Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Christmas 2023

অন্তবিহীন যে বড়দিন

স্ত্রীর জন্য উপহার পাখির ডাক, ঝর্নার শব্দ। রাতের পাড়া-ক্রিকেটে বদলে যাওয়া জীবন। কালীপুজোর রাতে এক হয়ে যাওয়া জিশু ও কৃষ্ণ। যুদ্ধে বিনষ্ট প্রার্থনাগৃহের পুনর্নির্মাণ ও শিল্পীর শাস্তি।

মানবপুত্র: শিল্পী রাফায়েলের কল্পনায় ‘ম্যাডোনা’। মা মেরির কোলে জিশু।

মানবপুত্র: শিল্পী রাফায়েলের কল্পনায় ‘ম্যাডোনা’। মা মেরির কোলে জিশু। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৫৪
Share: Save:

বড়দিন কাকে বলে? দিনটা যে দিন হঠাৎ বড় হয়ে ওঠে? না কি ছোটখাটো সাধারণ মানুষ যে দিন নিজেদের গল্পের জোরে বড় হয়ে যায় অনেকটা? উত্তর আমার কাছে নেই। কিন্তু পঁচিশে ডিসেম্বর এগিয়ে আসতে থাকলেই অনেক গল্প মনে পড়তে থাকে। পরমাণুর ভিতরে যেমন ইলেকট্রন, জীবনের ভিতরেও তেমন গল্প। সেই ইলেকট্রন যেমন একই সঙ্গে কণা আর তরঙ্গ, আমাদের এই গল্পগুলোও তেমন একাধারে কল্পনা আর বাস্তব। দুইয়ের সংযোগ না হলে যা ছোট তা বড় হবে কেমন করে?

বোবাযুদ্ধ কিংবা গিফট অব দ্য ম্যাজাই

চিনের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম আমরা। আমি ভারত থেকে, গোরান এসেছিল ক্রোয়েশিয়ার প্রতিনিধি হয়ে। তখনও ক্রোয়েশিয়া ফুটবলের সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠেনি, তাই নামটা তত কিছু শোনা ছিল না। কিন্তু গোরানের কাছ থেকে শুনছিলাম কেমন করে একটা যুগোস্লাভিয়া ভেঙে অনেক দেশ হয়েছিল, আর সেই প্রক্রিয়ায় ভেঙে চুরচুর হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য পরিবার। গোরানের নিজের পরিবারও তার ভিতরেই একটা।

মাইলের পর মাইল বিস্তৃত একটি হ্রদ; তার জল এতটাই নীল যে, মনে হয় ঈশ্বর যেন নীলচাষ করেছেন চরাচর জুড়ে। সেই হ্রদ থেকে একটু দূরে, গায়ে হালকা বরফ লেগে থাকা পাহাড়ের মালা আর হ্রদের কাছাকাছি ঘন সবুজ তৃণভূমি। ঘাসজমি থেকে একটা পাটাতন সোজা এগিয়ে গেছে হ্রদের দিকে। হ্রদের বেশ অনেকটা ভিতর পর্যন্ত অসমাপ্ত সেতুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই পাটাতন, আর তাতে দণ্ডায়মান এক পাথরের পরি। তাকে ঠিক আমাদের ভিক্টোরিয়ার মতো দেখতে নয়, কিন্তু গোরান তার সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছিল নিজের স্ত্রীর। সেই মিল খুঁজে পাওয়ার কারণ ছিল এই যে, গোরানের স্ত্রী আর কথা বলতে পারেন না।

“তোমার স্ত্রীর কী অসুখ হয়েছে?” ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।

“অসুখ হয়নি কোনও। যুদ্ধের সময় তিন-চার রাত্রি টানা বোমা পড়েছিল আমাদের শহরে। আমাদের বাড়ির বেশ খানিকটা ভেঙে পড়েছিল তার অভিঘাতে। শুনেছি যে তার পর থেকেই জেরিকা বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।”

“তুমি কোথায় ছিলে তখন?”

“সার্বিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলাম।”

গোরান দু’দিন আগেই আমায় বলেছিল যে, যুগোস্লাভ আমলে সবাই মিলেমিশেই ভাল ছিল। কিন্তু তার পরও ও যুদ্ধকে ন্যায়সঙ্গত মনে করত, কারণ একটা বড় বাড়ি যখন ভাগ হয়ে যাচ্ছেই, তখন সব ভাইকেই নিজের ভাগের ঘরটা পাওয়ার জন্য লড়তে হবে! নিজের বাঁচার অধিকার ছেড়ে দিয়ে তো মানুষ সৌভ্রাত্র দেখাতে পারে না।

বাঁচার অধিকার বুঝে নিতে গিয়ে ক্রোট, সার্বিয়ান, বসনিয়াকরা অনেকেই ওর বৌ জেরিকার মতো মরে বেঁচে আছে। কিন্তু মরে যারা বেঁচে থাকে, তাদেরও তো বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করতে হয়। গোরান তাই ওই লেকের চার পাশের পাখির ডাক রেকর্ড করছিল সেই সকালে।

প্রায় পনেরো বছর আগের ঘটনা, মোবাইল এতটা সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠেনি তখনও। গোরান ঘাসের উপর উবু হয়ে বসে, কখনও বা প্রায় শুয়ে পড়ে হাতের টেপরেকর্ডারটায় রেকর্ড করছিল অচেনা সব পাখির ডাক।

“এতে কিছু উপকার হবে?”

ঘাসের উপর কাত হয়ে থাকা গোরান সামান্য গলা তুলে বলেছিল, “আমার দেশটার মতো জেরিকার অস্তিত্বও ক্ষুদ্র হয়ে গেছে। কথা বলতে পারে না বলে, শুনেও অনেক কথা বুঝতে পারে না আজকাল। আমি এখান থেকে ফিরে, হাঙ্গেরিতে যাব, ঝর্নার কলতান রেকর্ড করতে। এই পাখির ডাক, ঝর্নার শব্দগুলো নিয়ে একটা অডিয়ো-ভিস্যুয়াল করার ইচ্ছে আছে। নিরন্তর বোমার শব্দ শোনার পর থেকে জেরিকার মনে শব্দ নিয়ে একটা ভয় কাজ করে। সেই ভয়টাই কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে ওই অডিয়ো। যদি পারি তবে সেটাই হবে জেরিকাকে দেওয়া আমার সেরা ক্রিসমাস গিফট।”

ও হেনরি তাঁর জগদ্বিখ্যাত গল্পে পূর্বদেশীয় যে তিন প্রাজ্ঞের কথা বলেছিলেন, তাঁরা গোরানের গল্প শুনলে কী বলতেন জানি না, তবে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পৃথিবী যাঁর ছোট হয়ে গেছে, সেই মানবীর জন্য এর চেয়ে ভাল বড়দিনের উপহার হয়? হতে পারে?

কলোনির ক্রিসমাস বা ইয়াদোঁ কি বারাত

জায়গাটা কলকাতার উত্তর শহরতলি হতে পারে, দক্ষিণ শহরতলি হওয়াও বিচিত্র নয়। দু’জায়গাতেই গলি আছে এবং শীতকালটা জমিয়ে গলি-ক্রিকেট চলে। সেই গলি-ক্রিকেটেরই বিখ্যাত খেলোয়াড় ছিল বিট্টু ওরফে রুদ্রকিশোর। আট-নয় বছর বয়সেই তার হাতের ছয় গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়ত। বলও খারাপ করত না বিট্টু, ওই এবড়োখেবড়ো পথেই মাঝে মাঝে আধহাত ঘুরে যেত ওর ডেলিভারি। বছর তিরিশ আগে অত স্বপ্ন দেখার সাহস ছিল না লোকের, তাই বিট্টু দেশের হয়ে খেলবে এমন কথা শুনিনি। কিন্তু ও যে কালে-দিনে গড়ের মাঠ কাঁপাবে এমনটা সবাই বলত।

সেই সময়, পঁচিশে ডিসেম্বর একটা টুর্নামেন্ট হত কমবেশি সব পাড়ায়, আর সে বার বিট্টুদের পাড়াও দারুণ এক স্পনসর পেয়ে গেল। স্পনসর ভদ্রলোক প্রোমোটিং করতেন; বিট্টু ওঁর নির্মীয়মাণ একটি বহুতলের তিন তলায়, চার তলায় বহু বার বল পাঠিয়েছে। হয়তো বা বিট্টুর ব্যাটিং দেখেই টুর্নামেন্টে টাকা ঢালতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন উনি।

তখন বিনোদনের এত মাধ্যম হাতের নাগালে ছিল না। রঙিন টিভি এলেও চ্যানেলের সেঞ্চুরি হয়নি। শীত পড়লে পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে ডিনার করার মতো কাউকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে পাওয়া কঠিন হত ওই অঞ্চলগুলোয়। বৎসরান্তে আনন্দের উপকরণ বলতে ছিল, বড়দিনের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এবং তিরিশ বা একত্রিশে ডিসেম্বরের পিকনিক। সেই পিকনিকেও পাড়ার সেই ক’জনই যেতে পারত, দুটো বাসে যাদের জায়গা হত। কিন্তু ক্রিকেটের মৌতাতে হাজির হত সকলেই।

টি-টোয়েন্টি আসার অনেক আগে থেকে আমাদের এই পাড়াগুলোয় দশ ওভারের ক্রিকেট ম্যাচ শুরু হয়ে গিয়েছিল; এক দিনে গোটা টুর্নামেন্ট শেষ করতে হবে বলে মাঝে মাঝে ম্যাচগুলো পাঁচ ওভারেও নেমে আসত। কিন্তু সে দিন বিট্টু এক ওভারও টিকতে পারল না কোনও ম্যাচে। তিন-চার বল খেলেই আউট হয়ে গেল, বলেও কোনও কেরামতি দেখাতে পারল না। আসলে রাস্তায় বল যে ভাবে ব্যাটে আসে, ঘাসের পিচে তো সে ভাবে আসে না; মাটি আর কংক্রিটের ফারাক যাবে কোথায়?

সাফল্য আর ব্যর্থতার ফারাকও যায় না কোথাও। বিট্টু তাই সেই ক্রিসমাসের রাত্রে একটা ব্লেড দিয়ে ওর হাতের শিরা কেটে ফেলেছিল। কিন্তু তার পরও ব্যর্থ, মানে মরে যেতে ব্যর্থ হয়েছিল। আর ও কী করেছে সেই কথা রটে যেতে সারা পাড়া ভেঙে পড়েছিল, ডাক্তার বোসের নার্সিং-হোমে। তখনও বাইপাসের ধারে হাসপাতালের ঝাঁক তৈরি হয়নি, স্থানীয় নার্সিং হোমেই বাঁচামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকত মানুষ। বিট্টুকে বাঁচাচ্ছিলেন ডাক্তাররা, কিন্তু তাঁদের পাশাপাশি সারা পাড়া যেন এক অঙ্গীকারে নিঃশব্দে উচ্চারণ করছিল, ‘যেতে নাহি দিব’।

বিট্টুকে কোথাও যেতে হয়নি, ও সুস্থ হয়ে গিয়েছিল দু’দিনেই। কিন্তু সেই রাতটা কেবল গাছের গায়ে সেজে ওঠেনি, সেজে ওঠেনি আলোয়। সে সাজিয়ে তুলেছিল, বাজিয়ে তুলেছিল প্রতিবেশীদের প্রাণকে একটি বারো বছরের বালকের জন্য। জিশুর বলা, ‘লাভ দাই নেবার’ সত্যির চেয়েও বেশি সত্যি হয়ে উঠেছিল।

তিরিশ বছর পরে এখন ওই শহরতলি, ভরভরন্ত শহরেরই অংশ। প্রতি স্কোয়্যার ফুটের দাম পাঁচ হাজার টাকার বেশি। ক্রিকেট খেলার সেই মস্ত মাঠটাও আড়ে বহরে ছোট হয়ে গেছে, অ্যাপার্টমেন্ট উঠেছে সেই জায়গায়। কিন্তু পঁচিশে ডিসেম্বরের সেই টুর্নামেন্ট আজও হয়। এবং টুর্নামেন্টের আগের দিন মাঠে এসে সরকারি আধিকারিক রুদ্রকিশোর খুঁটিয়ে পিচ পরীক্ষা করে যায়। পিচ পরীক্ষা করে, নাকি সেই তিরিশ বছর আগেকার বিট্টুকে খুঁজে ফেরে?

জবাবের খোঁজে শীতের পাতা ঝরে পড়ে, নতুন নতুন কোম্পানির ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ডানা মেলে, সাহেবি খানাপিনা স্বাভাবিক ঠেকে। কেবল বিট্টু নিজের সেই ব্যর্থতাকে উদ্‌যাপন করে টুর্নামেন্টের অন্যতম স্পনসর হয়ে।

ব্যর্থতা, না কি সাফল্য? যে ক্রিসমাসের রাতে প্রায় পাঁচশো লোক ছুটে এসেছিল এক বালকের জীবনসংশয়ের কথা শুনে, সেই রাতটাই তো ওর জীবনের সবচেয়ে বড় রাত।

বিট্টু সেই ক্রিসমাস ভোলেনি। রুদ্রকিশোর তাকে মনে রেখেছে।

অ্যান্টিক্রাইস্ট কিংবা কলকাতার জিশু

সৌমেনকাকু, ‘মুক্তির দূত’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন মহল্লায়। যে কোনও কথার শেষে উনি বলে উঠতেন, “কিন্তু মানুষের মুক্তি কী ভাবে আসবে?” সেই থেকে ওঁর নামই হয়ে গিয়েছিল, ‘মুক্তির দূত’। উনি বাজার থেকে ফেরার পথেও অনেক সময় ওই শব্দবন্ধ উচ্চারণ করে ডেকে উঠত ছেলেরা। সৌমেনকাকু প্রথম প্রথম রেগে উঠলেও পরের দিকে পাত্তা দিতেন না। যাঁরা ভাবের ঘোরে থাকেন, তাঁরা খানিকটা ও রকমই হন হয়তো। আসলে সৌমেনকাকুরও একটু সমস্যা ছিল। কোথায় কী বলতে হবে বুঝতেন না।

এক বার যেমন বড়দিন উপলক্ষে পাড়ার ফিস্টে এসে বলতে শুরু করেছিলেন।

কী বলছিলেন? বলছিলেন যে, ক্ষমতা নিজেই একটা ধর্ম। আর তার প্রকাশ ক্ষমতাহীনের উপর অত্যাচারে। সেই কারণে ক্ষমতাহীন মাত্রেই ধর্মহীন। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দার্শনিক নিটশে যে ‘অ্যান্টিক্রাইস্ট’-এর কথা বলেছিলেন, সেই অ্যান্টিক্রাইস্ট হয়ে উঠতে হবেই।

“মানে, জিশুর বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াতে হবে?” পাড়ার ক্লাবের কেউ একটা জিজ্ঞেস করেছিল।

সৌমেনকাকু উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন, “মোটেই নয়। জিশু তো পৃথিবীর চিরকালের নির্যাতিত জনগণের প্রতীক। তিনি যখন নিজের ক্রুশ নিজের ঘাড়ে বইছিলেন, তখন রাস্তার লোকেরা কেউ চুপ করেছিল, কেউ আওয়াজ দিচ্ছিল। সেই মুহূর্তে কী রকম শাসক পেলে ভাল হত আমাদের? এমন শাসক যে ‘অ্যান্টিক্রাইস্ট’। সে জিশুর কাছে প্রার্থনা করার বদলে, ওঁর বোঝা লাঘব করবে। ওঁর ঘাড় থেকে ক্রুশটা নামিয়ে নেবে। প্রশাসকযদি একা মানুষকে না বাঁচায়, যদি কেবলই দলের দিকে, ভিড়ের দিকেই থাকে তার নজর, তা হলে সে কিসের প্রশাসক?”

সেই দিন, সেই মুহূর্তে পাড়ার অনেকেই হেসে উঠেছিল। উৎসবের রাত, পেটে জল-পানিও প্রচুর অনেকেরই, কেউ হাসলে দোষ দেওয়া যায় না। তবে কেউ কেউ চুপ করেও গিয়েছিল কথাটা শুনে।

বছর পাঁচেক পরেও অনেকে হাসত, কিন্তু সেটা একেবারে অন্য কারণে। তত দিনে সৌমেনকাকুর তিনশো ষাট ডিগ্রি বদল হয়ে গেছে। পায়ে হেঁটে রোজ ভোরে উনি কালীঘাট যান। নির্জলা উপোস করেন অমাবস্যা এলেই। ঠিক কী কারণে, কেন এ রকম আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল লোকটার, কেউ বলতে পারে না। কিন্তু বাইরের সত্যকে অস্বীকার করলে ভিতরের মিথ্যাকেই যে প্রশ্রয় দিতে হয়।

ওই কালীপুজোর রাতেই এক বার জিশুর ছবি বুকে জড়িয়ে হাপুস কাঁদছিলেন সৌমেনকাকু। দৃশ্যটা দেখতে অবাক হয়েছিল অনেকেই। কয়েক জন সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করায় কাকু বলেছিলেন, “কালী কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কালী।”

“কিন্তু আপনি তো কৃষ্ণ নন, জিশুকে আঁকড়ে আছেন!” বলেছিল কেউ।

“জিশুর হাতে পেরেক ঠুকে ঠুকে রক্ত বইয়ে দিল আর কৃষ্ণের পায়ে এসে বিঁধল জরার তির। জিশুর হাতে রক্ত, কৃষ্ণের পায়ে রক্ত…”

বিড়বিড় করতে করতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলেন সৌমেনকাকু।

তার ঠিক সাত দিন পর থেকে সৌমেনকাকুকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না কোথাও। অনেক থানা-পুলিশ হল, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল, গঙ্গায় জালও ফেলা হল, কিন্তু সৌমেনকাকুকে আর পাওয়া গেল না ।

ভবানীপুরের পুরনো পাড়ায় আজও কারও কারও বড়দিন এলেই মনে পড়ে সেই লোকটার কথা, যে কালীপূজার রাতে কৃষ্ণ আর জিশুর ক্ষতকে এক আয়নায় দেখে ফেলেছিল। কী বলেছিল দেখে?... “যিশু যদি কাল কুয়াশার পথে আবার আসেন ফিরে/ মারা হবে তাঁকে, রাখা হবে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত শিরে?”

সিক্রেট স্যান্টা কিংবা শাস্তি পাওয়া শিল্পী

আদর্শ তো আদর্শই, কিন্তু তার পাথরে প্রাণসঞ্চার করে কোনও না কোনও মানুষ। এই রকমই এক জন মানুষ ছিলেন কানসাসের ল্যারি স্টুয়ার্ট। পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই স্টুয়ার্ট সাহেব বাসস্টপে কিংবা পার্কে দরিদ্র, গৃহহীন মানুষদের গোপনে সাহায্য করে বেড়াতেন। সন্তর্পণে পঞ্চাশ-একশো ডলারের বিল চালান করে দিতেন তাঁদের পকেটে বা ঝোলায়। যখন ক্যানসার ওঁর প্রাণ কেড়ে নেয়, তখন ল্যারি স্টুয়ার্টের বয়স মাত্র আটান্ন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে উনি ওঁর এই কাজটার কথা জানিয়ে যান যাতে ধারাটা থেমে না যায়। ধন্য-ধন্য পড়ে যায় আমেরিকা জুড়ে, কিন্তু নিজের সুখ্যাতি স্টুয়ার্ট শুনতে চাননি, শোনেনওনি বেশি দিন।উনি চলে যাওয়ার পর, একটা হিসাব থেকে দেখা যায় যে উনি প্রায় দেড় কোটি ডলার নিঃশব্দে বিলিয়ে দিয়েছেন। তখনই ওঁর নামকরণ করা হয়, ‘সিক্রেট স্যান্টা’।

“ওঁর কাজটাকে ছোট করছি না, কিন্তু ল্যারি স্টুয়ার্টের কাছে অনেক টাকা ছিল বলেই উনি এ ভাবে মানুষের কাজে লাগতে পেরেছিলেন। যাঁদের টাকা নেই, তাঁরাও অনেকে জিশুর কাজ করে যান। কিন্তু তাঁদের কথা প্রচারের আলোয় আসে না,” আমেরিকারই অন্য একটি শহরে, ল্যারি স্টুয়ার্টের কথা শুনতে শুনতে বলে উঠেছিল রাশিয়ারমেয়ে তাতিয়ানা।

সেটা ছিল একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন। পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে অভ্যাগতরা এসেছিলেন সেখানে। তাঁদেরই তিন-চার জন তাতিয়ানার কাছ থেকে জানতে চাইলেন, অন্য কোনও সিক্রেট স্যান্টার কথা ওর জানা আছে কি না।

“সিক্রেট কেন হতে যাবে, আমার ঠাকুরদা যা করেছিলেন তা প্রকাশ্যে!” তাতিয়ানা বলে উঠল।

“কী নাম ওঁর? কী করেছিলেন উনি?”

প্রশ্ন যারা করল, তাদের মুখের দিকে এক বার তাকিয়ে তাতিয়ানা ঢুকে গেল গল্পে।

“তখন হিটলারের বাহিনী আক্রমণ করেছে রাশিয়া। আর সেই আক্রমণকারীরা ভোলগার উৎসমুখে থাকা একটি ছোট্ট গির্জাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। সেই সময় ওই ভোলগার কাছেই রাশিয়ার এক দল সৈন্য একটি রেললাইন বানাচ্ছিল। সেই রেললাইনটার দরকার ছিল সৈন্যদের কাছে কাঁচামাল পৌঁছে দেওয়ার জন্য। সারা দিন, এমনকি রাতেও তারা ওই রেললাইন পাতার কাজ করত। আর সেই কাজ করতে করতেই তারা দেখতে পায় সেই ছোট্ট চ্যাপেলটা, যেটা নাৎসিরা ধ্বংস করে দিয়েছে। ওই ভাঙা চ্যাপেল দেখে বাহিনীর কম্যান্ডারের মনে হল যে, তিনি চ্যাপেলটা আবার গড়ে তুলবেন। কিন্তু কী ভাবে বানাবেন? কে সেই চ্যাপেলের ড্রয়িং করবে? ডাকা হল তাতিয়ানার ঠাকুরদা, ইঞ্জিনিয়ার সার্গেই ড্যানিলভকে। ড্যানিলভ জীবনে কখনও চ্যাপেলের ড্রয়িং করেননি। কিন্তু ওঁকে ডেকে যখন কম্যান্ডার আদেশ দিলেন, তখন কোনও অজুহাত না দিয়ে কেবল চার দিন সময় চেয়ে নিলেন ড্যানিলভ।

“উত্তরে বাহিনীর কম্যান্ডার বললেন যে, ড্রয়িংটা তাঁর কাল সকালের মধ্যে চাই। এর চেয়ে এক মিনিটও বেশি সময় দেওয়া যাবে না।

“ড্যানিলভ আর কথা না বাড়িয়ে কম্যান্ডারের সামনে থেকে সরে গেলেন। তার পর সারা রাত জেগে, ঘুমিয়ে থাকা সৈন্যদের মধ্যে বসে, কাজ করে গেলেন। সতীর্থদের ঘুম যাতে না ভাঙে তাই লন্ঠনটার আলো আরও স্তিমিত করে পাগলের মতো একটা চ্যাপেলের নকশা আঁকতে থাকলেন ড্যানিলভ। আঁকতে আঁকতে যখন আর চোখ মেলতে পারছেন না, তখন বাইরে বেরিয়ে ওই ভোলগার জল খানিকটা চোখেমুখে ছিটিয়ে নিলেন। তার পর ফিরে এসে আবারও আঁকতে শুরু করলেন।

“চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর কম্যান্ডারের কাছে চ্যাপেলের নকশা জমা দিলেন ড্যানিলভ। কম্যান্ডার তৎক্ষণাৎ ডেকে নিলেন তাঁর দলের সেরা কয়েক জন কর্মীকে। তাদের কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ কার্পেন্টার, কিন্তু লক্ষ্যে একাগ্র সবাই। সারা দিন রেললাইন পাতার কাজ করে, সারা রাত ধরে তারা বানিয়ে তুলত চ্যাপেল। কেবল একটি ঐতিহ্যকে ধ্বংস হতে দেবে না বলে। মাসখানেকের মধ্যে, ধ্বংসস্তূপের ভিতরেই একটি নতুন চ্যাপেল যখন মাথা তুলে দাঁড়ায়, তখন সেই চ্যাপেলের গায়ে লেখা হয়, ‘বর্বররা যা ধ্বংস করে দিয়েছিল আমরা তা আবার গড়ে তুললাম’।

“ওই চ্যাপেলের গায়ে নিজের নাম সই করার পর্ব আসে তার পর। প্রথমে ইউনিট কম্যান্ডার, তার পর ইঞ্জিনিয়ার সার্গেই ড্যানিলভ, আর তার পর গড়ে তোলার কাজে হাত লাগিয়েছে যারা, তারা সবাই সই করে। ওরা ভেবেছিল, এ ভাবেই ওদের নাম থেকে যাবে ইতিহাসে। ভবিষ্যতেও যারা ভোলগার উৎসমুখে যাবে, তারা ওই ছোট্ট চ্যাপেলটাকে দেখতে পাবে। যে চ্যাপেল নাৎসিরা ভেঙে দিয়েছিল, কিন্তু রাশিয়ান সৈন্যরা তৈরি করেছিল আবার, তা দেখে শ্রদ্ধায় নত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাথা— ভালবাসা আর গর্বে ভরে উঠবে বুক।”

“বাহ্‌! চমৎকার কাহিনি।” হলের ভিতরে থাকা অনেকেই হাততালি দিয়ে উঠলেন, তাতিয়ানার কথা শেষ হতেই।

“কিন্তু সেই চ্যাপেল বানানোর কী ফল পেয়েছিল আমার ঠাকুরদা, জানেন?” তাতিয়ানার গলাটা অন্য রকম শোনাল হঠাৎ।

“যুদ্ধ শেষ হওয়ার দু’বছর পর ঠাকুরদাকে ডেকে পাঠানো হয় মস্কোয়। তদন্ত কমিশনের সামনে। ওঁকে বলা হয়, দেশের ভিতরকার দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে জাগানোর জন্য নতুন করে চ্যাপেলের নকশা করেছিলেন উনি। যুদ্ধের মধ্যে কেন তিনি ওই গির্জা বানানোর কাজে যুক্ত হয়েছিলেন তা-ও জানতে চাওয়া হয়।

“সার্গেই ড্যানিলভ কিছুতেই তদন্তের নামে প্রহসন করতে থাকা লোকগুলোকে বোঝাতে পারেন না যে, তিনি চ্যাপেলের নকশা বানাননি, ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটা সৌধকে আবার গড়ে তোলার শুরুর কাজটা করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসকেই যারা নিজের ইচ্ছের ছাঁচে ঢালতে চাইছে, স্ট্যালিনের সেই অনুচররা পুনর্নির্মাণের গল্প শুনবে কেন? ফলে তদন্ত কমিশনের আদেশে ঠাকুরদার ওই নকশা আঁকার কাজটা ‘অপরাধ’ বলে লিপিবদ্ধ হয়। হয়তো মৃত্যুদণ্ডই দেওয়া হত ওঁকে, কিন্তু তখন সাইবেরিয়াতে চলতে থাকা কোনও একটা সরকারি কাজে, দুর্দান্ত ড্রয়িং করতে পারে এমন ইঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন ছিল। তাই সাইবেরিয়ার ব্ল্যাক লেক-এর কাছে ঠাঁই হয় সার্গেই ড্যানিলভ-এর।

“বছরের পর বছর সাইবেরিয়ার ওই দুঃসহ ঠান্ডা, ওই জঙ্গল, ওই পাহাড়, ওই জমে যাওয়া নদীর ভিতর কাটিয়ে অবশেষে এক দিন মুক্তি পেলেন সার্গেই ড্যানিলভ। জীবন তিরিশ বছর চলে গেছে তত দিনে, সার্গেইও মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি জানিয়েছিলেন যে, তিনি এক বার তাঁর নকশা-আঁকা ওই চ্যাপেলে যেতে চান।

“‘কী করবেন ওই চ্যাপেলে গিয়ে? ওর জন্যই তো আপনার জীবনের যাবতীয় দুর্দশা। ওই অভিশপ্ত নকশা যদি না আঁকতেন, তবে আপনাকে এত দিন সাইবেরিয়ায় পচে মরতে হত না। আপনাকে দেখার জন্য এতগুলো বছর অপেক্ষা করতে হত না আমাদের!’ সার্গেই ড্যানিলভের ছেলে, তাঁর বাবার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন।

“কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ড্যানিলভ বলেন, ‘ওই নকশা আঁকাটা আমার কাছে অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ। এঁকেছিলাম বলেই আজও প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি যে, ঈশ্বর যদি অনুভবে থাকেন তবে একটা মানুষকে শত অত্যাচারেও মেরে ফেলা যায় না। কিংবা মেরে ফেললেও নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায় না। আমাকে ওই চ্যাপেলের কাছে নিয়ে চলো এক বার। বাতাস থেকে টের পাচ্ছি, ক্রিসমাস আসছে। আমি প্রার্থনা করব ওই চ্যাপেলে গিয়ে।’”

তাতিয়ানার বলা কাহিনি চোখে জল এনে দিয়েছিল অনেকেরই। ঈশ্বরকে চরম ভরসা করেও খড়কুটোর মতো মরে যাচ্ছে কত মানুষ রোজ। মানুষ তো মরণশীল। কিন্তু অনেক মানুষ মারা গেলেও, বিশ্বাস মরে না কখনও। তাই আজও চব্বিশে ডিসেম্বরের রাতের গান ছড়িয়ে যায় চার দিকে। মোমবাতির আলো দূর অবধি ছড়িয়ে পড়ে। নতুন প্রার্থনাগৃহের নকশা আঁকে কেউ। আজও তিরিশ বছরেরও বেশি কারারুদ্ধ থেকেও প্রার্থনায় বসতে চান সার্গেই ড্যানিলভের মতো মানুষেরা। আজও মেরির কোলে জিশু আসে।

মেরি ম্যাগডালিন বা হাঁসের ডিমের কেক

বৈষ্ণববাড়ির বিধবা উমাপিসি কে জানে কবে স্বপ্নে দেখেছিল জিশুকে! তার পর থেকে ওদের বাড়িতে ঠাকুরের সিংহাসনে নকুলদানার পাশাপাশি ক্রিম বিস্কুটও থাকত দু’টো। ক্রিম বিস্কুট কার জন্য আর নকুলদানা কার, সে তো জানা কথাই। কিন্তু কী হবে, এক দিন যদি জিশুর পছন্দ হয়ে যায় নকুলদানা আর গোপালের ভাগ্যে জোটে ক্রিম বিস্কুট?

এই সব ইয়ার্কির সামনে পড়লে হেসে এড়িয়ে যেত উমাপিসি। আসলে ওর অন্তরের বিশ্বাস এত দৃঢ় ছিল যে, কোনও সংশয় সেখানে ডালপালা মেলতেই পারত না। কিন্তু স্বপ্নের জিশুকে পুজো করার পাশাপাশি বাস্তবেও এক জনের কাছে দীক্ষা নিয়েছিল উমাপিসি। সেই সাধক ব্রহ্মচারীকে নিবেদন করবে বলে বড়দিনে হাঁসের ডিমের কেক বানাত পিসি। ওই কেক ঠাকুরের সিংহাসনে রাখা যাবে না, তাই মনে মনে নিবেদন করে আমাদের কয়েক জনকে ডেকে খাইয়ে দিত। কিন্তু যে বার ব্রহ্মচারী মহারাজের দেহাবসানের পর তাঁর কয়েক জন শিষ্য মৃত্যুকে ‘নির্বিকল্প সমাধি’ আখ্যা দিয়ে শেষকৃত্য করতে দিচ্ছিল না ওঁর নশ্বর শরীরের, সে বার উমাপিসিও দেখতাম বলেই যেত যে, পুনরুত্থান হবে ওঁর গুরুদেবের। আমাদের এক অধ্যাপক দাদা বলতেন যে, উমাপিসির ভিতর নাকি মেরি ম্যাগডালিন ভর করেছেন। কে ‘মেরি ম্যাগডালিন’ তা জানতাম না তখন। পরে বহু বার ভেবেছি, আদৌ কোনও মিল আছে কি না জিশুর রেজ়ারেকশন প্রথম দেখতে-পাওয়া মেরির সঙ্গে উমাপিসির।

উমাপিসির গুরুর মরদেহ এক দিন দায়িত্ব নিয়ে সৎকার করে দেয় পুলিশ। উমাপিসির কথা খুব কমে যায় তার পর থেকে। তপস্যার ভিতরে থাকা তাপ শীতল হতে থাকে। কেবল বছরে এক দিন পাড়ার কোনও একটা ছেলে ডাক পায়, হাঁসের ডিমের কেক চাখার জন্য। সেই কেক আয়তনে ছোট হলেও অনেকটা ভালবাসা মিশে থাকে তার মধ্যে। যে ভাবে পুজোয় মিশে থাকে প্রায়শ্চিত্ত। ছোট ছোট অনেকগুলো দিনের ভিতর মিশে থাকে বড়দিন। বছরে এক দিন, সামনে এসে দাঁড়াবে বলে।

কবিতা ঋণ: সুবোধ সরকার

অন্য বিষয়গুলি:

Mother Mary Jesus christ
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE