Advertisement
১৫ ডিসেম্বর ২০২৪
Lal Behari Dey

ধর্মান্তরিত হলেও অটুট ছিল তাঁর বাঙালি সত্তা

স্বজাতির মধ্যে শিক্ষাবিস্তারই ছিল তাঁর ব্রত। তাঁর কলমে জীবন্ত বাংলার কৃষকের বৃত্তান্ত, সংগৃহীত লোককাহিনি। আগামী বুধবার পূর্ণ হবে রেভারেন্ড লালবিহারী দে-র জন্মের দ্বিশতবর্ষ।

কীর্তিমান: রেভারেন্ড লালবিহারী দে।

কীর্তিমান: রেভারেন্ড লালবিহারী দে।

বিধান রায়
শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৪:৫০
Share: Save:

বর্ধমানের অনতিদূরে জনপদ সোনাপলাশী। ওই গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলেন রাধাকান্ত দে। জাতিতে সোনার বেনে, গোঁড়া বৈষ্ণব। কলকাতায় কোম্পানির কাজ করতে গিয়ে ইংরেজি না জানার অসুবিধে প্রতি পদে উপলব্ধি করতেন। সন্তানকে ইংরেজি শেখানোর জন্য গ্রামের স্কুলের পাঠ শেষ হতেই কলকাতায় পাঠিয়ে আলেকজ়ান্ডার ডাফের জেনারেল অ্যাসেম্বলি’জ় ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করে দেন। সন্তান আপন মেধায়, বিদ্যোৎসাহী ডাফ সাহেব ও টমাস স্মিথের সাহচর্যে নিজেকে গড়ে তোলেন। বহুভাষাবিদ, সুলেখক, শিক্ষাবিদ, লোককাহিনি-সংগ্রাহক, পত্রিকা সম্পাদক এই মহান মানুষটি রেভারেন্ড লালবিহারী দে। তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হবে আগামী ১৮ ডিসেম্বর।

লালবিহারীর শৈশবে গ্রামের বুড়োশিবের নাটমন্দিরে বসত গুরুমশাই গোপীকান্ত মুখোপাধ্যায়ের পাঠশালা। লালবিহারীর ‘ভিলেজ পাঠশালা’ লেখাটি থেকে জানা যায়, তখনকার শ্রেণিবিভাজন: যেমন, ভুঁই ক্লাস (ফ্লোর ক্লাস), তালপাতা ক্লাস (পাম লিফ), কলাপাতা ক্লাস (বানানা লিফ) ইত্যাদি। তাঁর হাতেখড়ি থেকে রামমোহনের গৌড়ীয় ব্যাকরণ সম্পন্ন হয় পাঠশালাতেই। পাঁচ বছর বয়সে, গৃহভৃত্য তিনকড়ির সঙ্গে পায়ে হেঁটে ত্রিবেণী, সেখান থেকে এক দিন নৌকোয় জগন্নাথ ঘাট হয়ে কলকাতা। তখন কলকাতায় সাকুল্যে তিন-চারটে নামকরা স্কুল। হিন্দু কলেজ, হেয়ার সাহেবের স্কুল, ডাফ সাহেবের স্কুল আর গৌরমোহন আঢ্যের ওরিয়েন্টাল সেমিনারি। প্রতিটি স্কুলেই মাসিক বেতন চার-পাঁচ টাকা করে। এত খরচ বহন করা রাধাকান্তের পক্ষে অসম্ভব। রামমোহন রায়ের পুত্র রাধাপ্রসাদের সুপারিশে ডাফ সাহেবের স্কুলে পড়ার সুযোগ পান লালবিহারী।

১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। লালবিহারী পাদরির পদ গ্রহণ করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন। সেই সূত্রে ধর্মপ্রচারকের ভূমিকাও তাঁকে পালন করতে হয়েছে। তবে আলেকজ়ান্ডার ডাফ শিক্ষাবিস্তারের নামে ধর্মপ্রচার করতেন, আর রেভারেন্ড লালবিহারী দে সুকৌশলে ধর্মপ্রচারের নামে শিক্ষাবিস্তার করতেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালি জাতির উন্নতি করতে গেলে শিক্ষার প্রসার ছাড়া উপায় নেই। তাই ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ‘কম্পালসরি এডুকেশন অব বেঙ্গল’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে তৎকালীন সরকারের কাছে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান। তাঁর নিজের সম্পাদনায় ‘ইন্ডিয়ান রিফর্মার’, ‘ফ্রাইডে রিভিউ’, ‘বেঙ্গল ম্যাগাজ়িন’, বাংলায় ‘অরুণোদয়’ প্রভৃতি পত্রিকায় বাংলার কৃষকদের বাস্তব জীবনের কথা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

প্রতিযোগিতায় প্রবন্ধ লিখেই লেখালিখির সূত্রপাত। তখন তিনি ছাত্র। ১৮৪১ এবং ১৮৪২, পর পর দু’বছর জেনারেল অ্যাসেম্বলি’জ় ইনস্টিটিউশন আয়োজিত প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় সেরা প্রবন্ধকার হিসেবে পঞ্চাশ টাকা করে পুরস্কার পান। প্রবন্ধ দু’টি ছিল যথাক্রমে ‘কনভার্সন অব সেন্ট পল’ এবং ‘ফলসিটি অব হিন্দু’।

১৮৭১ সালে যখন তিনি বহরমপুর কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষ, উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন— বাংলা অথবা ইংরেজিতে উপন্যাস লিখতে হবে। বিষয়, বাংলার কৃষকজীবন। পুরস্কারমূল্য পাঁচশো টাকা। অন্যান্য লেখার সঙ্গে লালবিহারী দে-র লেখাও জমা পড়ল। লেখার বিচারক ‘ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকার সম্পাদক ড. জর্জ স্মিথ, জাস্টিস জে বি ফিয়ার, অধ্যাপক ই বি কাউল। ইংরেজিতে লেখা লালবিহারীর ‘গোবিন্দ সামন্ত, অর দ্য হিস্ট্রি অব আ বেঙ্গল রায়ত’ উপন্যাসটি জুরিদের বিচারে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হল। পেলেন পাঁচশো টাকার পুরস্কার। ‘গোবিন্দ সামন্ত’ উনিশ শতকের বাংলার কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশার এক অনবদ্য আলেখ্য হয়ে আছে আজও। বইটি ১৮৭৯ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট আঠারো বার মুদ্রিত হয়।

ক্যাপ্টেন আর সি টেম্পল এক বার লালবিহারী দে-কে অনুরোধ করেন, বাংলার মা-ঠাকুমারা যে গল্প যুগ যুগ ধরে বলে আসছেন, সে রকম একটা সঙ্কলন তিনি যদি তাঁকে তৈরি করে দেন। লালবিহারী লিখছেন, “প্রস্তাবটা আমার মনে লেগে গেল, আমিও উপকরণ সংগ্রহ করতে লেগে গেলাম।” জনৈক ইংরেজ ভদ্রমহিলা, এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ আর এক বৃদ্ধ নাপিতের মুখে শুনে শুনে রচিত হয়ে গেল ‘ফোক টেলস অব বেঙ্গল’ নামের বিখ্যাত এক লোককথা সংগ্রহ। এই গ্রন্থটিই বাংলার সবচেয়ে পুরনো লোককথার সঞ্চয়।

আচারসর্বস্ব হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন ঠিকই, কিন্তু গ্রামীণ পালা-পার্বণ, উৎসব, লৌকিক অনুষ্ঠান তিনি অন্তর থেকে ভালবাসতেন। তিনি ‘বাংলার উপকথা’ (লীলা মজুমদার-কৃত অনুবাদ) গ্রন্থে লিখেছেন, “‘বাংলার কৃষিজীবন’ বলে আমার যে ইংরাজি বই আছে, তাতে আমি চাষীর ছেলে গোবিন্দকে রোজ সন্ধ্যায় কয়েক ঘণ্টা শম্ভুর মা বলে এক বুড়ির কাছে গল্প শুনিয়েছি।” অর্থাৎ কাহিনির নায়ককে তিনি মাটির শিকড় ছুঁইয়ে নির্মাণ করেছেন। গোবিন্দ-কাহিনির মধ্য দিয়েই তৎকালীন কৃ্ষকসমাজের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। কাঞ্চনপুরের জমিদার জয়চাঁদ রায়চৌধুরীর ধর্মপুত্রের বিয়ে উপলক্ষে প্রজাদের ‘মাথোট’ (অতিরিক্ত কর) দিতে হবে। গোবিন্দ সরাসরি অস্বীকার করে। পেয়াদা হনুমান সিং তাকে ধরে নিয়ে যায়। জমিদার অবাক, কারণ তাঁর জমিদারিতে এই প্রথম কেউ ‘মাথোট’ দিতে অস্বীকার করল। নায়েব কানে কানে বলেন, ‘হুজুর গোবিন্দ পাঠশালায় পড়েছে।’ গোবিন্দর সহচর নন্দ বলেছে, ‘আমি ভয় পাই না।... সবাই ধর্মঘট করে বলব দেব না মাথোট।’

এখানেই লালবিহারীর ‘গোবিন্দ সামন্ত’ আলাদা জায়গা করে নেয়। শিক্ষাই চাষীদের অধিকার বুঝে নিতে সাহস জোগাবে, বুঝেছিলেন লালবিহারী। তাই বঞ্চিত চাষীরা লড়াইয়ের চূড়ান্ত স্তর ধর্মঘটের ইঙ্গিত করছে। সমগ্র ‘কাঞ্চনপুর’ হয়ে উঠল কৃষক-জাগরণের অন্যতম ভূমি। ঊনবিংশ শতকের কথা-কাহিনিতে এক নতুন স্বর উচ্চারিত হল। গোবিন্দর আর এক সহচর কালোকে জমিদার পেয়াদা মারফত ডেকে পাঠিয়েছেন। কালো বলেছে, ‘আমি তেনার চাকর নই যে ডাকলেই যেতে হবে।’ লালবিহারী দে-র গোবিন্দ-কাহিনিকে অনেকে গণসাহিত্যের পূর্বাভাস বলেছেন। তাঁরা ভুল বলেননি। এই রকম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর পরবর্তী কালের কথাসাহিত্যে আরও বহু বার এসেছে।

বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন, কবি আলফ্রেড টেনিসন প্রমুখ বিশিষ্টজন ‘গোবিন্দ সামন্ত’ উপন্যাসটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। টেনিসন সাহেব লিখেছেন, “ইহা পড়িয়া বাঙালী কৃষকগণের সামাজিক জীবন ও আচার ব্যবহারের কথা জানিতে পারিলাম। আমাদের দেশে আজকাল যত বড় বড় উপন্যাস লেখক আছেন আপনি তাঁহাদের অনেকের অপেক্ষা সুন্দর প্রাঞ্জল ইংরাজী লিখিতে পারেন।” (সূত্রঋণ: নিবন্ধ ‘শ্রুতকীর্তি রেভারেন্ড লালবিহারী দে’— ড. দেবীপদ ভট্টাচার্য)।

১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে নিদারুণ অর্থকষ্ট ও মনোকষ্ট নিয়ে প্রথাবিদ্রোহী লালবিহারী চিরবিদায় নেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সোনাপলাশী গ্রামে লালবিহারী দে-র নামে একটি পাঠাগার নির্মাণ করেন এলাকার তৎকালীন জননেতা জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস। সেই গ্রন্থাগারের প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক দেবদাস বিশ্বাস জানালেন, “সমাজবিজ্ঞানী কুসুম নায়ার, সমাজবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র তারাকৃষ্ণ বসু, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির নাথানিয়েল ওয়ান্ডার প্রমুখ বহু গবেষক এই সোনাপলাশী (উপন্যাসের কাঞ্চনপুর) গ্রামে এসেছেন। তাঁরা লালবিহারী দে ও তাঁর লেখার উপর ভিত্তি করে বাংলার কৃষিজীবন, কৃষকসমাজ, সর্বোপরি বাংলার সংস্কৃতিকে জানতে বুঝতে চেয়েছেন। এখনও আসেন অনেকে।”

সোনাপলাশী মোড় থেকে গ্রামের খিন্নিতলা পর্যন্ত নির্মিত পাকা রাস্তাটির নাম রাখা হয়েছে রেভারেন্ড লালবিহারী দে সরণি। জন্মভিটেয় স্মৃতিস্তম্ভটি অনেক আগেই, ১৯৫২ সালে গ্রামবাসীরা স্থাপন করেন।

অন্য বিষয়গুলি:

birth anniversary
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy