Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

চাকরি গেল রোবটের

হিউম্যানয়েড রোবট। বন্ধুর মতো গপ্প করবে, আবার গালমন্দ করলে ছেড়ে কথা বলবে না! চাইলে সন্তানের মতো দত্তকও নিতে পারেন তাকে।হিউম্যানয়েড রোবট। বন্ধুর মতো গপ্প করবে, আবার গালমন্দ করলে ছেড়ে কথা বলবে না! চাইলে সন্তানের মতো দত্তকও নিতে পারেন তাকে।

যন্ত্রমানবী: রোবট নাগরিক সোফিয়া

যন্ত্রমানবী: রোবট নাগরিক সোফিয়া

ঊর্মি নাথ
শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

প্রফেসর শঙ্কুর রোবট বিধুশেখরের কথা মনে আছে? যাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে খোদ শঙ্কুরই ধন্দ লেগে যেত। নিজের হাতে তৈরি বিধুশেখর মাঝে মাঝে এমন ব্যবহার করত যা তাঁর হিসেবে মেলে না।

প্রফেসর শঙ্কুর স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ের কল্পনা আর নিছক গল্পের মধ্যে আটকে নেই। সোফিয়া, পেপার, ফাবিও, সিরি-রা এখন বিশ্বসংসারে হইচই ফেলে দিয়েছে। এরা মানুষ নয়, কিন্তু মানুষের মতো! হিউম্যানয়েড রোবট।

এদের ‘বুদ্ধি’ সাধারণ রোবটের চেয়ে অনেকটাই বেশি। কারণ এদের মধ্যে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’-এর মাইক্রোচিপ পুরে দেওয়া হয়। বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তথ্য, সমস্যার সমাধান বিভিন্ন কাজ শেখার চেষ্টা ইত্যাদি সব কিছুই সেখানে প্রোগ্রামিং করে রাখা। অতঃপর রোবটেরা বন্ধুর মতো আপনার সঙ্গে গল্প করবে। কখনও বুঝিয়ে দেবে কী ভাবে অর্থ সঞ্চয় করতে হবে, কোন বিমা-প্রকল্পে কত বছরের জন্য টাকা রাখলে ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত হবে।

আবার সুপারমার্কেটে চাল-ডাল নুন-তেল থেকে জামাকাপড় কেনায় সাহায্য করবে এই রোবট। এমনকি মন ভাল না থাকলে কী করবেন, সে ব্যাপারে পরামর্শও দেবে। এক কথায় ‘মুশকিল আসান’ তকমা দেওয়া যায় এই রোবটকে। মনকষাকষিও হতে পারে এদের সঙ্গে আপনার! আপনি তাকে গালমন্দ করলে সে আপনাকে ছেড়ে দেবে এমন কিন্তু ভাববেন না।

এই হিউম্যানয়েড রোবটদের মধ্যে সোফিয়া প্রথম ‘রোবট নাগরিক’। ২০১৭ সালের এপ্রিলে সৌদি আরবের নাগরিকত্ব পেয়েছে সে। হোক না সে রোবট, কিন্তু তার ধর্ম? ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষকে সৌদি আরব তো নাগরিকত্ব দেয় না! তা হলে? সোফিয়াকে নাগরিকত্ব দেওয়ার আগে এই প্রসঙ্গ তুলেছিল বেশ কয়েক জন সৌদি নাগরিক। যদিও তাঁদের অভিযোগ ধোপে টেকেনি। কারণ সোফিয়া যে মানুষ নয়, এই ব্যাপারটাই ভুলে গিয়েছিলেন অনেকেই। সোফিয়াকে দেখলে অবশ্য এই ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক।

হংকংয়ের হানসন রোবোটিক কোম্পানি সোফিয়াকে তৈরি করেছে প্রধানত অটিজম ও অবসাদের গবেষণার কাজে সাহায্যর জন্য। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং বিমা সংক্রান্ত কাজ এবং কাস্টোমার কেয়ারের কাজেও সে পারদর্শী। সোফিয়া কিন্তু বেশ সুন্দরী। তার মুখের আদল হলিউডের অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের মতো। কথা বলতে বলতে কখনও তার ভুরু কুঁচকে যায়, কখনও প্রাণবন্ত হাসিতে ভরে উঠে মুখ। কখনও ঠোঁট বেঁকিয়ে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেয় সমস্যার কথা। প্রায় ৬২ রকমের মুখভঙ্গি করতে পারে সোফিয়া। উল্টো দিকের মানুষটিকে দিব্যি নকল করতে পারে, পারে গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে। এমনকি কণ্ঠস্বর শুনে সোফিয়া বুঝতে পারে তার সঙ্গে যিনি কথা বলছেন তিনি সোফিয়ার পূর্বপরিচিত কি না। সোফিয়া যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, সেই ডক্টর ডেভিড হানসন সোফিয়াকে নিয়ে আজও কাজ করে যাচ্ছেন। ক্রমশ আরও উন্নত হচ্ছে এই রোবট-নারী। ঠিক যেমন ভাবে মানুষের বুদ্ধি পরিণত হয়।

ইতিমধ্যে সোফিয়া ভারত ঘুরে গিয়েছে। মুম্বইয়ের আইআইটি-র একটি অনুষ্ঠানে তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। এই অনুষ্ঠানে প্রশ্ন-উত্তর পর্বের বিভিন্ন প্রশ্নের মধ্যে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তার প্রিয় অভিনেতার নাম। ‘‘শাহরুখ খান!’’ ঠোঁটের ডগায় ছিল তার উত্তর। রিয়াধে একটি সাংবাদিক বৈঠকে তার বলা উত্তরগুলো বুঝিয়ে দিয়েছিল, সোফিয়া যন্ত্র হতে পারে কিন্তু তার রসবোধ তারিফ করার মতো।

এই মুহূর্তে হিউম্যানয়েড রোবটের তালিকায় সোফিয়া একা নয়। জাপানের পেপার সিরিজের রোবট রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে। পেপার রোবট কোনও ব্যক্তির সঙ্গে অল্প ক্ষণ কথা বলেই ঠিক বুঝে ফেলে মানুষটির মনটা কেমন। কোনও জাদু নয়, সামনের ব্যক্তির চোখের রং, স্বর, শরীরী ভাষা ইত্যাদি দেখেই পেপার বুঝে ফেলে এ সব। উল্টো দিকের মানুষের কথা শুনে সে তাঁকে বুঝিয়ে দেয় তার প্রতিক্রিয়া। সে খুশি হল না রেগে গেল, না কি অবাক হল— এই সব অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে তার বুকে লাগানো স্ক্রিনে। সেটাই পেপারের মনের জানালা। হাসি, রাগ, বিস্ময়ের এক এক রকম রং। কোনওটা লাল, কোনওটা নীল কোনওটা বা সবুজ— কথা বলতে বলতে বদলে বদলে যায় পেপারের বুকে লাগানো স্ক্রিনের রং।

জাপানে প্রায় ১৪০টি সফ্‌ট ব্যাঙ্ক স্টোর চলছে এই পেপার রোবটের সাহায্যে। ব্যাঙ্ক সম্পর্কিত যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর এরা দেবে গ্রাহককে। টোকিয়ো শহরের এক দম্পতি ইতিমধ্যে দত্তক নিয়ে ফেলেছেন এক পেপার রোবটকে। তাঁরাই প্রথম দম্পতি যাঁরা রোবটকে দত্তক নিয়েছেন।

রোবট তো মানুষের তৈরি। তা হলে মানুষকে কি বুদ্ধির লড়াইতে সে কখনও হারাতে পারবে? উত্তর অবশ্য পাওয়া গিয়েছে দেড় বছর আগেই। সাদা-কালো গুটি নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বোর্ড গেম ‘গো’। অনেকেই বলেন, দাবার চেয়েও ঢের কঠিন। দেড় বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার সোল শহরে এক ঘর সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানের সামনে বিশ্ববিখ্যাত গো-প্লেয়ার লি হতবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমি কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’’ ১২ বছর বয়স থেকে ‘গো’ খেলতে শুরু করে ৩৩ বছরে তাঁর পকেটে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট জিতে ১০ লক্ষ ডলার। এই মিলিয়ন ডলারের খেলোয়াড়কে গোহারান হারিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স কোম্পানির কম্পিউটার ‘আলফা গো’।

কিন্তু এত কিছুর পরও কী যন্ত্র পুরোপুরি মানুষের বিকল্প হতে পারে? এই প্রশ্ন উঠেছে বারংবার। বিশেষ করে হিউম্যানয়েড রোবট প্রসঙ্গে। রোবটকে চাইলে আপনি জড়িয়ে চুমু খেতে পারেন, আবার পেটাতেও পারেন, গালমন্দও করতে পারেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, চুমু আর আঘাতের মধ্যে পার্থক্য করার মতো ক্ষমতা আছে কি ওদের? আছে! ব্রিটেনের এক দোকানে ক্রেতাকে ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য চাকরি যায় এক রোবটের। তাকে পরিষেবা দফতর থেকে সরিয়ে গুদামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হিউম্যানয়েড রোবট সিরিকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করা হলেও, সে ধ্যানী বুদ্ধের মতো শান্ত থাকতে পারে। কোনও জটিল প্রশ্নের উত্তরে সে বলবে, উত্তর সে দেবে না কারণ তাতে বিষয়টির গুরুত্ব বেড়ে যাবে। এই রোবট-দর্শন যে মানুষ কবে শিখবে!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE