সকলের অলক্ষে বাংলাদেশে চাপাতির ঘায়ে খুন হয়ে গেলেন আর এক জন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, আইনের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ, এবং আশ্চর্যের কিছু নেই, ভোটবাজারে এ নিয়ে আলোড়ন শূন্য। আশ্চর্যের কিছু নেই, সময়ের দাম বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। এক বার গলা কাটলে মিছিল করা যায়, দ্বিতীয় বার খুন হলে টিভি চ্যানেলে প্যানেল ডিসকাশন, কিন্তু বার বার হলে নিউজ ভ্যালু গোল্লা। অভিজিৎ রায়ের হত্যার সময় আমরা যথেষ্ট চোখের জল ফেলেছি, ওয়াশিকুর বাবুর খুনের সময় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছি, কাঁহা তক একই জিনিস নিয়ে বারংবার এনার্জি খরচ করা যায়। হারাধনের দশটি ছেলে সবাই একে একে মরবে আর প্রত্যেকের উপরই সমান মনোযোগ দিয়ে কভার স্টোরি হবে, প্রত্যাশার তো একটা সীমা আছে?
এতে আমাদের আলাদা করে কোনও দোষ নেই, কারণ এই সইয়ে নেওয়াটা আদতে ‘সভ্যতা’র অবদান। খুন-জখমে নিস্পৃহতার অভ্যাস করিয়ে দেওয়াটা হল বিংশ শতাব্দীর মহৎ আবিষ্কার। লাশকাটা ঘরে ঘণ্টা দুই কাটিয়ে নিলে মৃতদেহের গন্ধ আর নাকে লাগে না। মাস খানেক প্র্যাকটিসের পর থ্যাঁতলানো ডেডবডি আর মাথাফাটা ঘিলু দেখে গা গুলোয় না। ধীরেসুস্থে শুরু করলে ক্রমশ সবই সয়ে যায়। ইতিহাসে এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ হল, এক-দুই দিয়ে শুরু করে, তার পর লাখে লাখে ইহুদিকে যখন জার্মানির নানা শহর থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে তুলে নিয়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পোরা হচ্ছিল, তাঁদের দীর্ঘ দিনের পাড়াপড়শিরা তখন সে কাণ্ড আড়চোখে একটু দেখে নিয়ে নিশ্চিন্তে সন্তানের চাঁদমুখে চুমু খেতেন। সোভিয়েত জমানায় চুপচাপ পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী এক দিন সাইবেরিয়ার উদ্দেশে হাওয়া হয়ে গেলে কারও ডিনারে কখনও কোনও বিঘ্ন ঘটেছে বলে তো শোনা যায়নি।
এ সবই বিংশ শতকের কারবার। তার আগে পৃথিবীতে গণহারে খুনজখম ছিল না তা নয়। রোমান আমলে স্পার্টাকাস আর তার সঙ্গীসাথীদের লাইন দিয়ে ক্রুশে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল, যাতে আপামর নগরবাসী দু’চোখ ভরে দেখতে পারে জ্যান্ত লোকগুলোর ছটফটিয়ে মরা। প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারা ছিল মধ্যযুগের মহোৎসব, আর হাল আমলের গিলোটিন আবিষ্কারই হয়েছিল গণহারে মানুষ মারার জন্য।
কিন্তু সে সব ছিল ঢাকঢোল পেটানো রাজকীয় ব্যাপার, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অংশ, ভয় দেখানোর স্পেকট্যাক্ল। একটা খুন করলে লোকে আঁতকে উঠবে, দ্বিতীয়টা হলে ভয়ংকর রেগে যাবে, কিন্তু পর পর বুক বাজিয়ে লাশ টপকে দিলে সেনসেশন ক্রমশ ভোঁতা হয়ে পুরোটাই অভ্যাস হয়ে যাবে— ঠান্ডা মাথার এই ক্যালকুলেশন একেবারেই বিংশ শতকোত্তর। এখন গোটা দুনিয়াটাই লাশকাটা ঘর। ডেডবডি পাশে নিয়েই আমরা ব্রেকফাস্টে লুচি-আলুদ্দম সাঁটাই, চ্যানেল সার্ফ করে টি-টোয়েন্টি দেখি। এই একবিংশ শতকে আমরা আসলে বাঁচি মর্গে, যেখানে অনেক দিন বসবাসের ফলে কোনও লাশের গন্ধই আর আলাদা করে টের পাওয়া যায় না।
bsaikat@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy