শান্তিকামী: ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ (১৯৩০) ছবির দৃশ্য। ডান দিকে, প্রথম জীবনে পুরোদস্তুর সামরিক পোশাকে ছবির কাহিনিকার এরিখ মারিয়া রেমার্ক
দুজনেরই জন্ম নিম্নবিত্ত রোমান ক্যাথলিক পরিবারে। দুজনেই বিদ্যালয়ের পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখে যোগ দেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। লড়াইয়ের ময়দানে দুজনেই গোলার আঘাতে আহত হয়ে ভর্তি হয়েছেন সামরিক হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে ফের যুদ্ধ করেছেন। প্রাণ বাজি রেখে শত্রুদের দিকে ছুড়েছেন গোলা-গুলি-গ্রেনেড। মুক্ত রণাঙ্গনে দেখেছেন, মানুষের হাতে মানুষের নৃশংস হত্যা। দুজনেই দেখেছেন মানুষের শোচনীয় বিপর্যয়, কিন্তু বেছে নিয়েছেন আলাদা রাস্তা। যুদ্ধফেরত প্রথম সৈনিক, সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠার ইমেজ তৈরিতে ব্যস্ত হলেন। অন্য জন ঝাঁপিয়ে পড়লেন শান্তিকামী মানুষের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে। প্রথম জন জার্মানির নাৎসি নেতা, অ্যাডলফ হিটলার। দ্বিতীয় জন, বিশ শতকের অন্যতম যুদ্ধবিরোধী জার্মান সৈনিক-সাহিত্যিক— এরিখ মারিয়া রেমার্ক।
জার্মানির ওস্নাব্রুক শহরে ১৮৯৮ সালের ২২ জুন রেমার্কের জন্ম। বই বাঁধাইয়ের কাজ করতেন তাঁর বাবা। মা ছিলেন গৃহবধূ। তিন ভাইবোনের মধ্যে রেমার্ক বড়। দুই বোন ছোট। যুদ্ধ থেকে ফিরে পেটের দায়ে গ্রহণ করেছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, পাথর খোদাই, রেসিং কার ড্রাইভিং, গ্রন্থাগারিক, সাংবাদিকতার মতো বিচিত্র পেশা, কোথাও থিতু হতে পারেননি স্বাধীনচেতা রেমার্ক।
১৯২৫-এ প্রথম বিয়ে। হিটলারের অত্যাচার থেকে বাঁচতে সুইটজ়ারল্যান্ডের পোর্তো রোঙ্কো-তে বাগান বাড়ি কিনে দেশ ত্যাগ ১৯৩৩-এ। ১৯৩৭ সালে প্রেমে পড়েন নায়িকা মার্লিন ডিয়েট্রিশ-এর। বছর তিনেকের সম্পর্ক। একে অপরকে লেখা চিঠিপত্রের সঙ্কলন ‘টেল মি দ্যাট ইউ লাভ মি’ (২০০৩) গ্রন্থে ধরা আছে তাঁদের সেই প্রেমের ডালপালা। ১৯৪৭-এ আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভের পর সেখানে কিছু কাল বসবাস করেন। তার পর ফিরে আসেন সুইটজ়ারল্যান্ডে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে চূড়ান্ত আইনি বিচ্ছেদ ১৯৫৭ সালে। ১৯৫৮-তে ফের বিয়ে অভিনেত্রী পলেত গদার-কে। লোকার্নোর সেন্ট অ্যাগনিস হাসপাতালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে সৈনিক-লেখক এরিখ মারিয়া রেমার্ক মারা যান ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭০-এ। মৃত্যুর পাঁচ দশক পরেও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে অস্থির পৃথিবী খুঁজে পায় স্বাধীনতা-ভালবাসা-বন্ধুত্ব, যা রেমার্কীয় দর্শনের সারকথা।
রেমার্কের যুদ্ধবিরোধী যোদ্ধা হয়ে ওঠার ইতিহাস উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। যোদ্ধা-জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লিখেছিলেন কালজয়ী আখ্যান ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ (১৯২৮) ও ‘রোডব্যাক’ (১৯৩১)। প্রথম আখ্যানের সৈনিক-চরিত্র পল ব্রমারের আপসহীন মনোভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধের ভয়ে আতঙ্কিত বিশ্ববাসী যেন ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেল। ক্রমশ আমজনতা চিনতে শিখল নিজেদের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা, খুঁজে পেল নিজস্ব ভুবনে নিরাপদ বসবাসের চাবিকাঠি। মহাযুদ্ধ অকালে কেড়ে নেয় পল ব্রমারের স্কুল-জীবন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ক্যান্টোরেক হয়ে ওঠেন যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রশক্তির আড়কাঠি। তাঁর মহান পিতৃভূমি রক্ষার উদ্দীপক ভাষণে অনুপ্রাণিত শ্রেণিকক্ষ শেষ পর্যন্ত হাঁটা দেয় হিংসা, হত্যা, রক্তপাত জর্জরিত রণাঙ্গনে। পরিবার-সমাজ-সম্পর্ক অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ফেলে রেখে রাইফেল কাঁধে দাঁড়িয়ে পড়ে শত্রুসেনার মুখোমুখি। ক্রমশ নিষ্পাপ যৌবন বুঝতে পারে, দেশ-দশ নয়, এই মহাযুদ্ধের পিছনে লুকিয়ে আছে যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রপরিচালকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আর কায়েমি স্বার্থ। যারা কোটি কোটি নিরীহ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, ‘...যুদ্ধ লাগলে যাদের হাসি কান পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়, হয়তো তাদের জন্য’-ই এত ক্ষয়, হিংসা, বিদ্বেষ।
শুধু শিক্ষিত-দীক্ষিত পাঠকই নয়, সামাজিক ন্যায় ও নিরাপত্তায় বিশ্বাসী মানুষের মধ্যেও রেমার্কের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল এই কাহিনি থেকে নির্মিত সিনেমার সৌজন্যে। অস্কার-মঞ্চে সেরা ছবি, সিনেম্যাটোগ্রাফি আর পরিচালক-সহ একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত হল ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। এই বইয়ের প্রথম জার্মান সংস্করণ বিক্রি হয়েছিল দেড় লক্ষ কপি। তিন বছরের মধ্যে ইংরেজি, রুশ, স্প্যানিশ, রোমানিয়া, ফরাসি-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হল এই কাহিনি। যুদ্ধবিরোধী জনগণ বিপন্ন সময়কে বোঝাপড়ার সাহস ও অবলম্বন খুঁজে পেলেন এই আখ্যানে। ধ্বংসযজ্ঞে সক্রিয় ‘যুদ্ধবাজ’ হিটলার নিজের ‘ঘাতক’ চেহারা আর মতলব চিনতে পেরেছিলেন আর্নেস্ট হেমিংয়ে, টমাস মান, জ্যাক লন্ডন প্রমুখের স্বৈরাচার-বিরোধী লেখনীতে। সেই জন্যই পোড়ানো হল তাঁদের বইপত্র। নিষিদ্ধ করা হল রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, ‘রোড ব্যাক’ এর মতো আগুনে লেখালিখি। ১৯৩৮-এ বাতিল করা হল তাঁর স্বদেশের নাগরিকত্ব। যদিও ১৯৩৩-এই তিনি দেশান্তরী হয়ে সুইটজ়ারল্যান্ড থেকে ফ্রান্স, আমেরিকা থেকে পর্তুগাল— বিশ্বের নানা প্রান্তে খুঁজেছেন এক টুকরো শান্তির আশ্রয়। রেমার্কীয় জীবনদর্শনের এক পিঠে আছে দেশের উন্নতির ছকে যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনেতাদের গোষ্ঠী-স্বার্থ, অন্ধ জাতিদম্ভ, বিশ্ববাণিজ্যে খবরদারি ও সামরিক শক্তি জাহিরের গোপন বাসনা, অন্য দিকে বিনা অপরাধে স্বজনহারা যুদ্ধবিধ্বস্ত নির্বাক আহত জনগণ। তাঁর কলমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে মহাযুদ্ধে সংক্রমিত অসুখের বহুমাত্রিক রাজনীতি। বহু স্বরের হাসি-কান্না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরাজিত জার্মানিতে বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাঙ্ক ফেল, দারিদ্র, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি কারণে কাজের অভাব ও মন্দা তীব্র হয়ে ওঠে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি নাৎসি পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে ইহুদি ও কমিউনিস্ট-বিদ্বেষের দাবানল। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা প্রাক্তন সেনারা। তখন বেঁচে থাকার শর্তে গণবিক্ষোভে ফুঁসে উঠে প্রতিবাদী ফৌজিরা। সমকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা আর দিশাহীন জার্মান অর্থনীতির রুগ্ণ পরিবেশে, সক্ষম পুরুষেরা উপযুক্ত কাজ না পেয়ে কলকারখানা, জুয়া, রেস, রেস্তরাঁর ওয়েটার, কনসার্টের সহায়ক, পিয়ানোবাদক... এই সব খুচরো এবং অনিশ্চিত জীবিকা গ্রহণে বাধ্য হলেন। মেয়েদের দিন গুজরানের জন্য হয়ে উঠতে হল বারের গায়িকা, অভ্যর্থনাকারী, পরিচারিকা, যৌনকর্মী, চিকিৎসালয় ও গির্জার সেবিকা ইত্যাদি।
সৈনিক রেমার্ক দেখেছিলেন, যুদ্ধে উন্মত্ত ফ্যাসিস্ট নাৎসি শক্তি যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়াও তাদের বিরোধী শক্তি কিংবা কণ্ঠকে ঘায়েল করতে তৈরি করেছে নানা নকশা। বিরোধী মতাদর্শে বিশ্বাসী ও যুদ্ধবন্দিদের ওপর প্রয়োগ করা হল বর্বর শারীরিক নির্যাতন, জীবাণু-আগুন-বৈদ্যুতিন শক-বিষাক্ত গ্যাসের মতো অপ্রচলিত হাতিয়ার। হিটলারের ছিল নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, এক্সটার্মিনেশন ক্যাম্প— হরেক রকমের মানুষ মারার কল। ‘স্পার্ক অব লাইফ’, ‘আ টাইম টু লাভ অ্যান্ড আ টাইম টু ডাই’ ইত্যাদির মতো কাহিনিতে প্রথম থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অস্থির সময়ের জীবন্ত ইতিহাস কবর খুঁড়ে তুলে এনেছেন মানবতাবাদী এরিখ মারিয়া রেমার্ক।
যুদ্ধের সঙ্গে হিংসা, রক্তপাত, হত্যা, সন্ত্রাস, দখলদারির মতো আদিম ঘটনাবলির যোগাযোগ স্বাভাবিক। কিন্তু দু’-দুটি মহাসমরে ব্যাপক হারে দেখা দিল স্থানান্তর, দেশান্তরের ঘটনা। যুদ্ধরত রাষ্ট্রশক্তির মানবসভ্যতা বিরোধী কার্যকলাপে যখন দেশবাসী ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী, তখন তাদের বন্দিশিবিরে রেখে রকমারি নির্যাতনের কৌশলে শায়েস্তা করার চেষ্টা হয়েছে। নিরুপায় লক্ষ লক্ষ নাগরিক প্রাণের দায়ে স্মৃতিবিজড়িত ভিটেমাটি-খেতখামার-প্রতিবেশী-সম্পর্ক-জীবিকা সব ফেলে রেখে উদ্বাস্তু কিংবা শরণার্থী হয়ে আশ্রয় খুঁজেছেন ভিন্দেশে। স্বদেশ ত্যাগের যন্ত্রণা, বিদেশ-বিভুঁইয়ে অনিশ্চিত জীবন ও জীবিকার আতঙ্কিত শিকড়ের ছায়ায়-মায়ায় বেড়ে উঠেছে ‘আর্চ অব ট্রায়াম্ফ’।
রেমার্ক প্রথাগত সেনার পোশাক পরতে এক দিন বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল, অন্যের দেশ নয়, বরং দেশ-কালহীন শান্তিকামী মানুষের হৃদয় জয় করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই অবাঞ্ছিত হিংসার ভুবনে আবার উড়বে রঙিন প্রজাপতি। বারুদ-বিস্ফোরকের গন্ধহীন মুক্ত বাতাসে আন্দোলিত হবে শান্তির পতাকা। তখন যুদ্ধফেরত ‘থ্রি কমরেডস’, কালো স্মৃতিফলকের কাছে নতজানু হয়ে ‘শান্ত’ রণাঙ্গনের শোক বুকে নিয়ে স্মরণ করবে, ‘... যদি বেঁচে ফিরতে পারি কমরেড,
কথা দিচ্ছি যে কারণে আজ তুমি মৃত, জীবন আমার কাছে অর্থহীন, তার বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি নিয়ে
যুদ্ধ করব।’ (শত্রুসেনা দুভালের ঘাতক, পল ব্রমারের স্বীকারোক্তি)
এ-বিষয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন,
‘‘একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি কি ইহুদিদের পছন্দ করেন?
রেমার্ক বললেন, না।
আপনি কি জার্মানদের পছন্দ করেন? না।
আপনি কি আমেরিকানদের পছন্দ করেন ? না।
তা হলে আপনি...
আমি পছন্দ করি আমার বন্ধুদের। যারা পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যেই আছে।’’
(‘যা দেখি যা শুনি একা একা কথা বলি’, ২০১২)
নিষ্ঠুর আগ্রাসনে হিটলার কিছু কাল, কিছু মানুষের ওপর দখলদারি কায়েম করে উড়িয়েছিলেন স্বস্তিক পতাকা। তাঁর আত্মহত্যার ৭৫ বছর পর কোথাও শ্রদ্ধার মোমবাতি জ্বলেনি। আর ফ্যাসিস্ত শক্তির বর্বরতার ইতিহাস গল্পের ছলে বলতে বলতে এরিখ মারিয়া রেমার্ক জিতে নিয়েছেন দেশ-কাল-পতাকাহীন যুদ্ধবিরোধী সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতক পরেও পৃথিবী সন্ত্রাসমুক্ত নয়, কিন্তু রেমার্কের হাত ধরে শান্তি ও ভালবাসায় ঋদ্ধ নতুন পৃথিবীর সন্ধান আজও অব্যাহত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy