তিনিই সেই মানুষ, যিনি বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বলবো আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে।’ তাঁর সেই সাহস ছিল, মানুষকে অনুপ্রাণিত করে তোলার মতো অনমনীয় ব্যক্তিত্বের জোর ছিল। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান— বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠার আগেই তিনি এই নামটির সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব এক করেছিলেন। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। এই অর্থে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন।
প্রায় ৬৫ বছর আগের কথা। ১৯৫৫ সাল। অগস্ট মাসে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলছে করাচিতে। তারিখটি ছিল ২৫ অগস্ট। এক পর্যায়ে সংসদে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর গমগমে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে স্পিকারকে বললেন, ‘স্যর আপনি দেখবেন, ওরা পূর্ববাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব-পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার বলেছি, আপনারা এ দেশটাকে বাংলা নামে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম পরিবর্তন করতে চাইলে আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।’
১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয় পাকিস্তান। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত এ দেশের নাম ছিল ‘পূর্ববাংলা’। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে পূর্ববাংলার নতুন নামকরণ হয় পূর্ব-পাকিস্তান। সুতরাং এটা পরিষ্কার, পূর্ববাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তান করার যে চক্রান্ত চলছিল, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জাতীয় সংসদে তার প্রতিবাদ করেন। তিনি যে এই ভূখণ্ডের নামের ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন, এটাই তার প্রমাণ।
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে। তাদের অভিযোগ ছিল, শেখ মুজিব পূর্ব-পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে চাইছেন। এই মামলা দাঁড় করানোর জন্য যে কাগজপত্র প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তার মধ্যে ছিল বেনামে লেখা কতগুলো চিঠি ও একটি চিরকুট। এই চিরকুটে লেখা ছিল ‘বাংলাদেশ’। এ ভাবেই তিনি ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন।
ঘড়ির কাঁটার চলন অনুসারে: স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা
এর পরের ঘটনা ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর। দিনটি ছিল হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুদিন। সে দিনের আলোচনাসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, আর পূর্ব-পাকিস্তান নয়, আর পূর্ববাংলা নয়। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকও শহিদ সোহরাওয়ার্দির মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি— আজ থেকে বাঙালি জাতির এই আবাসভূমির নাম হবে ‘বাংলাদেশ’।
১৯৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি। সেই সভায় একটি ইস্তাহার পাঠ করা হয়। ইস্তাহারে ঘোষিত হয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে। ৫৪ হাজার ৫০৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার, সাত কোটি মানুষের আবাসভূমি, স্বাধীন ও সার্বভৌম এই রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। পল্টন ময়দানের লাখো বাঙালির জনসমুদ্রে সে দিন সেই ইস্তাহারের মাধ্যমে ঘোষিত হওয়া বাংলাদেশ স্বপ্ন থেকে বাস্তবে উঠে এসেছে।
এ বার ইতিহাসের অন্য প্রসঙ্গ। প্রখ্যাত মনীষী এস ওয়াজেদ আলী তাঁর ‘বাঙালি মুসলমান’ অভিভাষণে বলেছিলেন, বাঙালির, তা সে হিন্দুই হোক বা মুসলমান, ভবিষ্যৎ আশার কেন্দ্র হচ্ছে পূর্ববঙ্গ। যথাসময়ে প্রকৃত বাঙালি রাষ্ট্র এবং সমাজজীবন যে পূর্ববঙ্গে উর্বর ভূমিতেই মূর্ত হয়ে উঠবে, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত এস ওয়াজেদ আলীর ‘ভবিষ্যতের বাঙালি’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, প্রাকৃতিক কারণে ভারতবর্ষ যে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে, তার মধ্যে আমাদের বাংলাদেশ অন্যতম। আমাদের মনে হয়, প্রকৃতিদেবী ভারতের এই পূর্ব ভূখণ্ডে নতুন এক জাতির, নতুন এক সভ্যতার, নতুন এক জীবনধারার, নতুন এক কৃষ্টির, নতুন এক আদর্শের সৃষ্টি প্রয়াসে নিরত আছেন। এই বাঙালি জাতিও তেমনই ভবিষ্যৎ গৌরবের অস্পষ্ট ইঙ্গিত অবচেতনায় পেয়ে এক অব্যক্ত আনন্দানুভূতি অনুভব করেছে, বাঙালি ভবিষ্যতের পূর্ণতার রাজনীতির জন্য প্রতীক্ষা করছে, পরিপূর্ণ জীবনাদর্শের ও পূর্ণতম বিকাশের জন্য যেন বাঙালি এখনও প্রতীক্ষা করছে। অদূর ভবিষ্যতে সেই সহনীয় আদর্শ, সেই পরিপূর্ণ পরিকল্পনা, সেই অপরূপ ছবি তার মনে স্পষ্ট হয়ে উঠবেই, আর তার ফলে বাঙালি এক অভিনব জীবনের আস্বাদ পাবে এবং সেই শুভ দিন যখন আসবে, তখন বাঙালি কেবল ভারতের নয়, কেবল প্রাচ্য ভূখণ্ডের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হবে— সত্য, সুন্দর, শুভ জীবনপথের। বাঙালি এখন সেই মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে, যিনি তাকে এই গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবেন— ভগীরথের মতো এই বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম সুস্পষ্ট করে তুলবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমার ইতিহাসের সেই মহামানব বলে মনে হয়। তিনি বাঙালিকে তার গৌরবময় জীবনের সন্ধান দিয়েছেন। বাঙালি অভিনব জীবনের আস্বাদ পেয়েছে।
কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের (এখন মৌলানা আজাদ কলেজ) বোর্ডে আজও ১৯৪৫-৪৬ সালের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নাম (‘এম রহমান’), ‘পাকিস্তান নত, বাংলাদেশ মুক্ত’— ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ জীবনে ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন, এই দারিদ্রলাঞ্ছিত দেশে এক পরিত্রাণকর্তার দেখা পাবেন, যিনি মানুষকে পরম আশ্বাসের কথা শোনাবেন। যে পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ এই কথাগুলো বলেন, সেটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবু এই কথাও আমাকে বঙ্গবন্ধুর কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি আমাদের যে ভাবে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, মানুষ হিসেবে মানুষকে যে আশ্বাসের কথা শোনাতে চেয়েছিলেন, এ দেশে এমন আর কে চেয়েছেন!
তাঁর নির্দেশে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রই পাইনি, তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে তাঁর রাষ্ট্রভাষাকে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্যপদ লাভ করে। ১৯ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক শহরে আরও একশোরও বেশি পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল। রাষ্ট্রপুঞ্জে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বললেন, পৃথিবীর পার্লামেন্টে নতুন দেশ বাংলাদেশকে স্বাগতম। ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের ২৯তম নিয়মিত অধিবেশন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই অধিবেশনের এশিয়ার দেশগুলোর অন্যতম নেতা, যিনি প্রথম বক্তৃতা করেন। তাঁর অসাধারণ কণ্ঠস্বরে বাংলায় বক্তৃতা করলেন তিনি। ১৯১৩ সালে বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতার শুরুতে বলেছিলেন, বাঙালি জাতির জন্যে এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সত্যিই তো তাই। বঙ্গবন্ধু তাঁর বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ৬১ বছর পর আবার বিশ্বের মানুষের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
বাংলাদেশ যুদ্ধের পর ১৯৭২-এ ‘শিমলা চুক্তি’র সময় ইন্দিরা গাঁধী ও জুলফিকার আলি ভুট্টো
চল্লিশের দশকে মনীষী এস ওয়াজেদ আলী তাঁর প্রবন্ধে বাঙালির জন্য এক জন মহামানবের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমরা জানি না এস ওয়াজেদ আলীর লেখাটি তিনি পড়েছিলেন কি না। না পড়ে থাকলেও কোনও ক্ষতি নেই। বাঙালির প্রতি তাঁর আবেগ ছিল সীমাহীন, বাঙালিকে কেন্দ্র করে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল মৃত্তিকাসংলগ্ন এবং সমুদ্রসমান ভালবাসা দিয়ে এই জাতিকে গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেওয়ার স্বপ্নে তৈরি করেছিলেন নিজের সবটুকু। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, একটি ভাষাগত ও জাতিগত রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে তা এ সময়ের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ব জুড়ে যদি অনেক রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তা হলে আর কোনও বৃহৎ শক্তি থাকবে না। কেউ কারও ওপর কর্তৃত্ব করতে পারবে না। কল্যাণের রাষ্ট্র হবে সেগুলো। আগামী দিনের ছেলেমেয়েরা জানবে না বিশ্বযুদ্ধ কী! বাংলাদেশের মতো একটি একটি করে গড়ে উঠবে হাজারও রাষ্ট্র।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করতেন সৈয়দ আবদুস সামাদ। তিনি একটি সভায় তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে গেলে অনেকগুলো ছোট ছোট রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তিনি সে সব রাষ্ট্রের কারও কারও সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনারা একটি বড় দেশ থেকে বেরিয়ে এমন ছোট ছোট রাষ্ট্রে স্বাধীন হওয়ার কথা কী ভাবে ভাবলেন?’ ওঁদের অনেকে উত্তরে বলেছেন, ‘‘আমরা সোভিয়েটবাসীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করেছি। ওই ছোট্ট দেশটি স্বাধীন হতে পারলে আমরা পারব না কেন?’’ সামাদ আরও বলেন, তাঁর সঙ্গে এক কাশ্মীরি গেরিলা যোদ্ধার দেখা হয়েছিল। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্বাধীনতা কী ভাবে অর্জিত হবে বলে মনে করেন? সেই গেরিলা যোদ্ধা দ্বিধার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘দেখা যাক ভারত কী করে? কিংবা পাকিস্তান?’’ ডক্টর সামাদ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘স্বাধীনতা কি কেউ দিয়ে দেয়?’’ সেই গেরিলা যোদ্ধা তাঁর দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘আপনি না বাংলাদেশের মানুষ!’’
বঙ্গবন্ধু এ ভাবেই বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যান্য ছোট ছোট দেশের স্বাধীনতার প্রতীক করে তুলেছেন। যেমন জাতীয় ক্ষেত্রে, তেমন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ দু’টি সম্পূরক শব্দ। একটিকে ছাড়া অন্যটিকে ভাবাই যায় না। যত দিন বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে হবে। চেষ্টা করেও তাঁকে ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে মুছে ফেলা যাবে না। এ দুঃসাহস যদি কেউ দেখায়, সে ক্ষতি তাদের, গোটা জাতির। সে ক্ষতি আগামী দিনের বাংলাদেশের মানুষের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার কবি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির রাজনীতির কবি। মানুষ এ সত্য স্বীকার করে নিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy