Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

একটা [ভয়] কষ্ট লজ্জা

লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছি ঠায়। খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। বাঁ হাতটা এ বার ব্যথা করছে। এক ভাবে দুটো ছোট প্লাস্টিকের কৌটো ধরা। খুব মন দিয়ে ধরে রেখেছি। ঘরটায় এয়ারকন্ডিশনার চলছে, কিন্তু কাজ করছে কি? কেমন একটা অস্থির অস্থির গরম লাগছে। গ্যাস হয়েছে বোধ হয়। সেই সকালবেলায় বেরিয়েছি, কিছু খেতে পারিনি তো! এই লাইনে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন সবাই ভারী ভদ্র তো! কেন এত আস্তে এগোচ্ছে, কেউ জিজ্ঞেস করছেন না।

সঞ্চারী মুখোপাধ‌্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছি ঠায়। খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। বাঁ হাতটা এ বার ব্যথা করছে। এক ভাবে দুটো ছোট প্লাস্টিকের কৌটো ধরা। খুব মন দিয়ে ধরে রেখেছি। ঘরটায় এয়ারকন্ডিশনার চলছে, কিন্তু কাজ করছে কি? কেমন একটা অস্থির অস্থির গরম লাগছে। গ্যাস হয়েছে বোধ হয়। সেই সকালবেলায় বেরিয়েছি, কিছু খেতে পারিনি তো! এই লাইনে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন সবাই ভারী ভদ্র তো! কেন এত আস্তে এগোচ্ছে, কেউ জিজ্ঞেস করছেন না। অথচ ঘরের অন্যত্র ভীষণ তৎপরতা। কেউ ব্লাড দিতে ঢুকছেন, কেউ বিল করাচ্ছেন, কেউ রিপোর্ট নিতে ব্যস্ত।

আমার বাঁ হাতটা কি নড়ে গেল? এই রে, কিছু হবে না তো? হ্যাঁ, নির্দিষ্ট তরলে ডোবানো, গোল গোল লাম্পগুলো দুলে উঠল যেন। হ্যাঁ, লাম্প। যেগুলো আজ সকালে আমার প্রিয়জনের ঘাড়ের কাছ থেকে অপারেট করে বার করা হয়েছে। ডাক্তার বলছিলেন খুব মাইনর অপারেশন। বেশি ক্ষণ লাগবে না। উনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যাবেন। তাই কি?

আপাতত লড়াই করছি, আমার বাঁ হাতের দিকে কিছুতেই যেন চোখ না পড়ে যায়। মনে মনে অনেক আগেই আমার বাঁ হাতের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছি। ওটা নেই আমার সঙ্গে। ওই বাঁ হাতে ধরা কৌটো দুটোই আমায় অবশ করে দিচ্ছে। ওই দুটোর মধ্যেই আসলে আছে আমার প্রিয়জনের পরবর্তী জীবনের ব্লুপ্রিন্ট। আমার অবশ ঠান্ডা মন একটা কথাই অনবরত চেলে যাচ্ছিল নিরন্তর— না না, ঠিক হয়ে যাবে। আজকাল তো সব অপারেশনের পর বায়োপ্‌সি করাতে হয়। এটাও তা-ই, রুটিন।

‘আচ্ছা, কবে পাওয়া যাবে রিপোর্ট?’ আমার গলা থেকে প্রায় আওয়াজ বেরচ্ছেই না। তবু প্রশ্নটা বুঝে নিয়ে খুব যত্ন করে জবাব দিলেন ও-পারের গ্লাভস পরা ভদ্রলোক, যিনি ওই অমোঘ প্লাস্টিকের কৌটোর মধ্যে ওই লাম্পগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন। ‘ধরুন দিন দশেক। আসলে পুজো পড়ে যাচ্ছে তো। তবু চেষ্টা করব পুজোর আগেই যদি দিয়ে দেওয়া যায়। এই দুটোই কৌটো?’ ‘হ্যাঁ, আর তো কিছু দেননি। এই যে লিখে দিয়েছেন কী টেস্ট করাতে হবে।’

খুব মৃদু হাসলেন ভদ্রলোক এক বার আমার দিকে তাকিয়ে। বুঝলাম এতগুলো মানুষকে রোজ কী-ই বা বলবেন, সেই জন্যই হয়তো এই হাসিটা রপ্ত করেছেন। যা থেকে আসলে কিছুই বোঝা যায় না। না পজিটিভ না নেগেটিভ।

এ বার আমি এক বার আমার পেছনের লাইনটার দিকে তাকালাম। সবার হাতে ওই গোছেরই কৌটো। সবাই প্রিয়জনের কাটা প্রত্যঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আশ্চর্য, জিনিসগুলো এত দিন দেহের ভিতর ছিল, এতটা জরুরি বা নিষ্ঠুর মনে হয়নি তো। হঠাৎ ফাঁকতালে এখন তারা হয়ে উঠেছে নিয়ন্তা। আমার প্রতিটি চিন্তা এখন গচ্ছিত ওই লাম্পগুলোর কাছে। যে চোরা গলি ধরেই পালাতে চাই না কেন, বাঁক ঘুরে দেখি, ওরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার পেট গোলানো, আমার মাথা ঝিমঝিম, আমার অখিদে, নার্সিংহোমে আমার প্রিয়জনের মুখ, অন্যের সামনে নিজেকে সাহসী দেখানোর সব খুঁটিনাটি ওই তরলে ডোবানো লাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে।

আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, আমায় ছেড়ে দাও না গো। যেন জল বাড়ছে, নাক অবধি উঠে এসেছে। ‘দিদি, আপনার কি হয়ে গেছে?’ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ব্যাকুল মুখ। প্রিয়জনের কাটা প্রত্যঙ্গ জমা দেবে।

অন্য বিষয়গুলি:

sanchari mukhopadhyay operation light kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE