাই শিমরনের পাশে পাশে এসেছিল অফিসে, তিয়াষা মানুষটা নয়।

১৮

সমানে অকথ্য ভাষায় কানের কাছে গজগজ করে যাচ্ছিল বিপাশা। কখনও এ ঘরে কখনও ও ঘরে, কখনও বারান্দায়, যেখানে যেখানে অরুণ যাচ্ছে, তার পিছন পিছন বিপাশা অনর্গল মন্দ কথার ফুলঝুরি ছড়াতে ছড়াতে চলেছে। অরুণকে দেখে মনে হয় না তার কানে একটাও কথা ঢুকছে। কেমন একটা অস্বাভাবিক থমথমে মুখ নিয়ে জামা জুতো গেঞ্জি পরতে পরতে নিজেকে তৈরি করছিল অরুণ।

ঝগড়া করারও কিছু অলিখিত শর্ত আছে। প্রতিপক্ষ যদি একটাও প্রতিবাদ না করে, যদি সমানে নিক্ষিপ্ত বাছা বাছা বিষাক্ত তিরের একটাকেও প্রতিহত করার চেষ্টামাত্র না করে, তা হলে সেই ঝগড়ায় কোনও সুখ নেই, তা হলে সেই ঝগড়া আর দেওয়ালে মাথা কোটা সমার্থক। এত ক্ষণ ধরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বিপাশারও ক্লান্তি এসেছে বুঝি। সে আর পিছনে পিছনে নয়, একেবারে কোমরে হাত দিয়ে কুঁদুলে অশিক্ষিত মহিলার ভঙ্গিতে অরুণের সামনের রাস্তা আটকে দাঁড়ায়।

“ও...আচ্ছা... আমার কোনও কথার উত্তর দিচ্ছ না, তার মানে আমার সব কথা মেনে নিচ্ছ তাই তো? সত্যিই তুমি এমন কারও কাছে যাচ্ছ যার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক রয়েছে। তাই এত ফোনে ফুসফুস গুজগুজ... কাল দেখেছি... আজও সকাল থেকে দেখলাম...’’

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Books Literature Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy