ছবি: কুনাল বর্মণ।
তমা একটু অবাক হয়, “ঘুমোচ্ছে না তো কী করছে? দিদির সঙ্গে ফিসফিস করে গল্প করছে হয়তো।”
বল্লাল শ্বাস ফেলে বলে, “দিদির সঙ্গে গল্প করছে না।”
“তা হলে কী করছে?”
“সেটা আপনাকে বলা যাবে না।”
“বলা যাবে না কেন?”
“সব কথা বলা যায় না। সব কিছু দেখাও যায় না। আপনি কি সব কিছু দেখেছেন?”
“আমি কী দেখিনি বলুন তো? জানেন বল্লালবাবু, এটা আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি যেগুলো দেখার, বোঝার, সাবধান হওয়ার, সেগুলো ঠিক সময়ে দেখতেই পাই না। ভুল করে ফেলি। যাকগে, বাদ দিন, বলুন কী দেখতে পাইনি।”
“বাদ দিন তো। দেখুন কত রাত হয়ে গেল। একটা ম্যাজিক দেখবেন?”
“আপনি কি কলকাতার জাদুকর? না মুন্সিয়ারির? দেখান, ম্যাজিক দেখান।”
“আপনি চোখ বন্ধ করে বসুন। আমি এক-এক করে ডাইনিং-এর সব আলো নিভিয়ে দিচ্ছি।”
“এ মা! অন্ধকার হয়ে যাবে তো!”
“অন্ধকারেই তো সবচেয়ে ভাল দেখা যায়, জানেন না? একটু সবুর করুন!”
“তাই? অন্ধকারেই ভাল দেখা যায়? যা! সব তো ডুবে গেল আঁধারে। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না বল্লালবাবু।”
“আপনাকে তো বললাম চোখ বন্ধ রাখতে, দেখার চেষ্টা করছেন কেন? চোখ বন্ধ করুন তমা।”
“করে দিলাম। কী অন্ধকার! কী সাঙ্ঘাতিক! আপনি কী করছেন ইতিহাসবাবু? দূরে যাবেন না, ভয় করছে।”
“আমি কাচের গায়ে লেপ্টে থাকা ভারী ভারী পর্দাগুলো সরিয়ে দিচ্ছি।”
“আমি কিন্তু চোখ খুলিনি। পর্দা সরাচ্ছেন কেন বল্লাল? চাঁদ উঠেছে? চাঁদের আলো কি পড়েছে পাহাড়চুড়োয়? আমি কি চোখ খুলব এ বার?”
“না, এখন চোখ খুলবেন না। সব পর্দা সরানো হয়নি। চাঁদ এখনও ওঠেনি তমা। দেরি আছে। দেরি আছে চাঁদের আলো ওই পাহাড়চুড়োয় ছড়িয়ে পড়তে। তারা এখনও সাজগোজ সেরে তৈরি হয়নি আপনাকে দেখা দেওয়ার জন্য। আর একটু অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে। নিন, এ বার চোখ খুলুন।”
বিস্ময় দৃশ্য
চোখ খুলেই হতবাক হয়ে যায় তমা। কালো মখমলের মতো আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা গিজগিজ করছে। আকাশটাও গাঢ়তম কৃষ্ণবর্ণ এবং সেখানে হিরের মতো দ্যুতি নিয়ে জ্বলজ্বল করছে জ্যোতিষ্করাজি। পঞ্চচুল্লির সাজ বাকি থাকায় তারাই যেন তাদের রূপের ডালি ভরে নিয়ে এসে হাজির হল তমার দরবারে। কলকাতার আকাশে এ দৃশ্য সে কখনও দেখেনি। এত বড় তারারাও তাকে আগে কখনও দেখা দেয়নি। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল৷ দ্রুতপায়ে এগিয়ে কাচের দেওয়ালে হাত ঠেকিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “অপূর্ব! এ কী দৃশ্য আমায় দেখালেন বল্লাল! আমি সারা জীবন ঋণী থাকব, কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে। শুধু আলো নেভানো আর পর্দা সরানোতেই এই অপার্থিব সম্পদ পেলাম! আমি জীবনে ভুলব না এই উপহারের কথা!”
বলতে বলতে ঘাড় ঘুরিয়ে তমা দেখল, বল্লালও তিন হাত দূরে কাচের দেওয়ালে নাক ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। সে দু’পা এগিয়ে বল্লালের হাত দুটো ধরে একটু চাপ দিল। বল্লাল কি অন্যমনস্ক হয়েছিল? সে বলল, “দেখলেন?”
হাত সরিয়ে তমা বলল, “দেখে দেখেও মন ভরছে না যে!”
বল্লাল বলল, “হাজার হাজার বছর ধরে রোজ এই দৃশ্য তৈরি হয় এখানে! আর আমরা? টাকা, বিনিয়োগ, শেয়ার বাজার, ডলারের দর হিসেব করে করে জীবন কাটিয়ে দিলাম!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বল্লাল বলল, “চলুন, বসি... আলো জ্বালিয়ে পর্দা টেনে দেব?”
দূরের দিকে তাকিয়ে তমা বলল, “আলো জ্বললে ম্যাজিক থাকবে না। কোথাও কোনও আলোর চিহ্ন নেই। তাই আকাশের এই রূপ দেখা গেল!”
বল্লাল বলল, “এখানে দূষণও প্রায় নেই।”
চেয়ারে এসে বসল তমা। বলল, “আলো জ্বালতে হবে না। অন্ধকারটাই থাক। ভাল লাগছে,” বলে ডাইনিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আশ্চর্য! যে অন্ধকারকে ঘন, নিকষ বলে মনে হয়েছিল, সেটা কেমন বদলে গেল! আমি এখন ডাইনিংয়ের সবটাই দেখতে পাচ্ছি। আপনি ঠিক বলেছেন। অন্ধকারেই ভাল দেখা যায়।”
খানিক ক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। তমা তার চিবুক রাখে টেবিলে। বল্লাল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। এখন তারা আর মুখোমুখি নয়। দু’জনেই কিছুটা করে চেয়ার দুটো ঘুরিয়ে নিয়েছে। তাদের চোখ জানলার দিকে, যেখানে কাচের পাঁচিল পেরিয়ে দীর্ঘ আকাশে অনড় দাঁড়িয়ে বিপুলায়তন ব্রহ্মাণ্ডের বিন্দুবৎ উপস্থিতি। সে দিকে তাকিয়ে ফের সোজা হয়ে বসে তমা। তার পর বলে, “কলকাতায় এই দৃশ্য দেখা গেলে কী হত জানেন?”
উত্তর না দিয়ে তমার দিকে তাকাল বল্লাল।
অন্ধকারের সংলাপ
নিচু গলায় স্পষ্ট উচ্চারণে তমা বলছে তার কথা, “যারা দিন কেটে যাওয়ার পর পাওনাগণ্ডার হিসেব নিয়ে বসে, চাওয়া-পাওয়ার তালিকায় টিক দেয়, তারা হয়তো সে সব বন্ধ করে একটু স্বস্তির শ্বাস নিতে পারত। হয়তো আকাশের দিতে দু’দণ্ড তাকিয়ে এক বুক সতেজ শ্বাস নিয়ে বলতে পারত, ‘দূর, বাদ দাও তো সব ছেঁদো কথা। চলো নতুন করে শুরু করি।’”
“সেটা তো এখনও করতে পারেন তমা। এখান থেকে মুঠোয় ভরে নিন তারাদের আশীর্বাদ, এক বুক শ্বাসে ভরে নিন প্রাচীন বনস্পতির ভালবাসা, তার পর সেই ছোঁয়া নিয়ে গিয়ে ফেলুন শহরের জুটির মধ্যে। দেখবেন, সব আবার ঠিক হয়ে যাবে।”
“আপনি জানেন না বল্লাল, এতটা সহজ নয়। আপনার জানার কথাও নয়। সুতোর জট তখনই ছাড়ানো যায়, যখন দুটো মুখ দিয়ে তা ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।”
“চেষ্টাটা শুরু হোক না। দেখবেন তখন অন্য মুখও ঠিক চলে আসবে জট ছাড়ানোর জন্য।”
“কী অদ্ভুত না বল্লাল! আপনার সঙ্গে আমার একান্তে কথা এখনও একশো ঘণ্টাও হয়নি, অথচ আপনাকে কত আপন লাগছে। মনে হচ্ছে, সব কথা অকপটে বলতে পারি আপনাকে। জানেন, আপনার মধ্যে একটা নীরব আত্মবিশ্বাস আছে। সেটা ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হয় আপনার আশপাশে থাকা লোকজনের মধ্যেও। হ্যাঁ, আমার মধ্যেও। আপনি জানেন না, একটা বিশেষ নম্বরে গত পাঁচ দিন আমি ফোন করিনি। আমি যে এটা পারব, ছ’মাস বা ছ’দিন আগে আমি সেটা কল্পনাও করতে পারতাম না। কিন্তু পারলাম। শুধু তাই নয়, যে চিন্তা সব সময় মাথায় ঘুরত, সেটাও দূর হয়ে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে, আরে, আমি তো ওই সব চিন্তা করছিও না।”
“বৈপ্লবিক পরিবর্তন!”
“আপনি কথাটা কেন বলছেন, আমি জানি। হ্যাঁ, বিপ্লবকে নিয়েই আলোচনা। কিন্তু আমি তো পারলাম বল্লাল! সেটা আপনারই জন্য। আর হয়তো এই মুন্সিয়ারির জন্য।”
“অথবা হয়তো গরিমার সঙ্গে সময় কম কাটানোর জন্য।”
“আপনি খুব ধরে ফেলতে পারেন তো মানুষকে! এটাও ঠিক বললেন। আমি আর গরিমা যত ক্ষণ এক সঙ্গে থাকি, একে অপরের সমস্যা নিয়ে কথা বলি। ওরও জট, আমারও জট। এখানে আসার পর
ওর সঙ্গে এই সব কথা কিন্তু একটাও হয়নি, আচ্ছা, ও এ সব কথা ভুলে গেল কোন জাদুতে? আপনি
তো ওকে ম্যাজিক দেখাননি। ওর কথা কী
বলছিলেন আপনি?”
“আপনাকে একটা গল্প বলি তমা।”
“আপনার কলেজ জীবনের ঘটনা?”
“না, ঘটনা নয়, গল্প। নির্ভেজাল গল্প। তীর্থযাত্রীদের গল্প।”
“বলুন। মুন্সিয়ারির আকাশের নীচে পঞ্চচুল্লি শৃঙ্গের সামনে দেবভূমিতে আপনার থেকে তীর্থযাত্রার গল্প শুনি।”
“এক বার এক দল লোক তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছিল। বুঝতেই পারছেন, অনেক দিন আগের কথা। দলের মধ্যে সওদাগর ছিল, পুরোহিত ছিল, ধনী কৃষক ছিল, হাটের বণিক, মাছ ব্যবসায়ীও ছিল। তারা হেঁটে তীর্থস্থানের দিকে যাচ্ছিল। পথ বেশ কয়েক দিনের। এক দিন পুরোহিতের কিশোরী কন্যা বলল, ‘বাবা আমাদের সঙ্গে ওই চন্দনা পাখিটাও কি তীর্থে চলেছে? আমি রোজ দেখি, ও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে।’ পুরোহিত বললেন, ‘তা কখনও হয় না কি? তুমি অন্য পাখি দেখেছ।’ মেয়ে বলল, ‘না বাবা, তুমিও দেখো, এই পাখির লেজের কাছে কাটা দাগ আছে।” দীর্ঘ পথ হাঁটার সময় যাত্রীরা মাঝেমাঝেই বিশ্রাম নেয়, কোনও চটিতে বা সরাইখানায়। তখনও তেমনই কোনও জায়গায় সকলে বিশ্রাম নিচ্ছিল। মেয়ের আঙুল লক্ষ করে পুরোহিত দেখল, একটি সবুজ রঙের চন্দনা গাছের ডালে বসে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আবার এক-দু’ঘণ্টা হাঁটার পর তারা থামল। পুরোহিত ভুলে গিয়েছিল চন্দনার প্রসঙ্গ। মেয়ে তাকে দেখাল একটা গাছের ডালে পাখিটা বসে আছে। পুরোহিতেরও মনে হল, এ পাখি একই পাখি! মনে হল, এ পাখি তাদের দিকেই তাকিয়ে। মনে হল, পক্ষীসুলভ চপলতা, ওড়াউড়ি এর নেই। এ যেন তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। তা হলে কি তার মধ্যে ধর্মভাব জাগ্রত হল? সে কি তীর্থ করতে চায়? পুরোহিত ধার্মিক হলেও বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন। পাখির দৈবভাবে তার বিশ্বাস ছিল না। তার মনে হল এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও রহস্য আছে।”
“বল্লালবাবু, আপনাকে এই ক’দিন দেখে আমার মনে হয়, আপনার গল্পও নিছক গল্প নয়। আমার কিন্তু বুক কাঁপতে শুরু করেছে, গল্প শেষ হলে দেখব আমারই কোনও অন্যায় নিয়ে আপনি গল্প করে হয়তো ঠুকে দিলেন।”
“না তমা ম্যাডাম, আমি হলফ করে বলছি, এখানে আপনার কোনও প্রসঙ্গ নেই। আর দু’দিনের পরিচয়ে কাউকে যদি বিশ্বাস করতে পারেন, তা হলে তাকে বন্ধু বলে ধরে নিন।”
“সেখানেও কেমন যেন লাগছে। কেন যেন বার বার মনে হচ্ছে আপনার অন্য নাম, অন্য পরিচয় আছে। যেন এই হাঁটা, কথা বলা আমার আগে দেখা, আগে শোনা। প্রথম পরিচয় যেন নয়। যাকগে, বাদ দিন। বলুন চন্দনার কথা। তার পর কী হল?”
“পুরোহিত পরের দিনটা লক্ষ করে নিশ্চিত হল, একই চন্দনা তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। নিশ্চিত হল এবং সন্দিগ্ধ হল। পরের দিন সে তীর্থযাত্রীদের সকলকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। তার পর সে সমাধান করল সেই সমস্যার।”
“সমাধানের কথা শুনতে আমার ভয় করছে কেন বল্লালবাবু? কেন মনে হচ্ছে, যা চলছে তা চলাই ভাল ছিল, কী দরকার খুঁচিয়ে!”
“কারণ আপনি নিজের বিষয়টাকে ওই ভাবে জিইয়ে রাখতে চাইছেন। যা-ই হোক, আবার গল্পে ফিরে আসি। পুরোহিত পর্যবেক্ষণ করে বুঝল, সওদাগরের কিশোরপুত্র যে ভাবে হোক, একটা চন্দনা পাখি ধরেছে। তাকে খাঁচার মধ্যে পুরে থলি চাপা দিয়ে রেখেছে সে। তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে বন্দি সেই পাখি। সেই চন্দনার সঙ্গীও তাই সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। শেষে পুরোহিত তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে পাখিটাকে মুক্ত করল। সে ডানা মেলল সেই আকাশে, তার পর দু’জনে এক সঙ্গে মিলিয়ে গেল দূরে। আর কখনও একা চন্দনাকে দেখা যায়নি তীর্থযাত্রীদের আশপাশে।”
“এর অন্তনির্হিত বার্তা?”
“হাওড়া থেকে বাঘ এক্সপ্রেস চড়ে রওনা দিয়েছিল একদল তীর্থযাত্রী।”
“দিয়েছিল।”
“সেই তীর্থযাত্রীদের বাষ্পশকট কোথাও কোথাও থেমেছিল বিশ্রামের জন্য।”
“থেমেছিল।”
“সেখানে একটি পুরুষ চন্দনা দূর থেকে তীর্থযাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছিল। বার্তা পাঠাচ্ছিল।”
“সেখানে তো অত জন তীর্থযাত্রী। আর কে-ই বা চন্দনাকে লুকিয়ে রেখেছে কী করে বুঝব?”
“এ চন্দনা বন্দি নয়। শহরে বন্দি হলেও হতে পারে, অন্তত ভ্রমণকালে তো নয়ই! সেই চন্দনাও লুকিয়ে লুকিয়ে একবার ছুঁয়ে যায় তার চন্দনপুরুষকে। হয়তো না ছুঁলেও ছুড়ে দেয় তার দৃষ্টি। দৃষ্টিতেও তো বয়ে যায় ভালবাসার নদী।”
“আমি কিছু বুঝতে পারছি না বল্লাল। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আপনি কী বলছেন?”
“কখনও ফোন করে সে। চন্দনা সবার সামনে সেই ফোন ধরতে পারে না, চায়ও না। সে একটু দূরে গিয়ে হাতের আবডালে ঠোঁট রেখে মনের কথা বলে। হু হু করে ট্রেন চলে। তারই একটা খোপ থেকে অন্য খোপে কথা চলে পাখির ভাষায়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy