ছবি কুনাল বর্মণ।
এই কাহিনি মুখে মুখে প্রচারিত হতে হতে এখন সব বিপ্লবীর জানা। তবু তারা আরও জানতে চায় উল্লাসকরের মুখ থেকে। কিন্তু উল্লাসকর নির্বিকার। মাঝেমধ্যে হা হা করে হেসে উঠছে। বলছে, “অমরদা কি খেতে না দেওয়ার মতলব করেছে? নেমন্তন্ন করে এ কেমন বেআক্কেলে কাজ?”
অমরেন্দ্রনাথের কানেও কথাটা গিয়েছে। মনে মনে তিনি কষ্ট পেয়েছেন উল্লাসকরের জন্য। জেল থেকে ফিরে কেমন যেন হয়ে গেল ছেলেটা। বেশির ভাগ সময় চুপচাপ বসে থাকে। কথা বললে, অধিকাংশ কথাই অসংলগ্ন বলে। তিনি বোঝেন, উল্লাসকরের চিকিৎসা দরকার। কিন্তু অন্যরা সেটা বোঝে না। তারা উল্লাসকরের এই সব কথায় মজা পায়। উল্লাসকরকে ঘিরে খুব হাসাহাসি হচ্ছে দেখে, অমরেন্দ্রনাথ সেখানে এসে দাঁড়ান। তাঁকে দেখে উল্লাসকর বলে, “এই তো অমরদা এসে গেছে। অমরদাকে জিজ্ঞেস করো।”
অমরেন্দ্রনাথ গম্ভীর ভাবে বলেন, “কী?”
উল্লাসকর বলে, “এরা কেউ বিশ্বাস করছে না যে, আমার ঘিয়ের দোকানে ডাকাতি হয়ে গেছে।”
অমরেন্দ্রনাথের মুখে হাসি এসেও মিলিয়ে গেল। বললেন, “তোমার ঘিয়ের দোকান কোথায়?”
উল্লাসকর হাসতে হাসতে বলে, “আপনিও জানেন না? আমহার্স্ট স্ট্রিটের উপর। মস্ত বড় দোকান। ডাকাতগুলো সব ঘি সাবাড় করে দিয়েছে। তবে টিনগুলো রেখে গেছে। ওগুলো বেচেই লাভ তুলতে হবে।”
অমরেন্দ্রনাথ সরে আসেন। মনে মনে ভাবেন, উল্লাসকরকে আজ না ডাকলেই ভাল হত। ওর কাছ থেকে এখন কোনও কাজ চাওয়া বৃথা। অথচ বারো বছর আগে কত সম্ভাবনা ছিল ছেলেটির মধ্যে। উল্লাসকর আর হেমই ছিল অনুশীলনের সব। বোমা তৈরিতে কী চমৎকার মাথা ছিল দু’জনের। সেই মাথাটাই আজ গোলমাল হয়ে গেছে।
আজকের সভার আয়োজন অমরেন্দ্রনাথ করলেও, সভার পরিকল্পনা উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। দ্বীপান্তরের কারাবাস থেকে ফিরে, উপেন্দ্রনাথ যখন কী করণীয় সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না, তখন তিনি অমরেন্দ্রনাথকে পরামর্শ দেন একটা সভা ডাকার। অমরেন্দ্রনাথ নিজেও জার্মান অস্ত্র ষড়যন্ত্রকারী আসামি হিসেবে দীর্ঘ দিন ফেরার থেকে সবে দেশে ফিরেছেন। তাঁরও সকলের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন ছিল। তাই উপেন্দ্রনাথের কথায় নিজের বাড়িতেই সভার আয়োজন
করে ফেললেন।
দোতলার একটি বড় ঘরে শতরঞ্চি পেতে দেওয়া হয়েছে। সেখানে সারি দিয়ে বসেছেন অনেকে। কেউ কেউ দাঁড়িয়েও আছেন। উমাশঙ্কর দাঁড়িয়েই ছিলেন। তিনিও আত্মগোপন করে ছিলেন এত দিন। শাসন সংস্কার আইন চালু হওয়ায়, সকলের মতো তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। উমাশঙ্করের হাতে সিগারেট। তিনি ঘন ঘন সিগারেট খান। তাঁর সিগারেট খাওয়ার ভঙ্গিটি অদ্ভুত। আঙুলের মধ্যে সিগারেট নিয়ে আঙুল মুড়ে মুঠো পাকিয়ে গাঁজার মতো সিগারেটে পর পর টান দিতে থাকেন। আজকের সভা তাঁর কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনুশীলন সমিতির সঙ্গে দীর্ঘ দিন তাঁর কোনও যোগাযোগ নেই। ভেবেছিলেন, এখানে বারীন ঘোষের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু এত ক্ষণ হয়ে গেল, ঘোষমশাইয়ের পাত্তা নেই।
অমরেন্দ্রনাথ পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। উমাশঙ্কর ধরলেন তাঁকে। বললেন, “বারীনদাকে দেখছি না। বারীনদা কি আসবেন আজ?”
অমরেন্দ্রনাথ হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিলেন, “না, বারীন ওর পত্রিকা ‘বিজলী’ নিয়ে খুব ব্যস্ত। ও আজকের সভায় আসতে পারবে না
বলে জানিয়েছে।”
শ্রীশচন্দ্র কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, “উমাশঙ্কর, ছিলে কোথায় এত দিন?”
উমাশঙ্কর সিগারেটে একটা মস্ত টান দিয়ে বললেন, “প্রথমে চন্দননগরে। সেটা বোধহয় তুমি জানো। কারণ, সেখানে তুমি কয়েক বার গিয়েছিলে। চন্দননগরের পাট উঠে গেলে, কিছু দিন রিষড়ায় পিসিমার আশ্রয়ে থেকে, সেখান থেকে চলে যাই গুয়াহাটি। অমরদা, আমি, নলিনী আর অতুল এক সঙ্গে থাকতাম। পুলিশ রেড হল সেখানে। পালালাম, যে যার ভিন্ন পথে। কোথায় না গেলাম এই ক’বছর! কখনও হরিদ্বারে থেকেছি। কখনও আবার বেনারসে। এই রকম ঘুরতে ঘুরতে এক দিন চলে গেলাম মোরাদাবাদে। কাজ নিলাম কাচের চুড়ি তৈরির কারখানায়। ব্যস, ওখানেই টিকে গেলাম। দিব্যি ছিলাম। তার পর এক দিন শুনলাম অবস্থা বদলেছে। নিয়মিত কাগজ পড়তাম। সেখান থেকেই সব জানতে পারলাম। ফিরে এলাম। কিন্তু, কেন যে এলাম! কী যে করব এখন সেটাই বুঝে উঠতে
পারছি না।”
যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় কাছেই বসেছিলেন। উমাশঙ্করের কথাটা তার কানে গিয়ে থাকবে। উমাশঙ্করকে তিনি ভাল করে চেনেন না। বয়সেও তাঁর থেকে কিছু ছোটই হবেন উমাশঙ্কর। তবু উৎসাহ দেওয়ার জন্য বললেন, “এত হতাশ হয়ে পড়ছ কেন ভাই। আমাদের পরের পরিকল্পনা ঠিক করার জন্যই তো এই সভা।”
সকলেই অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল। অথচ সভা আরম্ভের কোনও লক্ষণ নেই। যাদুগোপাল হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলেন। সন্ধে ছ’টা দশ। আর খানিক ক্ষণের মধ্যে সভা শুরু না করলে, তিনি উঠবেন। তাঁকে আজই এক বার বাগবাজারের বাড়িতে যেতে হবে। ভাই ধনগোপালের সঙ্গে কিছু দরকারি কথা আছে, সে সব আজ না বললেই নয়। সে আবার আমেরিকা থেকে ফিরে বেলুড় মঠে আশ্রয় নিয়েছে। আজ এক বার বাগবাজার ঘুরে যাবে বলেছে।
অমরেন্দ্রনাথকে হাতের ইশারায় ডেকে বললেন, “অমর, এ বার শুরু করো। সকলের যে ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে!”
“এই তো এক্ষুনি শুরু করছি। আসলে আমি এক জনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম,” বলেই অমরেন্দ্রনাথ দরজার দিকে তাকালেন। এক সৌম্যদর্শন দীর্ঘদেহী সন্ন্যাসী দরজায় উপস্থিত হয়েছেন। সামান্য দেরি হলেও, চিনলেন নীলমণিকে। তাঁর নিজেরও এই সাজ ছিল দীর্ঘ দিন। অনেক বাঘা বাঘা পুলিশ অফিসারকে তিনি বোকা বানিয়েছেন এই সাজে। সামনে এসেও চিনতে পারেনি তাঁকে, যেমন এখানে অনেকেই নীলমণিকে এখন চিনতে পারছে না।
অমরেন্দ্রনাথ নীলমণিকে ভিতরে আসতে বললেন। নীলমণি একটা জায়গায় এসে আসনপিঁড়ি হয়ে বসলেন। এখন অনেকেই তাকে চিনেছে। শ্রীশচন্দ্র এগিয়ে এসে বসলেন নীলমণির পাশে। বললেন, “এই সাজটা কি ত্যাগ করবে না, নীলমণি?”
“না,” সংক্ষেপে উত্তর দিলেন নীলমণি।
অবাক হল শ্রীশচন্দ্র। বলল, “বিপ্লবের পথ থেকে সরে যাবে? দেশকে মুক্ত না করে সন্ন্যাসী হয়ে নিজে মুক্ত হয়ে যাবে?”
নীলমণি একটু চুপ করে রইলেন। তার পর বললেন, “পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে অধ্যাত্মবাদের আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, এটাই আমার পথ। এই পথ থেকে ফিরে আসা আমার পক্ষে অসম্ভব। অমরদার এই সভায় আজ আমি আসতাম না। শুধু একটি কারণে আজ আমার এখানে আসা।”
শ্রীশচন্দ্র কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। কারণ অমরেন্দ্রনাথ সভা শুরু করেছেন। তিনি বললেন, “আমার কাছে খবর আছে যে, বহু দিন বাদে আমাদের এই আজকের মিলনটা পুলিশ ভাল চোখে দেখছে না। হয়তো নজরও রেখেছে এই সভার উপর। তাই খুব সংক্ষেপে আমাদের আজকের এই সভাটি সেরে ফেলতে চাই। আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় ভবিষ্যতের কর্মপন্থা। এ বিষয়ে উপেন্দ্রনাথ আপনাদের কিছু বলবেন।”
উপেন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ালেন। কিছু বলার আগে তিনি তাঁর দাড়িতে এক বার হাত বুলিয়ে নিলেন। জেল থেকে ফিরে এখনও অবধি এটি বিসর্জন দেননি। কেউ বললে বলেছেন, জেলের স্মৃতি বহন করছেন। জেলের স্মৃতি অবশ্য রয়ে গেছে তাঁর হাতে ও পিঠে। হয়তো সারা জীবনই থেকে যাবে। আন্দামান জেলে অমানুষিক অত্যাচারের মধ্যে এই শরীরটা যে কী করে টিকে রইল, সেটা ভেবে তিনি অবাক হন। ইন্দুভূষণ পারেনি। বেচারা নিজের শার্ট ছিঁড়ে, গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ল। সুইসাইড নোটটা পর্যন্ত পুলিশ গায়েব করে দিল। উল্লাসকে মেরে পাগল করে দিল। ও আজ এখানে এলেও, ওর মধ্যে আর সেই আগের উল্লাস নেই।
উপেন্দ্রনাথ উল্লাসকরের দিকে তাকালেন। উল্লাসকরের মুখে হাসি। তাঁর দিকে চেয়ে হাসছেন উল্লাস। উপেন্দ্রনাথ চোখ সরিয়ে নিলেন। মনে মনে বললেন, এই নির্বাসন, এই অত্যাচারের কাহিনি তিনি লিপিবদ্ধ করে যাবেন। দেশ এক দিন স্বাধীন হবেই। স্বাধীন ভারতের ছেলেমেয়েরা আঁতকে উঠবে সেই কাহিনি পড়ে।
উপেন্দ্রনাথ সংক্ষেপে যা বললেন তার মর্মার্থ হল, বিপ্লবীদের কাজ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। যে পথেই হোক লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। যাঁরা সদ্য কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন ও গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী, তাঁদের দিকে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত করলেন, এটা সকলেই বুঝলেন।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy