স্মৃতিসাক্ষ্য: আলিপুর হাওয়া-অফিসের প্রাঙ্গণে প্রশান্তচন্দ্র ও নির্মলকুমারী মহলানবিশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ। ছবি সৌজন্য: আইএসআই, কলকাতা।
দিনটি ছিল ১৩৩২ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ (১৯২৫ সালের ১৪ এপ্রিল)। শান্তিনিকেতনের মন্দিরে ভোরবেলার উপাসনায় রবীন্দ্রনাথ বেদিতে বসে বলেছিলেন, “এবার অসুস্থ শরীর নিয়ে মৃত্যুর পশ্চিম কূলে ব’সে ম্লান প্রাণের আলোকে অভ্যস্ত জীবনযাত্রা থেকে দূরে আপনাকে ও বিশ্বকে দেখবার অবকাশ পেয়েছিলুম। কলকাতায় যেখানে ছিলুম সেখানে শহরের পাথরে-বাঁধানো শুষ্কতা ছিল না, চারদিক গাছপালায় ছিল শ্যামল। সেখানে এবার অনেক দিন পরে প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন স্পর্শ করে দেখতে পেলুম। হঠাৎ গাছপালার তন্দ্রা ছুটে গেল, বিশ্বযজ্ঞের নিমন্ত্রণ তাদের কাছে এসে পৌঁছল, সাজসজ্জার সাড়া পড়ে গেল; ফিকে সবুজে, গাঢ় সবুজে, নীলে লালে, সোনালীতে প্রত্যেকে নিজের বিশেষত্ব নিয়ে আনন্দিত হয়ে প্রস্তুত হয়ে এল; দেখে আমার মন পুলকিত হয়ে উঠল।”
শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে বসে কবি ‘পাষাণপুরী’ (‘বিসর্জন’ নাটকের অভিনয় প্রসঙ্গে জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখা একটি চিঠিতে কবি কলকাতাকে ‘পাষাণপুরী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন) কলকাতার বুকের এমন কোনও একটি স্থানের অকুণ্ঠ প্রশংসা করছেন দেখে স্বভাবতই কৌতূহল জাগে, সেই স্থানটি কোথায়! তার আগে নববর্ষের উপাসনায় দেওয়া কবির সেই ভাষণের আরও কিছু অংশ দেখে নেওয়া যাক। সে বার বসন্তের কলকাতার সেই স্থানের রূপের প্রশংসা করেছেন কবি— “আকাশের কোন্ অলক্ষ্য চঞ্চলতা দক্ষিণ হাওয়াকে ব্যাকুল করে তুলেছে! তরুলতার প্রাণশক্তি রূপের লীলায় দিকে দিকে বিচিত্র হয়ে উঠল। প্রত্যেক গাছ আপনার রূপকে পরিস্ফুট করে তুলছে। প্রাণ যেখানে আপন বিশেষত্বের ঐশ্বর্যে পূর্ণ হয়ে প্রকাশ পায় সেইখানে তার অকৃপণ দাক্ষিণ্য, সেইখানে সে বিশ্বকে উদারভাবে আহ্বান করে।” কলকাতার সেই বাড়ির প্রাঙ্গণের এক দিকে বিশাল অশ্বত্থ, শিরীষ, কাঞ্চন গাছের সমারোহ। এই বাড়ির ঠিকানা ৪ নং, ডুয়েল অ্যাভিনিউ, আলিপুর, কলকাতা-৭০০০২৭। বাড়িটি বিখ্যাত আলিপুর আবহাওয়া অফিসের সদর দফতর। এখানেই ১৯২২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি বিখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ অস্থায়ী অধিকর্তারূপে দায়িত্ব পালন করতেন। প্রশান্তচন্দ্র ‘কবিকথা’য় লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ আলিপুর হাউসের পুব দিকের যে ঘরটিতে থাকতেন, তার পুব দিকে একটি জানলা ছিল, যার সামনে সারি সারি তালগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। তার পর অনেকটাই ফাঁকা মাঠ। মাঠের পিছনে বট, অশ্বত্থ, অশোক-সহ প্রচুর গাছগাছালি। এমন প্রাকৃতিক পরিবেশের দিকে চোখ রাখলে লেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় লেখার সময়ে টেবিলটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে জানলার দিকে পিছন ফিরে বসতেন।
১৯২৩ সালে ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল স্যর গিলবার্ট ওয়াকারের সঙ্গে এই বাড়িতেই কবির সাক্ষাৎ হয়েছিল। সাহেবের সৌজন্যে সে দিন ডিনারের ব্যবস্থা করেন প্রশান্তচন্দ্র। এ দিকে সে দিনই কলকাতায় ইন্দিরা দেবী ও প্রমথ চৌধুরীর ২০ নং মে ফেয়ার রোডের বাসভবনে (৯ জানুয়ারি) কবির মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের জীবনাবসান হয়। কবি সেখানে উপাসনা সেরে আবার ফিরে আসেন প্রশান্তচন্দ্রের আলিপুর আবহাওয়া অফিসের বাসস্থানে। প্রশান্তচন্দ্র কবিকে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করেন, কবি নিজের ঘরে নিভৃতে আলাদা ডিনার করতে চান কি না। তিনি এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে সেই বিদেশি অতিথির সঙ্গে খাবার টেবিলে বসেই অতিথিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে কথাবার্তা বলেন। ওয়াকারের সঙ্গে কবির সে দিন ভারতবর্ষীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত সম্বন্ধে দীর্ঘ আলোচনা হয়। ওয়াকার শেষে ঘুমোতে যাওয়ার আগে কবির খুব প্রশংসা করেন প্রশান্তচন্দ্রের কাছে।
১৯২৫ সালের ২৯ মার্চ এই আলিপুর হাওয়া-অফিসেই, প্রশান্তচন্দ্রের বাড়িতে কবির থাকাকালীন সময়ে, কবি-নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমারের সঙ্গে সঙ্গীত নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। এখানেই দিলীপকুমার কবিকে বলেন, “যদি একজন যথার্থ শিল্পী আপনার গানকে সম্পূর্ণ নতুন সুরে গেয়ে আনন্দ পান ও পাঁচজনকে আনন্দ দেন, এমন-কি তাহলেও আপনার তাতে দুঃখ না পেয়ে, আনন্দই পাওয়া উচিত বলে মনে করি।” স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথ এ কথা শুনে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট হন। প্রত্যুত্তরে দিলীপকুমারকে প্রশ্ন করেন, “তুমি কি বলতে চাও যে, আমার গান যার যেমন ইচ্ছা সে তেমনিভাবে গাইবে?” তার পর এই আলিপুর হাওয়া-অফিসের প্রাঙ্গণের ঘরে বসে নিজের গান নিয়ে সেই অমোঘ উক্তিটি শুনিয়েছিলেন দিলীপকুমারকে। বলেছিলেন, “আমি তো নিজের রচনাকে সেরকমভাবে খণ্ডবিখণ্ড করতে অনুমতি দিই নি। আমার গানে তো আমি সেরকম ফাঁক রাখিনি যে, সেটা অপরে ভরিয়ে দেওয়াতে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠব।”
আসলে যে কারণে এই আলিপুর হাওয়া-অফিসের প্রসঙ্গ বার বার উল্লেখ করা হচ্ছে তা হল, এই মানমন্দিরটি ১৮৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি এই শহরের বুকে স্থাপিত হয়। আর ঠিক তিন দিনের মাথায় এই ঐতিহ্যবাহী ভবনের সার্ধশতবর্ষ পূর্তি। দেড়শো বছর আগে আবহাওয়া নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রথম পর্যবেক্ষণের কাজ এই শহরের বুকে এখানেই শুরু হয়েছিল, যার সুবাদে আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে এই শহরবাসী অনায়াসেই জানতে পারে দৈনন্দিন আবহাওয়ার খবর। কতটা শীতে কাবু হল শহর, কবে থেকে বর্ষা নামবে শহরের বুকে, কিংবা আয়লা, আমপান বা দানার ছোবল কখন কোথায় আছড়ে পড়তে পারে, তার পূর্বাভাস। প্রতিদিন খবরের কাগজে কিংবা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ভেসে ওঠে এই দফতর থেকে আসা আবহাওয়া সংক্রান্ত নানা মানচিত্র বা সংবাদ।
তবে এর আগে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পার্ক স্ট্রিটের সার্ভে অফিস থেকে আবহাওয়ার বিবিধ পর্যবেক্ষণের কাজ চালাতেন ব্রিটিশ আবহবিদরা। সে সময় কলকাতা বন্দরটি ছিল দেশের ব্যস্ততম বন্দর, ফলে মূলত কলকাতা বন্দরের জাহাজের গতিবিধি নিরাপদ করার জন্যই আবহাওয়ার খবরাখবর এখানে প্রাধান্য পেত। ১৮৬৪ সালে এই শহরের বুকে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল। সেই ঘূর্ণিঝড়ের ফলস্বরূপ ব্রিটিশ ভূবিজ্ঞানীরাও নড়েচড়ে বসেন। এর পরে আরও দু’বার (১৮৬৬ এবং ১৮৭৩) বর্ষার আকালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষও দেখা দেয়। ব্রিটিশ সরকার আবহাওয়ার মতিগতি বোঝার জন্য আরও নির্দিষ্ট হতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। শুরু হয় আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আবহাওয়া চর্চার তোড়জোড় শুরু হয়। ফলস্বরূপ ১৮৬৫ থেকে ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গড়ে ওঠে। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক বিজ্ঞানী ব্ল্যান্ডফোর্ডের নেতৃত্বে কলকাতাতেও ১৮৬৭ সালে এমন পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছিল। পরবর্তী কালে ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ মেটেরোলজিক্যাল কাউন্সিল প্রস্তাব দেয় নতুন করে আবহাওয়া দফতরের পর্যবেক্ষণ পরিকল্পনার। সেই মতো পরের বছর অর্থাৎ ১৮৭৫ সালে আলিপুরে কলকাতা শহরের আবহাওয়া অফিসের দফতরটি স্থাপিত হয়। পার্ক স্ট্রিটের সার্ভে অফিসে আবহাওয়া দফতরের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৮৯৯ সালে স্যর জন এলিয়ট তৎকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী কলকাতায় অবস্থিত এই মানমন্দিরের প্রধান দফতরের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল পদে নিযুক্ত হন। পরে এই প্রধান দফতরটি ১৯০৫ সালে শিমলায়, পরে ১৯২৮ সালে পুণেতে এবং তারও পরে ১৯৪৪-এ দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৭৭ সাল থেকে আলিপুরের এই হাওয়া-অফিস থেকে নিয়মিত প্রতিদিনের আবহাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়ে আসছে, আজও সে ধারা অব্যাহত। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়ার পূর্বাভাসও ক্রমশ নির্ভুল হয়ে উঠছে।
এই হাওয়া-অফিসের আশপাশেই আছে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থান। এ কথা রবীন্দ্রনাথের চিঠিতেও পাওয়া যায়। শান্তিনিকেতন থেকে রাণু অধিকারীকে ১৩ জানুয়ারি ১৯২৩ তারিখে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “প্রথমে ছিলুম আলিপুরে, পশুশালার পাশেই— সেখানে অদূরে ছিলেন ভারতরাজপ্রতিনিধি বড়লাটবাহাদুর। এই সমস্ত পশুসিংহ ও নরসিংহদের পাড়ায় বেশিদিন টিকতে পারলুম না— পরশুদিন থেকে এখানে আছি।” রবীন্দ্রনাথ একাধিক বার প্রশান্তচন্দ্রের আলিপুরের হাওয়া-অফিসের বাড়িতে থেকেছেন। এই প্রাঙ্গণকে কেন্দ্র করে তাঁর অনেক স্মৃতি রয়েছে।
১৯২৩ সালের এপ্রিল মাসে, এই বাড়ির প্রাঙ্গণে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সীতা দেবীর সংস্থা ‘সোশ্যাল ফ্রেটারনিটি’র বার্ষিক প্রতিষ্ঠাদিবস উপলক্ষে প্রাঙ্গণের বাগানটি সুন্দর করে সাজানো হয়। রবীন্দ্রনাথ পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী ও নাতনি নন্দিনীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন সেই সভায়। সভায় বিশ্বভারতীর অতিথি-অধ্যাপক, প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ মরিস উইন্টারনিৎশও উপস্থিত ছিলেন। সে দিন কবি সকলকে কয়েকটি গানও গেয়ে শুনিয়েছিলেন বলে সীতা দেবী ‘পুণ্যস্মৃতি’তে জানিয়েছেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসে আলিপুর অবজ়ারভেটরিতে প্রশান্তচন্দ্রের আতিথ্যে তাঁর সরকারি আবাসে দীর্ঘ প্রায় তিন সপ্তাহ ছিলেন। তখন সারা দিন নানা কাজে নানা লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে কী দেখবেন তা কল্পনা করে রাণুকে লিখেছিলেন, “সেখানে এতদিনে শরৎকালের রোদ্দুরে আকাশে সোনার রং ধরেছে আর শিউলি ফুলের গন্ধে বাতাস ভোর হয়ে আছে। দিনে দিনে সন্ধ্যার পেয়ালাটি চাঁদের আলোয় ভর্তি হয়ে উঠতে থাকবে। আমি বারান্দায় আরামকেদারার উপর পা তুলে দিয়ে একলা চুপ করে বসব— চাঁদ আমার মনের ভাবনাগুলির পরে আপন রূপোর কাঠি ছুঁইয়ে তাদের স্বপ্নময় করে তুলবে— ছাতিমতলায় ঝরে পড়া মালতী ফুলের গন্ধ জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিশে যাবে। সেই সুগন্ধি শুক্লরাত আমার মনের এ কোণে ও কোণে উঁকি দিয়ে কোনো নতুন গানের সুর খুঁজে বেড়াবে— বেহাগ কিম্বা সিন্ধু কিম্বা কানাড়া।”
প্রশান্তচন্দ্রের স্ত্রী নির্মলকুমারী মহলানবিশ ‘বাইশে শ্রাবণ’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন, যা কবির এই হাওয়া-অফিসের বাড়িতে থাকাকালীন রচিত হয়েছিল। নির্মলকুমারী লিখেছেন, “মনে পড়ে ১৩৩২ সালে চৈত্র মাসে আলিপুরে আমাদের বাড়িতে একদিন একটি ছেলে সকালে কবির সঙ্গে দেখা করতে এলো। কী একটা লেখা নিয়ে তখন উনি খুব ব্যস্ত, কিন্তু কাজ থামিয়ে রেখে তাকে ডেকে পাঠালেন।” প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে তাঁদের মধ্যে কথা হচ্ছে দেখে নির্মলকুমারী খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন, কবির মুখখানা বড়ই বিষণ্ণ। ছেলেটি চলে যেতে নির্মলকুমারীকে কবি বললেন, “জানো, সেই ছেলেটিকে তাড়াতাড়ি বিদায় করব ভেবেছিলুম, কিন্তু সে এত হতভাগ্য যে কিছুতেই বলতে পারলুম না আমার কাজ আছে।” ছেলেটি কবির কাছে তার একটি কবিতার খাতা নিয়ে এসে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে সেখান থেকে কবিতা পড়ে শোনানোর পর কবির মনে হয়েছিল, ‘বিধাতার এ কী নিষ্ঠুর খেলা।’ নির্মলকুমারীকে বললেন, “ছেলেটা পাগল। অথচ সত্যিই কবিত্বশক্তি আছে। পাঁচ-ছয় লাইন হয়তো খুব ভালো লিখতে লিখতে হঠাৎ হারিয়ে যায়, আর যা তা লিখে ফেলে। বুঝতে পারে হচ্ছে না। কিন্তু কেন হচ্ছে না তা বোঝে না। বেচারা এসেছিল আমার কাছে, যদি আমি এ বিষয়ে ওকে সাহায্য করতে পারি।” এই কথা ভাবতে ভাবতে খানিক পরে রবীন্দ্রনাথ একটি গান লিখে ফেলেছিলেন সে দিন— ‘তোমার বীণা আমার মনোমাঝে/ কখনো শুনি, কখনো ভুলি, কখনো শুনি না যে।’ এই গানেই তিনি যেন সেই ‘পাগল’ কবির প্রসঙ্গ লিপিবদ্ধ করলেন এমন চয়নে— ‘পথের মাঝে ভুলালো পথ উতলা সমীরণে’।
সুকুমার সেন প্রণীত ‘রবীন্দ্রনাথের গান’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে ‘কণ্ঠে নিলেম গান, আমার শেষ পারানির কড়ি’ গানটি রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে চিনযাত্রার প্রাক্কালে এই বাসভবনে বসে লিখেছিলেন। চিনযাত্রা উপলক্ষে এখানে আয়োজিত কবির সংবর্ধনা-সভায় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের উপস্থিতিতে গানটি প্রথম প্রকাশ্যে গাওয়া হয়। এ ছাড়াও ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে রবীন্দ্রনাথ এই আবাসে বসেই ‘না বলে যায় পাছে’, ‘না না গো না, কোরো না ভাবনা’, ‘জ্বলে নি আলো অন্ধকারে’ এবং ‘ও আমার ধ্যানেরই ধন’ গান চারটি লিখেছিলেন।
প্রশান্তচন্দ্রের এই সরকারি আবাসে ১৯২৫ সালের ২৫ মার্চ কবি এসে মাসখানেক ছিলেন। তখন এখানে ‘প্রবাসী’র প্রতিনিধি হিসেবে সজনীকান্ত দাসকে কবির দক্ষিণ আমেরিকা সফরের বিবরণ শুনে অনুলিখনের জন্য প্রায়ই আসতে হত। সজনীকান্ত ‘আত্মস্মৃতি’তে সেই সাক্ষাৎকারের কথা লিখে গেছেন। এই আবাসে তাঁর সাময়িক ডেরা বাঁধার প্রসঙ্গ সেখানে জানা যায়— “দিনরাত্রি সর্বদা কয়েকদিন একসঙ্গে থাকিতে হইয়াছিল, এক টেবিলে আহার করিতাম, এক ঘরে শয়ন করিতাম। খেয়াল হইলেই তিনি আরাম-কেদারায় হেলান দিয়া নোট-বইটি চোখের সামনে মেলিয়া ধরিয়া মুখে মুখে ডায়ারি রচনা করিয়া চলিতেন, আর আমি লিখিয়া যাইতাম।” সজনীকান্ত জানিয়েছেন, মাঝে মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ থেমে সুষ্ঠু শব্দ খোঁজার জন্য হাতড়ে বেড়াতেন আর সজনীকান্ত তখন সাধ্যমতো তা জোগানোর চেষ্টা করতেন।
পরের বার ১৯২৬ সালে আগরতলা থেকে ফিরে রবীন্দ্রনাথ আলিপুরে এসে অসুস্থ হয়ে আবার মাসখানেক ছিলেন। মাঝে ১০ মার্চ অজিতকুমার চক্রবর্তীর কন্যা অমিতার সঙ্গে কবির বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র অজীন্দ্রনাথের বিয়ের আশীর্বাণী হিসেবে এই বাড়িতে বসেই ‘নববধূ’ নামে একটি কবিতা রচনা করেন। কবিতার প্রথম লাইন: ‘বসন্তের দূতী তুমি, ফাগুনের কুসুম উৎসবে’। পরে সেটিতে পাঠান্তরিত করে গানে রূপ দেন ‘অনন্তের বাণী তুমি, বসন্তের মাধুরী উৎসবে’। অসুস্থ কবিকে সেই সময় প্রখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকার এই বাড়িতে এসে দেখে যেতেন। আলিপুর হাওয়া-অফিসের এই আবাসে প্রশান্তচন্দ্রের আতিথেয়তায় রবীন্দ্রনাথ সব মিলিয়ে প্রায় তিন মাস থেকেছিলেন। আজও দফতরের অধিকর্তার কোয়ার্টার্সে রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য ঘরটি সযত্নে সংরক্ষিত আছে। হাওয়া-অফিসের সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্র-স্মৃতি তাই ইতিহাসের এক অনন্য দলিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy