গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকে বিদ্রোহী ছাত্রযুবরা বাংলার নবজাগরণের সামাজিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তোলার পদ্ধতিতে অনেক ত্রুটি ছিল। অনেক প্রসঙ্গ অসঙ্গত ছিল। কিন্তু তাঁদের প্রশ্নের অভিমুখ নিয়ে কোনও হেঁয়ালি ছিল না। সেই অভিমুখ ছিল নবজাগরণের শ্রেণিচরিত্র সম্পর্কিত। নবজাগরণের ধারক ও বাহকরা ভাবতেন তাঁদের বক্তব্য সমগ্র সমাজকল্যাণের জন্য নিয়োজিত। তাঁদের চিন্তা সর্বজনীন চিন্তা। তাঁদের কল্পনা সর্বজনের কল্পনা। নবজাগরণ সমগ্র সমাজের জাগরণ। নবজাগরণের ধারকরা সমাজের যে অংশ থেকে এসেছিলেন, তাঁদের সে যুগে বলা হত বাবু সম্প্রদায়। ধীরে ধীরে ভূসম্পর্করহিত, শিক্ষাসমৃদ্ধ, করণিক বৃত্তি আশ্রিত, বৈজ্ঞানিক মনস্কতাপ্রেমী রূপে এই স্তর সাধারণ ভাবে পরিচিত হল বাংলার মধ্যশ্রেণি রূপে। এই শ্রেণির সদস্যরা যুক্তিবাদী, স্বভাবগত ভাবে বামপন্থী, ভূমিসম্পর্ক থেকে বহু দিন বিচ্ছিন্ন। লেখাপড়া ভালবাসেন, কলম এবং মাথার সাহায্যে জীবন চালান, ভাবেন যে যুক্তি দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। এঁরাই মধ্যবিত্ত।
কায়িক শ্রম থেকে বিচ্ছিন্নতা, বিশেষ কিছু বৃত্তি নির্ভরতা, এবং নগরকেন্দ্রিক জীবন বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে বেশ কিছু দিক থেকে সঙ্কীর্ণ করেছে। অন্য দিকে, লেখাপড়ার প্রতি টান ও যুক্তিসর্বস্ব দৃষ্টি তাঁকে সর্বজনীন করেছে। এই বৈপরীত্য দিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর সর্বজনীনতা চিহ্নিত। নিজস্ব শ্রেণিস্বার্থ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকলেও বাঙালি মধ্যবিত্ত ভাবে তার ভাবনাই সমগ্র সমাজের ভাবনা। মধ্যবিত্তই সমাজের প্রতিনিধি। সে সমাজের শ্রেণিপার্থক্য, বর্ণপার্থক্য স্বীকার করে না, কারণ সে ভাবে সে এই বিভাজনের ঊর্ধ্বে।
ফলে যে কোনও আন্দোলনে অথবা শান্তিপ্রক্রিয়ার সম্পাদনায়, অথবা কোনও চুক্তি অর্জনে, অন্য যে কোনও দৃষ্টিভঙ্গিকে আংশিক প্রমাণ করে মধ্যশ্রেণি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ রূপে হাজির করে। মধ্যশ্রেণির এই ভূমিকা আজ এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে, আমরা তাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি। দার্শনিকরা ভেবেছেন, নানা ভাবে বিভক্ত এই সর্বজনীন শক্তির উদয় হয় ও প্রাধান্য আসে কী করে? কেউ ভেবেছেন আমলাবৃন্দ হল এই সর্বজনীন শ্রেণি, কেননা তাঁরা সমগ্র সমাজের স্বার্থে প্রশাসনের হাল ধরে থাকেন। কেউ ভেবেছিলেন আগের যুগের রাজারা ছিলেন সর্বজনীন শক্তি যাঁরা সমগ্র সমাজের প্রজাবৃন্দের হিত রক্ষা করতেন। আবার অনেকে মনে করেছেন, শ্রমিকরা হলেন সেই সর্বজনীন শ্রেণি। কিন্তু এই দার্শনিকরা বাঙালি মধ্যশ্রেণিকে দেখেননি বা সেই অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণের সুযোগ তাঁদের ঘটেনি। মধ্যশ্রেণির সর্বজনীনত্ব বাংলায় এক প্রশ্নাতীত বাস্তবতা।
মাসিক উপার্জন দিয়ে মধ্যশ্রেণির সংজ্ঞা নিরূপণ করা যায় না। দুই বৃহৎ যুযুধান শ্রেণির মাঝে এরা অবস্থান করে, এটুকুই বলা যায়। দুই বৃহৎ শ্রেণি— অর্থবান, সম্পত্তিশালী ধনতান্ত্রিক শ্রেণি এবং তার অধীনে কর্মরত বিশাল শ্রমিক ও শ্রমজীবী জনসাধারণ, এই দুইয়ের মাঝে যাঁরা রইলেন, তাঁরাই মধ্যশ্রেণি, তাঁরাই মধ্যবিত্ত।
তবে এঁদের মধ্যে পরিবর্তন আসছে। বুদ্ধিজীবী সৃষ্টির ক্ষমতা মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীদের বাদ দিলে সমাজ-স্বীকৃত বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কমছে। অন্য দিকে শিক্ষা, প্রযুক্তিগত শিক্ষণ, এবং সাংস্কৃতিক উৎপাদনে সাধারণ ঘর থেকে অনেক নতুন ছেলেমেয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। আলাদা করে বুদ্ধিজীবী রূপে কোনও স্তরকে স্বীকার করার তাগিদ আর আগের মতো নেই। এখন বহু লোক লেখাপড়া করেন, সাহিত্যচর্চা করেন, সাংস্কৃতিক উৎপাদনে যোগ দেন। এঁদের শুধু মধ্যবিত্ত অথবা মধ্যশ্রেণিভুক্ত বললে বাস্তবের বিকাশকে বোঝা যাবে না।
ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আর্থিক পুঁজির সংখ্যা যত বাড়ছে, মানসিক শ্রমনির্ভর লোকের সংখ্যা তত বাড়ছে। অফিস, কাছারি, স্কুল, কলেজ, ব্যাঙ্ক অথবা অন্য অর্থকরী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিনোদন শিল্পের মতো একাধিক পেশার অভূতপূর্ব প্রসার ঘটেছে। বিস্তৃত বিপণন শিল্প, সাংস্কৃতিক শিল্প অথবা প্রচারমাধ্যমে নিয়োজিত কর্মিবৃন্দ, এঁরা কোন শ্রেণির? শুধু মধ্যবিত্ত অভিধায় চিহ্নিত করলে সমাজের এই বিকাশকে বোঝা যাবে না। সমাজ রূপান্তরের চিন্তা বা কর্মসূচিও দিগ্ভ্রান্ত হবে।
বাংলার মধ্যশ্রেণি এই রকম এক বৈপরীত্যের সৃষ্টি এবং তজ্জনিত দোলাচলে চিহ্নিত। তারা জনসাধারণের কণ্ঠস্বর হতে চায়, অথচ সেই অভিপ্রায়ের এক নির্দিষ্ট শ্রেণিরূপ আছে। সংগ্রামের বিকাশের চরম মুহূর্তে কায়িক শ্রমে নিয়োজিত সমাজের সাধারণ স্বার্থকে পাশে সরিয়ে রেখে নিজস্ব স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে মধ্যশ্রেণি তুলে ধরে ‘সাধারণীকৃত স্বার্থ’ বলে।
সাম্প্রতিক আলোড়নে অথবা পূর্বে ঘটে যাওয়া নানা গণ-আন্দোলনে বার বার এই বাস্তবতা রক্ষা করা গেছে। তার অর্থ এই নয় যে, গণ-আন্দোলন সর্বদাই মধ্যশ্রেণি-কুক্ষিগত হবে অথবা হয়েছে। এই দেশে বা এই বাংলাতেই দৃষ্টান্ত আছে যেখানে আন্দোলন সাধারণ রূপ পেয়েছে। সর্বজনীন চরিত্র ধারণ করেছে।
নয়া উদারনৈতিক যুগে এই দ্বৈততা গণ-আন্দোলনের চরিত্রকে হয়তো অনেকটা পাল্টে দেবে। আগে সর্বহারা রাজনৈতিক আন্দোলন চাইত সামাজিক রূপান্তরের প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ নিজের আদলে বাস্তবায়িত করতে। এর জন্য সর্বহারা আন্দোলনকে অনেক মূল্য চোকাতে হয়েছে। বাকি সমাজ শ্রমিক রাজনীতির বিরুদ্ধে চলে গেছে। নয়া উদারনীতিবাদী ব্যবস্থায় মধ্যশ্রেণি চাইবে সমাজের রূপান্তর হোক তারই দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতির আদলে।
জনবাদী রাজনীতির ব্যাপকতার প্রেক্ষাপটে এবং তার বিপরীতে মধ্যশ্রেণির শক্তি আহরণ লক্ষণীয়। শুধু বাংলা নয়, ভারতবর্ষের অন্যত্র এই শক্তিবৃদ্ধি চোখে পড়বে। তার অর্থ এই নয় যে, কোনও এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের শক্তিবৃদ্ধি হবে। এক-এক স্থানে মধ্যশ্রেণির শক্তিবৃদ্ধির রাজনৈতিক রূপ এক-এক রকম হতে পারে। কিন্তু সমাজের নিম্নশ্রেণির থেকে উদ্ভূত রাজনীতি বা সাধারণ ভাবে লোকায়তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে মধ্যশ্রেণির এই উত্থান এক বাস্তব প্রবণতা। অন্য দেশেও এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। জনসাধারণের কে প্রতিনিধিত্ব করে? জনবাদীরা? না সাংস্কৃতিক শক্তি শিক্ষা ও জ্ঞানে বলীয়ান মধ্যশ্রেণি? কে সর্বজনীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার দাবিদার? জনবাদীদের সামাজিক পুঁজি বা সম্পদের অপ্রতুলতা এই লড়াইয়ে তাকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষে পরিণত করেছে। আগামী ইতিহাস জানাবে, আধিপত্য বিস্তারের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কে জয়ী হবে।
তবে যে বাস্তবতা স্পষ্ট তা হল, নগরের প্রসার, নাগরিক ক্ষমতার প্রসার, এবং মহানাগরিক অর্থনীতির প্রসার মধ্যশ্রেণিকে এক বিশেষ শক্তিতে বলীয়ান করেছে। প্রচার মাধ্যম, সাংস্কৃতিক মাধ্যম, প্রযুক্তিগত বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান এবং নিজস্ব গঠনের নমনীয়তা মধ্যশ্রেণিকে এক বিশেষ শক্তি প্রদান করেছে। ধনী ও সম্পত্তিশালী শ্রেণির বিরুদ্ধে মধ্যশ্রেণির এই সাংস্কৃতিক পুঁজি খুব একটা কাজে লাগে না। অথবা মধ্যশ্রেণি তা খুব একটা চায়ও না। সামাজিক আধিপত্যের যুদ্ধে মধ্যবিত্তের মূল সংগ্রাম সর্বহারা ও আধা সর্বহারার বিরুদ্ধে।
ছোট শহরে, আধা শহরে নয়, আধিপত্যের সংগ্রামের তীব্রতা মহানগরগুলিতে। মহানগরগুলিই আধিপত্যের প্রশ্নকে তীব্র করে তুলেছে। তার কারণ, মহানগরগুলিই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির এক চালিকাশক্তি। বিশ্ব জুড়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা ও দ্বন্দ্বগুলোকে এই মহানগরগুলি বাড়াচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে নাগরিক আন্দোলন আরও বাড়বে। এই জনসমাবেশগুলি মধ্যশ্রেণির নেতৃত্বের অপেক্ষা করবে নির্দিষ্ট অবয়বে আবির্ভূত হতে। সমাজমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক উপায় ছাড়া ভাবাবেগের প্রাবল্য স্থায়ী হয় না। আবেগ যত আন্দোলনের অন্তর্বস্তু হবে, তত প্রয়োজন পড়বে শিক্ষা, যুক্তি ও সাংস্কৃতিক রসদের।
সমাজের সাধারণ ইচ্ছার এ এক ধরনের বিস্থাপন। বাস্তবতা তখন যেন এক প্রতিদ্বন্দ্বী বাস্তবতা সৃষ্টি করে। মধ্যশ্রেণির চৈতন্য দর্পণের মায়াবী ক্ষমতায়, বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সমাজ বিহ্বল হয়ে পড়ে।
সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের এই জটিলতাকে মেনে নিয়েই এগোতে হবে। এক-এক নির্দিষ্ট মুহূর্তে এই জটিলতা সরে যায়। সামাজিক দ্বন্দ্বের তীব্রতার মাহেন্দ্রক্ষণে রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে যায় এবং আধিপত্যের সমস্যার সমাধানও হাজির হয়। সামাজিক সংঘর্ষের প্রক্রিয়াতেও কালবৈশাখীর ক্ষণ আসে। সেই তীব্র ক্ষণে বিশেষ কারিগরি বা প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক সামর্থ্য মধ্যশ্রেণির আধিপত্য বিস্তারের অভিলাষ পূরণে যথেষ্ট নাও হতে পারে।
তবে এ কথা ভোলার নয় যে মধ্যশ্রেণি ও নিম্নশ্রেণির মাঝে ফাটল যত বাড়তে থাকে তত চূড়ান্ত স্বৈরতন্ত্রের সম্ভাবনা শক্তিশালী হয়। প্রায় সর্বত্র ফ্যাসিবাদী অভিযানে মধ্যশ্রেণির সামর্থ্য সমাজের দরিদ্র শ্রেণিগুলির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। সারা বিশ্ব জুড়ে নয়া উদারনীতি অভিলাষের জোরে মধ্যশ্রেণি আজ বলীয়ান।
মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা উৎপাদনে, তাদের অভিপ্রায় বা স্বপ্নসৃষ্টিতে এবং এই অভিপ্রায় বা স্বপ্নের চরিত্র নির্ধারণে পুঁজিবাদীরা এই রকম সংস্কৃতিমান শক্তি আর কোথায়ই বা পাবে?
সমাজতাত্ত্বিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy