আত্মহত্যার খবর শুনলে মানুষের মুখে এই সহানুভূতির স্বর শোনা যায়, আহা, না জানি কত যন্ত্রণা নিয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে! কিন্তু সাম্প্রতিক কালে আত্মহত্যা, বিশেষ করে কলকাতার মেট্রো রেলে আত্মহত্যার ঘটনায় মানুষের যেন একটা সম্মিলিত বিরক্তি দেখা যাচ্ছে— এই শহরের মানুষের অনুভূতির মানদণ্ডকে যা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আত্মহত্যা বা তার চেষ্টার ঘটনায় নিত্যযাত্রীদের অসুবিধা হচ্ছে, তা থেকেই আসছে বিরক্তি— এ-হেন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার সময় উপস্থিত থাকলে যাত্রীদের অসংবেদনশীল মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু, আত্মহত্যা বেছে নেওয়া মানুষ আর তার জেরে ভোগান্তির মুখে পড়া মানুষের মধ্যে কি এমনই লড়াই হওয়ার কথা ছিল!
কিছু পরিকাঠামোগত প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক। শহুরে দক্ষতা ও দ্রুত সংযোগের প্রতীক হিসাবে পরিচিত কলকাতার মেট্রো রেল সাম্প্রতিক কালে মুখোমুখি হয়েছে আধুনিক সময় ও জীবনের প্রতীক এক ক্রমবর্ধমান সমস্যার— পাতালরেলের ট্র্যাকে আত্মহনন। এই উদ্বেগজনক প্রবণতা মেট্রোযাত্রীদের দৈনন্দিন জীবনে বিঘ্ন ঘটায় নিশ্চয়ই, তবে তার চেয়েও গুরুতর এক প্রশ্ন তোলে— মানসিক স্বাস্থ্য এবং আমাদের সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে।
আত্মহত্যা একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, কিন্তু তা মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা কারণের জটিল আন্তঃসম্পর্ক দ্বারা প্রভাবিত। মেট্রো রেলের কিছু পরিকাঠামোগত বৈশিষ্ট্য এই সিদ্ধান্তের পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তোলে। মেট্রো স্টেশনগুলিতে প্রবেশের সুবিধা, যাত্রীর অজ্ঞাতপরিচয়ের সুবিধা, এবং সর্বোপরি এক মুহূর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির দৃশ্যমানতা আত্মহত্যার ঘটনাকে আরও প্রকট করে তোলে। আত্মহত্যার ঘটনা অনেক সময়েই তাৎক্ষণিক আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্তের ফল, হাতের কাছে থাকা মেট্রো রেল যে সিদ্ধান্তকে অনেক সময় ত্বরান্বিত করে।
নাগরিক জীবনে ব্যস্ততা ও একাকিত্বের এক অদ্ভুত বৈপরীত্য রয়েছে। কলকাতার মতো ব্যস্ত শহরে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে দিন কাটে বিপুলসংখ্যক মানুষের, তারই মধ্যে অনেক মানুষ নিজেদের অদৃশ্য ও একাকী মনে করেন। এই পরিস্থিতি একাকিত্ব ও হতাশার অনুভূতিকে বাড়িয়ে তোলে। আর্থিক অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব ও ঋণজাল বহু মানুষের মানসিক কষ্টের বড় কারণ, যা অনেক সময় জীবন সম্পর্কে গভীর নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে পারে। মেট্রো রেল যেন মহানগরের এই আর্থ-সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার যুগপৎ আয়না ও বাহন, এই সব কিছুকে সে বয়ে নিয়ে চলে।
প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা মেট্রো রেলের ব্যবস্থায় গুরুতর প্রভাব ফেলে। বহু মানুষের জীবনেও তা ধাক্কা দেয়। নিয়মিত যাত্রীরা এর প্রত্যক্ষ ‘শিকার’ হন। একটি আত্মহত্যার ঘটনা দেখা বা তার সম্পর্কে জানা-ও অত্যন্ত মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যাত্রীদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে অসহায়ত্বের অনুভূতি। দেখা যায়, একটিমাত্র ঘটনাতেই দীর্ঘ সময় ট্রেন পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটে, নির্ধারিত সময়সূচি পণ্ড হয়। অফিসযাত্রী, ছাত্রছাত্রী, শ্রমজীবীরা বাধ্য হন তাঁদের পরিকল্পনা পাল্টাতে, এর প্রভাব পড়ে শহরের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতায়। এর ফলে হতাশা ও বিরক্তি তো জাগেই, উপরন্তু ঘন ঘন এমন ঘটনা ঘটলে তা সাধারণ মানুষকে উদাসীনও করে তুলতে পারে। ধীরে ধীরে এই ধরনের ট্র্যাজেডির প্রতি সংবেদনশীলতা হারিয়ে যায়।
এই সমস্যার সমাধানে দরকার পরিকাঠামোগত পরিবর্তন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পদক্ষেপ। প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর স্থাপন করা যেতে পারে (অনেক লাইনে ও স্টেশনে হয়েছেও), তাতে মেট্রোর প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্র্যাকে প্রবেশ রুদ্ধ হবে। চাই উন্নত সিসিটিভি কভারেজ আর প্রশিক্ষিত কর্মীদের উপস্থিতি, যাঁরা অপেক্ষমাণ যাত্রীদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন, মানসিক ভাবে বিপন্ন ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে পারবেন।
মনের অ-সুখ সম্পর্কে কলঙ্ক দূর করতে এবং এই সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত প্রচার-অভিযানের বিকল্প নেই। স্টেশনের মধ্যে আত্মহত্যা-প্রতিরোধে সহায়ক হটলাইন নম্বরের দৃশ্যমানতা বাড়ানো দরকার, বিপন্ন মনের তাৎক্ষণিক সাহায্যে তা কাজে লাগবে। মনোবিজ্ঞানী ও নানা অসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় কর্মশালার আয়োজন, ওয়েব-কাউন্সেলিং ইত্যাদিও একটা সহানুভূতির পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে। পাশাপাশি, মেট্রোর যাত্রীদের মধ্যে সহানুভূতি ও সতর্কতার প্রচার-প্রসার করা গেলে তা এক সমষ্টিগত দায়িত্ববোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
আত্মহত্যা রোধে প্রযুক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন জরুরি, কিন্তু প্রকৃত সমাধান নিহিত সামাজিক স্তরে এই সহানুভূতি ও সমর্থনের সংস্কৃতি গড়ে তোলার মধ্যেই। এমন এক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে মানসিক সাহায্য চাওয়াকে দুর্বলতা নয়, শক্তি হিসেবে দেখা হয়। আত্মহত্যার ঘটনায় বিরক্ত মেট্রোযাত্রী যখন কটাক্ষ করেন “মেট্রোয় টিকিটের দাম কম, এত সস্তায় আত্মহত্যার সুযোগ আর কোথায়,” তাতে তাঁর অসংবেদী মনের ছায়াটি ধরা পড়ে। পরোক্ষে কোথাও কি তিনি মেট্রো রেলকেও দায়ী করেন না, মহানগরের দ্রুতিময় জীবনের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠার বদলে সে অতিদ্রুত মৃত্যুর যান হয়ে উঠল বলে? এই নিরাবেগ মনের, এবং অতিবেগ মেট্রোরও, আত্মসমীক্ষণ দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy