‘লর্ড অব দ্য রিংস’-র (বাঁ দিকে) স্রষ্টা জে আর আর টলকিন (ডান দিকে)।
মধ্যবিশ্বের বিভীষিকাময় এক প্রদেশ মোর্ডর, অন্ধকারের অধীশ্বর সাওরন-এর ঘাঁটি। এখানেই আছে আগ্নেয়গিরি মাউন্ট ডুম, যার অভ্যন্তরে নির্মিত হয়েছিল ‘দি ওয়ান রিং’। এক মায়াবী আংটি, যা ধারককে অমোঘ ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে। শুরুতে তা ছিল সাওরন-এরই সম্পত্তি, পরে দ্বিতীয় যুগে শুভশক্তির জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আংটিটা তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। তখন অনেকটা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন সাওরন। কিন্তু তৃতীয় যুগে আবার জেগে উঠেছেন অন্ধকারের প্রভু। তাঁর চোখ শুধু খুঁজে চলেছে সেই আংটি।
সর্বকালের সেরা প্রাপ্তমনস্ক ফ্যান্টাসি উপন্যাস কোনটা? এর উত্তরে অধিকাংশ পাঠকই ‘লর্ড অব দ্য রিংস’-এর নাম বলেন। সাত দশক ধরে মানুষের ভালবাসা পেয়ে সগৌরবে বিরাজমান এই উজ্জ্বল কীর্তির নেপথ্যে যিনি, সেই জে আর আর টলকিন-কেও সবাই এক ডাকে চেনেন। আধুনিক ‘হাই ফ্যান্টাসি’র জনক জন রোল্যান্ড রুল টলকিন-এর জন্ম ১৮৯২ সালে। ছেলেবেলা থেকেই গল্পের বইয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল, পড়তে ভালবাসতেন জর্জ ম্যাকডোনাল্ড ও অ্যান্ড্রু ল্যাং-এর রূপকথা, এইচ রাইডার হ্যাগার্ড-এর অ্যাডভেঞ্চার। স্নাতক হওয়ার পর ব্রিটিশ সেনায় নাম লিখিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেন, যুদ্ধশেষে আবার পড়াশোনার বৃত্তে ফিরে আসেন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক পদে।
তিরিশের দশকে ছোটদের জন্য ফ্যান্টাসিধর্মী উপন্যাস লিখতে শুরু করেন টলকিন। ১৯৩৭ সালে বেরোয় তাঁর বই ‘দ্য হবিট’। দুর্গম অঞ্চলে রুদ্ধশ্বাস অভিযান, গবলিনদের সঙ্গে লড়াই, ড্রাগনের দুর্গে গুপ্তধনের সন্ধান— সার্থক অ্যাডভেঞ্চারের সব উপাদানই মজুত ছিল উপন্যাসটিতে। যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায় ‘হবিট’, তাতে উৎসাহিত হয়ে টলকিন সিকোয়েল রচনায় মন দেন। দ্বিতীয় বইটিও শিশুকিশোরপাঠ্য হবে, এমনই ভাবনা ছিল লেখকের, কিন্তু কাহিনির ব্যাপ্তি ও গভীরতা ক্রমশ বাড়তে থাকায় দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বাধ্য হন। প্রায় বারো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ‘দ্য লর্ড অব দ্য রিংস’-এর কাজ সম্পূর্ণ হয়। ১৯৫৪-৫৫’র মধ্যে তিন খণ্ডে (‘দ্য ফেলোশিপ অব দ্য রিং’, ‘দ্য টু টাওয়ারস’ ও ‘দ্য রিটার্ন অব দ্য কিং’) ছেপে বেরোয় সেটি। এ বছরই উপন্যাসটির সত্তর পূর্ণ হল। আপামর ফ্যান্টাসিপ্রেমীর নয়নের মণি হয়ে ওঠেন টলকিন, ১৯৫৭ সালে পান ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড’।
তিনটে ব্লকবাস্টার সিনেমার দৌলতে এর কাহিনি আজ সবার জানা। ‘হবিট’ হল মানুষের মতোই দেখতে এক প্রজাতি। শায়ার গ্রামের হবিট, ফ্রোডো ব্যাগিন্স উত্তরাধিকার সূত্রে পায় একটা আংটি, যা আঙুলে পরলেই অদৃশ্য হওয়া যায়। আংটির প্রকৃত স্বরূপ ফ্রোডো না বুঝলেও প্রাজ্ঞ জাদুকর গ্যান্ডালফ দ্য গ্রে দেখেই চিনে ফেলেন— এই সেই ‘ওয়ান রিং’, যার জেরে মিডল আর্থ-এর উপর কর্তৃত্ব স্থাপনের ষড়যন্ত্র করেন সাওরন। তিনি এও বোঝেন, আংটিটা ফিরে পাওয়ার জন্য ফ্রোডো-র পিছু নেবে সাওরন-এর অনুগামী প্রেত ‘নাজগুল’-রা, শ্মশান বানিয়ে দেবে শায়ারকে। গ্যান্ডালফ-এর নির্দেশে তাই অশুভ আংটিটাকে এল্ফ-রাজ্য রিভেনডেল-এ নিয়ে যায় ফ্রোডো। তার সঙ্গী হয় তিন হবিট: স্যামওয়াইজ়, মেরি ও পিপিন। সাওরনকে যুদ্ধে হারানো রাজা ইসিলদুরের বংশধর অ্যারাগর্ন, ফ্রোডোদের এল্ফ-রাজ্যে পৌঁছতে সাহায্য করেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, মাউন্ট ডুমে ফেলে ধ্বংস করা হবে সাওরনের আংটি। দায়িত্ব কাঁধে নেয় ফ্রোডো। তাকে সাহায্য করতে গড়া হয় অভিযাত্রীদের দল। পুরনো সদস্যরা ছাড়াও যোগ দেন গন্ডর-এর যুবরাজ বরোমির, ডোয়ার্ফ যোদ্ধা গিমলি, এল্ফ রাজপুত্র লেগোলাস।
যাত্রাপথে নানা বাধা-বিপত্তির মুখে পড়ে অভিযাত্রীরা, যুঝতে হয় বিশ্বাসঘাতক জাদুকর সারুমান ও তাঁর ভয়াল অনুচর ওর্ক আর উরুক-হাই’দের সঙ্গে। ফ্রোডোকে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেন বরোমির। অগ্নিদানব ব্যালরগ-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জীবন দেন গ্যান্ডালফ। শত্রুপক্ষের হাতে বন্দি মেরি ও পিপিনকে উদ্ধার করে চলমান গাছেদের সর্দার ট্রিবিয়ার্ড। ডানহ্যারো-র মৃত সেনাকে জাগিয়ে তুলতে গিমলি ও লেগোলাসকে সঙ্গে নিয়ে অ্যারাগর্ন যায় এরেখ-এর গুহায়। ফ্রোডো ও স্যামকে ছল করে দানব মাকড়সা শেলব-এর আস্তানায় ফাঁদে ফেলে আংটির মোহে অপ্রকৃতস্থ, কদাকার গোলাম। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে মোর্ডর-এ পৌঁছে যায় ফ্রোডো; বাকিরা ডার্ক লর্ড-এর শয়তান সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে।
‘হাই ফ্যান্টাসি’ ধারার প্রধান স্তম্ভ ‘ওয়ার্ল্ডবিল্ডিং’, যা নির্মাণে প্রশ্নাতীত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন টলকিন। তাঁর মিডল আর্থ সুবিশাল ক্যানভাসে আঁকা নিখুঁত কাল্পনিক জগৎ, যার সামনে ফিকে হয়ে যায় পূর্বসূরি এল ফ্র্যাংক বাউম-এর ‘অজ’ বা জেমস ম্যাথিউ ব্যারি-র ‘নেভারল্যান্ড’। একই কথা প্রযোজ্য তাঁর ‘মিথমেকিং’ সম্বন্ধেও। প্রাচীন ইতিহাস ও পুরাণের একনিষ্ঠ চর্চাকারী টলকিন যেমন খ্রিস্টান ধর্ম ও টিউটনিক মিথোলজি-র নির্যাসকে স্থান দিয়েছেন উপন্যাসে, তেমনই গ্রহণ করেছেন অ্যাংলো-স্যাক্সন সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যও। তাই তাঁর খলনায়ক চরিত্র সাওরন-এর মধ্যে কখনও নর্স দেবতা লোকি, কখনও বাইবেল-বর্ণিত স্বর্গভ্রষ্ট দেবদূত লুসিফার-এর ছায়া। তাঁর নায়ক ফ্রোডো খ্রিস্টের মতোই আত্মত্যাগের মহামন্ত্র সম্বল করে অভীষ্টের দিকে এগিয়ে চলে, তাঁর ওর্ক আর এল্ফদের কার্যকলাপ ওল্ড ইংলিশ ক্লাসিক ‘বেউলফ’-এর স্বাদ বয়ে আনে।
যে কোনও সফল ফ্যান্টাসিই অলীকের আকাশে ডানা মেলার রসদ সংগ্রহ করে বাস্তবের জমি থেকে। ‘লর্ড অব দ্য রিংস’-ও ব্যতিক্রম নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিপুল ক্ষয় স্বচক্ষে দেখেছিলেন টলকিন; তাই অবিরাম বোমা-গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন ইউরোপীয় জনবসতির আদলে রুক্ষ, বন্ধ্যা মোর্ডরকে গড়তে তাঁকে বেগ পেতে হয়নি। আবার স্বাভাবিক বংশগতির বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষের সঙ্গে ওর্ক-এর প্রজনন ঘটিয়ে উরুক-হাই জন্ম দেওয়ার যে প্রয়াস সারুমান করেছিলেন, তা নাৎসিদের ইউজেনিক্স সংক্রান্ত অমানবিক গবেষণা মনে করিয়ে দেয়। সমালোচকদের একাংশ মনে করেন, শায়ার, রিভেনডেল, মিস্টি মাউন্টেনস, মাইনস অব মোরিয়া প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের সমৃদ্ধির প্রতীক, আর তার বিপ্রতীপে রয়েছে বিধ্বংসী প্রযুক্তির প্রতীক ‘ওয়ান রিং’, যা ক্ষমতা-প্রতিপত্তির লোভ দেখিয়ে সমাজের সর্বনাশ ডেকে আনে। হবিট, ডোয়ার্ফ, এল্ফ, মানুষদের সঙ্গে সাওরন-এর বিরোধ আদতে পরিবেশ ও বিজ্ঞানের চিরাচরিত দ্বন্দ্বের রূপক— কল্পবিজ্ঞানের কিংবদন্তি আইজ়াক আসিমভের এই মত।
উপন্যাসে বিশেষ এক ন্যারেটিভ শৈলী ব্যবহার করেন টলকিন, যাকে বলা হয় ‘হিরো’জ় জার্নি’: নায়কের সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার যাত্রা। ফ্রোডো শুরুতে সরল, অনভিজ্ঞ হবিট, হঠাৎ আসা সমস্যার সমাধানে প্রথম বারের জন্য পা রাখে চেনা দুনিয়ার বাইরে। পাশে পায় একাধিক সমমনস্ক সঙ্গীকে। প্রতিপদে সততা ও সাহসিকতার পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ ফ্রোডো-র পদস্খলন হয় অন্তিম লগ্নে, সাময়িক ভাবে আংটির সম্মোহনী মায়ায় বিভ্রান্ত হয়ে। কিন্তু ভাগ্য যাকে নায়ক নির্বাচিত করেছে, সে তো উত্তরণের দাবিদার। তাই শেষে মাউন্ট ডুমের আগুনে পুড়ে নষ্ট হয় অভিশপ্ত আংটি, মুছে যায় সাওরনের অস্তিত্ব। শান্তি আসে মিডল আর্থে।
পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের পথপ্রদর্শক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা টলকিনের। টেরি ব্রুকস, উরসুলা লেগুইঁ থেকে জে কে রোওলিং, সবাই তাঁর অবদান স্বীকার করেছেন। গত বছর ২ সেপ্টেম্বর পূর্ণ হয়েছে টলকিন-এর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর, কিন্তু তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কমেনি। ইতিহাসে আজও অমর টলকিন, চিরভাস্বর তাঁর ‘লর্ড অব দ্য রিংস’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy