প্রতিদ্বন্দ্বী: বক্সিং রিংয়ে রামলা আলি (বাঁ দিকে)। ছবি: গেটি ইমেজেস
বাড়ির বাইরে একটা জোরালো শব্দ। ‘‘কোন দিক থেকে এল রে?’’ মায়ের চিৎকার। বাগানের দিক থেকেই তো মনে হল, বলল কেউ। কিছু ক্ষণ সব চুপ। আবার একটা শব্দ। দরজা খুলেই আঁতকে উঠলেন মা। সামনে পড়ে বড় ছেলের নিথর দেহ। গ্রেনেডের আক্রমণে স্তব্ধ।
আতঙ্কিত মা সে দিনই স্থির করলেন, পালাতে হবে। সোমালিয়া ছাড়তে হবে এখনই। সেই রাতেই শুরু করে দিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি।
নয়াদিল্লি থেকে যিনি এই কাহিনি শোনাচ্ছিলেন টেলিফোনে, তাঁর নাম রামলা আলি। ভারতে সম্প্রতি এসেছেন বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে, রিংয়ে নেমে লড়াই করবেন। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত সোমালিয়ায় তাঁদের বিপন্ন জীবন আর সেখান থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে এসে বড় হওয়ার অবিশ্বাস্য কাহিনি শুনতে শুনতে মনে হবে, রামলার জীবনটাই যেন একটা রিং। যেখানে প্রতিনিয়ত তাঁকে লড়তে হয়েছে মৃত্যু নামক প্রতিপক্ষের সঙ্গে।
মহম্মদ আলির সেই উক্তি মনে পড়ে যাবে। ‘‘রিংয়ের আলোর ঝলকানির মধ্যে যখন প্রতিপক্ষের দিকে এগিয়ে যাই, তারও অনেক আগে, মানুষের চোখের আড়ালে তৈরি হয় আমার লড়াই। রিংয়ের গোল দড়ির ও পারে, যেখানে থাকে না কোনও দর্শক। যখন জিমে পড়ে থেকে নিজেকে নিংড়ে দিই। যখন অজস্র মানুষের ভিড়ে মিশে গিয়ে পথ চলতে থাকি। তখন দাঁতে দাঁত চেপে, চোয়াল শক্ত করে নিজেকে বলি, তোমাকে জিততেই হবে! কে জানত, মেয়েদেরও এক আলি বক্সিং রিংয়ে সেই মন্ত্রকেই দিয়ে যাবেন আরও মহাকাব্যিক রূপ!
মা তো ঠিক করে ফেললেন, সোমালিয়া ছেড়ে যাবেন। কিন্তু কোথায়? কী ভাবে? রামলা, তাঁর ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে তিনি উঠে পড়লেন নৌকোয়। গন্তব্যস্থল কেনিয়া। রামলা শোনালেন সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। ‘‘আমি তখন খুবই ছোট। তাই সেই নৌকো যাত্রার কথা খুব একটা মনে ছিল না। বড় হয়ে শুনেছি, অন্তত পাঁচশো মানুষ সেই নৌকোয় পালাচ্ছিল সোমালিয়া থেকে।’’
নৌকোতেও একের পর এক বিপদ। একে তো উপচে পড়া ভিড়ে টালমাটাল অবস্থা, তার উপর খাবারের অভাব। অনেকে অসুস্থ হতে শুরু করল। একটা সময়ে দেখা গেল, নৌকোর যাত্রীদের অর্ধেক জীবিত, অর্ধেক মৃত। রামলা বলেন, ‘‘আমিও নাকি প্রায় মরেই যাচ্ছিলাম। ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাই।’’ কোনওক্রমে নৌকো পৌঁছয় কেনিয়াতে। সেখান থেকে ক্রমে ইংল্যান্ডে। উদ্বাস্তু হিসেবে থাকতে শুরু করলেন তাঁরা। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হওয়া খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। উদ্বাস্তুকে কে জায়গা দেবে?
যাও বা ভর্তি হতে পারলেন, মোটাসোটা চেহারার জন্য প্রতি পদে অপমান। মানসিক যন্ত্রণা থেকে দূরে রাখতে মা তাঁকে ভর্তি করে দেন ট্রেনিং সেশনে। এই সিদ্ধান্তই মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে গেল রামলার জীবনে। সেই প্রথম হৃদয়ে স্থান করে নিল বক্সিং।
কিন্তু জীবনে কোনও কিছুই সহজে হাতে পাওয়ার জন্য জন্ম হয়নি রামলা আলির। আবারও সমস্যা। রক্ষণশীল পরিবার মেয়েকে বক্সিংয়ের গা-দেখানো পোশাক পরতে দেবে না। ‘‘কেউ মেনেও নিতে চায়নি যে আমি বক্সিং করি। লুকিয়ে লুকিয়ে বক্সিং শিখতে যেতাম। একটা ছোট্ট ব্যাগে বক্সিংয়ের সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। বাড়িতে বলতাম পার্কে দৌড়তে যাচ্ছি,’’ বলেন রামলা। মাঝেমধ্যেই বাড়ি ফিরতেন চোখের কোণে কালশিটে নিয়ে। প্রতিপক্ষের ঘুসিতে কপালের পাশটা ফুলে থাকত। আড়াল করতে হুডওয়ালা জ্যাকেট পরে থাকতেন। কিন্তু চোখের নীচের কালো দাগ কী ভাবে মুছবেন? ‘‘মায়ের প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যে বলেছি, পা পিছলে পড়ে গিয়েছি। কখনও বলতাম, স্কুলে মারামারি হয়েছে। এ ভাবেই চালিয়ে গিয়েছি।’’
গোপন বক্সিং অভিযানে সঙ্গী ছিলেন ছোট ভাই। বক্সিংয়ের পোশাক, সরঞ্জাম তিনিই পাচার করে দিতেন দিদির ব্যাগে। আর রামলা বাড়ির বাইরে একটা জায়গায় এসে সে সব নিয়ে ছুটতেন বক্সিংয়ে। এ ভাবে দিনের পর দিন প্রতিযোগিতাতেও অংশ নিয়েছেন। তাঁর বাড়ির লোকেরা টেরও পাননি। ভাবা যায়, ২০১৬ সালেও তিনি যখন ইংল্যান্ডে এবং পরে ব্রিটেনের বক্সিং খেতাব জিতছেন, তাঁর পরিবারের কেউ সেই স্মরণীয় মুহূর্ত দেখার জন্য উপস্থিত ছিলেন না! তখনও পর্যন্ত বাড়ির কেউ জানতেন না যে, তাঁদের রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বক্সিং করে বেড়াচ্ছেন! এখন অবশ্য আর আক্ষেপ নেই। বললেন, ‘‘মা এখন রোজ জিজ্ঞেস করেন, কবে আমার বক্সিং ইভেন্ট, আমি কোথায় যাচ্ছি। খুব সমর্থন করেন আমাকে।’’
এক সময় বক্সিং বন্ধ করার জন্য রামলার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। হবু স্বামী রিচার্ড মুরকে শর্ত দিয়েছিল তাঁর পরিবার, যদি তিনি প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন যে রামলার বক্সিং বন্ধ হবে, বিয়ে হবে তখনই। রিচার্ড তক্ষুনি রামলার পরিবারকে জানিয়ে দিলেন, তিনি শর্ত মানতে রাজি!
আসলে রিচার্ডের মনে ঘুরছিল অন্য ভাবনা। রামলা যেমন বড় হয়েছেন রক্ষণশীল পরিবারে, রিচার্ড তেমনই বেড়ে উঠেছেন খেলাধুলো নিয়ে মেতে থাকা সংসারে। তাঁর দাদু ছিলেন চেলসির বিখ্যাত কোচ ডেভ সেক্সটন। পরিবারে অন্য অনেকে বক্সিংও করেছেন। আইপিএল-এর দারুণ ভক্ত রিচার্ডও ভারতে এসেছেন স্ত্রীর সঙ্গে। তিনিই এখন রামলার কোচ। দিল্লি থেকে ফোনে রামলা-কাহিনিতে প্রেমের মোচড় এনে দিলেন তিনি। রামলার জীবনের মতোই অবিশ্বাস্য সব নাটকীয় আর রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত রয়েছে তাঁদের প্রেমকাহিনিতেও। রিচার্ড বলেন, ‘‘ইংল্যান্ডে বক্সিং ক্লাসেই রামলার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল। দ্রুত বুঝে যাই, উই আর মেড ফর ইচ আদার। তার পর থেকে দু’জনের স্বপ্ন এক হয়ে গিয়েছে। রামলাকে বক্সিং চ্যাম্পিয়ন করতেই হবে। বিয়ের কথাবার্তার সময় ওদের পরিবারকে যখন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলাম যে, ও বক্সিং ছেড়ে দেবে, তখনও তো আমি জানি ও ছাড়বে না। আমিই ছাড়তে দেব না।’’
কিন্তু তিনি একা চাইলে কী হবে, রামলার মা তখনও রাজি নন। মেয়েকে কিছুতেই বক্সিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেবেন না তিনি। ফের বোঝানোর পালা শুরু হল তাঁকে। অবশেষে নিমরাজি হয়ে মা বললেন, ‘‘চ্যাম্পিয়নশিপে নামতে পারো, তবে সোমালিয়ার প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। মনে রেখো, ওটাই তোমার দেশ। তোমাকে সোমালিয়ার প্রতিনিধিত্ব করতে দেখলে অনেকের গর্ব হবে।’’
মা অনুমতি দিলেন। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত, নিপীড়িত সোমালিয়ায় তখন কোনও বক্সিং ফেডারেশনের চিহ্নমাত্র নেই। সেখান থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে অংশগ্রহণ করতে চাওয়া মানে ব্যাপারটা স্রেফ কল্পকথার মতো শোনাচ্ছে। কী ভাবে সব কিছুর আয়োজন করা হবে? রিচার্ড তবু হাল ছাড়লেন না। ‘‘প্রথমে আমাদের মনে হয়েছিল, সব লড়াই বুঝি শেষ হয়ে গেল। কী ভাবে রাতারাতি সোমালিয়ায় বক্সিং ফেডারেশন করব? কোথা থেকে বক্সিং টিম তৈরি করব? যেখানেই যাচ্ছি, সকলেই মুখের উপর বলে দিচ্ছে, আমরা কোনও টাকাপয়সা দিতে পারব না। কোনও সাহায্য করার ক্ষমতা আমাদের নেই।’’ তার পর? রিচার্ড বলে চলেন, ‘‘তবু শেষ না দেখে হার মানতে চাইনি আমরা। নিজেদের যা সঞ্চয় ছিল, সেগুলো ভাঙিয়ে ফেলে সোমালিয়ায় বক্সিং ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করার কাজে নামলাম। বক্সিং টিমও তৈরি করে ফেলা হল। রাতারাতি লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলাম। আমি আন্তর্জাতিক বক্সিং কোচের যোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সেই সার্টিফিকেটও পেয়ে গেলাম।’’ স্বপ্ন সফল-করা সেই মুহূর্তের কথা বলতে গিয়ে আবেগে ধরে আসে রিচার্ডের গলা, ‘‘দৌড়াদৌড়ি করে লাইসেন্স বের করে আমি হলাম সোমালিয়ার জাতীয় দলের বক্সিং কোচ। আর রামলা, আমার স্ত্রী, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নামার ছাড়পত্র পেল। ওর মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী, সোমালিয়ার বক্সার হিসেবেই নামল রামলা। যে স্বপ্ন আমরা দু’জনে মিলে দেখেছিলাম, সেটাও পূরণ হল।’’
ইংল্যান্ড ও ব্রিটেনের জাতীয় বক্সিং প্রতিযোগিতায় একাধিক মুকুট জিতেছেন রামলা। এখন পাখির চোখ করছেন অলিম্পিক্সকে। সেই লক্ষ্য নিয়ে ভারতের মতো আরও কয়েকটি দেশে বক্সিং রিংয়ে দেখা যাবে তাঁকে। যিনি নিজেই অনেকের কাছে এত বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছেন, তাঁর প্রেরণা কে? জিজ্ঞেস করায় রামলা বললেন ভারতের এক নারীর কথা। ‘‘মেরি কমকে দেখে আমি নিজেকে বলতে পেরেছিলাম, কে বলে মেয়েরা পারবে না? মেরি যদি পারেন, আমিও পারব। পাঁচ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন উনি। আমাদের কাছে মেরি কমই প্রেরণা।’’
শেষ করার আগে অদ্ভুত একটা কথা বললেন রামলা। ‘‘জানেন, আমি কিন্তু আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগা একটি মেয়ে। জীবনে কখনও নিজের উপরে আস্থা রেখে চলতে পারিনি। বার বার মনে হয়েছে, আমি পারব না। আমার দ্বারা হবে না। কিন্তু বক্সিং আমাকে পাল্টে দিয়েছে। রিংয়ের মধ্যে নামলে কেন জানি না মনে হয়, ঝড় হয়ে আছড়ে পড়ি।’’ ছোটবেলায় যুদ্ধবিধ্বস্ত সোমালিয়ার গ্রেনেড বর্ষণ, গোলাগুলির আওয়াজ, বাড়ির সামনে খেলতে খেলতে ভাইয়ের তীব্র আর্তনাদ আর তার পরেই চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া, মরদেহের মধ্যে শুয়ে দুঃস্বপ্নের সেই নৌকোযাত্রা, আর বক্সিং স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য ক্রমাগত এ দেওয়াল থেকে ও দেওয়ালে ঠোক্কর খাওয়াই হয়তো রামলার মধ্যে এক নিরন্তর প্রতিবাদীর জন্ম দিয়ে গিয়েছে। সেই মানসিকতাই সম্ভবত ঝড় হয়ে আছড়ে পড়ে বক্সিং রিংয়ে। কিংবদন্তি বক্সার মহম্মদ আলির মতোই।
রামলার আশ্চর্য জীবনের গল্প শুনতে শুনতে এক-এক সময় মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি রামলা আলি নামে কেউ আছেন? না কি কেনিয়ার পথে নৌকোতেই হারিয়ে গিয়েছেন তিনি! গ্রেনেড আর গোলাগুলির হামলা থেকে সত্যিই কি রক্ষা পেয়েছিলেন তিনি? সত্যিই পরে ফিরে গিয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সোমালিয়ায়, নিজের দেশের হয়ে বক্সিং রিংয়ে নামবেন বলে? দিল্লি থেকে ফোনের ও পারে যিনি সে দিন কথা বলেছিলেন, যিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন, সত্যিই কি তিনি রক্তমাংসের কোনও বক্সার? নাকি পুরোটাই ছিল এক মাঝদুপুরের বিভ্রম মাত্র?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy