Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
biriyani

বিরিয়ানিপুর

এই নামটিতেই যেন আজকাল বেশি মানায় ব্যারাকপুরকে। একেবারে সাধারণ খাবারের দোকান থেকে আচমকাই ঘটেছে এখানকার বিরিয়ানি-বিপ্লব। ছোট দোকান থেকে তৈরি হয়েছে বহুতল রেস্তরাঁ। যে কোনও মরসুমে, প্রায় প্রতি দিনই সে সব দোকানের সামনে পড়ে লম্বা লাইন। জনপ্রিয়তার আঁচ পোহাতেই যেন কলকাতার শতকপ্রাচীন নামী বিরিয়ানি-ব্র্যান্ডও এখন ব্যারাকপুরে।

—ফাইল চিত্র।

সুজিষ্ণু মাহাতো , বিতান ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৩ ০৫:১৭
Share: Save:

সপ্তাহের যে কোনও দিন, যে কোনও সময়, ব্যারাকপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে শুধু। অথবা স্টেশন চত্বরের বাইরে এসে বেরোতে থাকা ভিড়ের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করতে হবে। খানিক ক্ষণই যথেষ্ট।

যে শব্দটা কানে আসবে, হলফ করে বলা যায়, তা হল ‘বিরিয়ানি’! জায়গার নাম, রাস্তার নাম বা এলাকার নামও বলতে হবে না। বিরিয়ানির দোকানের নাম বলে দিলেই টোটোচালকেরা হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে দেবেন, কোন টোটো সেখানে যায়! গত কয়েক বছরে এই জনপদ যেন বিরিয়ানির সঙ্গে ক্রমশ সমার্থক হয়ে উঠছে। আপনি যদি কিছু না জেনেও সেখানে পৌঁছন, আকাশ-বাতাস-পরিবেশের গুঞ্জন কিংবা বিশেষ বিখ্যাত রেস্তরাঁগুলির সামনে অপেক্ষারত দীর্ঘ লাইনই আপনাকে এখানকার বিরিয়ানি-খ্যাতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করবে।

ব্যারাকপুরের সঙ্গে আমজনতার পরিচিতির একটা বড় সেতু ইতিহাস। যে কোনও স্কুলপাঠ্য বইতে থাকা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সিপাহিদের বিদ্রোহের কথা, সেই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া মঙ্গল পাণ্ডের সূত্রে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিল ব্যারাকপুর। সেই ইতিহাস এখনও অটুট। তার টানে ব্যারাকপুর-অভিমুখী জনসাধারণের রসনা-পরিতৃপ্তির জন্য আশ্চর্য এক খাদ্য-বিপ্লবই যেন ঘটিয়ে ফেলেছে ব্যারাকপুর। এখানকার বিরিয়ানির স্বাদ-গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র।

ব্যারাকপুরের খাদ্য-মানচিত্রে যুগান্তর এনেছে বিরিয়ানি। প্রায় চার দশক আগে শুরু হওয়া একটি দোকানের জনপ্রিয়তা এমনই বাড়তে থাকে, তার টানে আশপাশের অঞ্চল তো বটেই, কলকাতা থেকেও বিরিয়ানি খেতে আসতে থাকেন বিরিয়ানি-ভক্তরা। এক দিকে, ব্যারাকপুরের সেই দোকানের সাফল্যে ভরসা করে ব্যবসা শুরু করে অন্য দোকানের জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এবং অন্য দিকে, ব্যারাকপুরমুখী এই বিরিয়ানি-জনতার স্রোতকে ধরতে মহানগরের শতকপ্রাচীন বিরিয়ানির
ব্র্যান্ডের ব্যারাকপুরে ছুটে আসা— এই দুইয়ে মিলেই বর্ধিত ব্যারাকপুর এখন কার্যত বিরিয়ানির সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছে।

জুলাইয়ের প্রথম রবিবার হালে বিরিয়ানি-দিবস হিসেবে উদ্‌যাপিত হচ্ছে। এ বছর সেই দিনেই একটি ফুড ডেলিভারি অ্যাপ সংস্থা হিসাব দিয়ে দাবি করল, গত এক বছরে ভারতীয়রা প্রতি মিনিটে ২১৯টি বিরিয়ানি অর্ডার করেছেন। এ কেবল একটি অ্যাপের হিসেব। ভারতে বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা কতটা, তা কেবল এই হিসাব থেকেই আন্দাজ করা যায়। আরও অন্য অ্যাপ, কিংবা অ্যাপ ছাড়া দোকানে গিয়ে কেনা ধরতে গেলে সংখ্যাটা কোথায় যাবে, তা কল্পনা করা কঠিন।

কল্পনা করা কঠিন, ব্যারাকপুর ও আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বড়-ছোট সব দোকান মিলিয়ে রোজ কত বিরিয়ানি বিক্রি হয়, তার হিসাবও। দোকান ঘুরে ঘুরে যা আঁচ পাওয়া গেল তা থেকে বোঝা যায়, রোজ শ’তিনেকেরও বেশি হাঁড়ি বিরিয়ানি বিক্রি হয় কেবল ব্যারাকপুর ও আশপাশের অঞ্চলের বড়-ছোট দোকান মিলিয়ে। একটি হাঁড়ি থেকে ক’প্লেট বিরিয়ানি হয়? বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, তা নির্ভর পরে পরিমাণের উপরে। আন্দাজ ৪০ থেকে ৬০ প্লেট। গড়পড়তা ৫০ ধরলে দিনে অন্তত ১৫ হাজার প্লেট বিরিয়ানি বিক্রি হয় কেবল এই ব্যারাকপুর ও লাগোয়া আশপাশের অঞ্চল জুড়েই। বিরিয়ানির দাম আন্দাজ করে নিলে এই বিরিয়ানি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিতটা কত পোক্ত, তা অনুমানে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য!

যে বিরিয়ানির নামে ব্যারাকপুর প্রথম পরিচিতি পায় কার্যত ‘বিরিয়ানিপুর’ হিসেবে, সেই দাদা-বৌদি বিরিয়ানির মালিক সঞ্জীব সাউ শোনাচ্ছিলেন, ধীরে ধীরে কী ভাবে এই ভিত গড়ে উঠল। সঞ্জীবের দাদু বিহার থেকে এসেছিলেন ইংরেজ আমলে। ব্যারাকপুরের সিপাহিদের ব্যারাকে কাজের সূত্রে আসা। পরে তাঁরা এখানকারই বাসিন্দা হয়ে যান। সঞ্জীবদের বাংলায় জন্ম, পড়াশোনা পুরোটাই।

“এই নাম, ‘দাদা-বৌদি’ এটাও বাংলার, মানে এলাকার মানুষেরই দেওয়া,” বলছিলেন সঞ্জীব।

সেটা কেমন করে?

“বাবা-মা প্রথম একটা হোটেল চালু করেছিলেন। স্টেশনের কাছে। নাম ছিল জনতা হিন্দু হোটেল। মায়ের রান্নার হাত ছিল দুর্দান্ত। যাঁরা ওই হোটেলে নিয়মিত খেতেন, তাঁরাই বাবা-মাকে দাদা-বৌদি বলতেন। সেই থেকে দাদা-বৌদির হোটেল।”

তার মানে জনতা হোটেলের নাম জনতাই বদলে দিল? প্রশ্ন শুনে হাসেন সঞ্জীব।

তবে সেই দাদা-বৌদি, অর্থাৎ সঞ্জীবের বাবা-মা কিন্তু বিরিয়ানি বানাতেন না। এই ভাবনা তাঁরই। সালটা কত ছিল, মনে নেই সঞ্জীবের। আন্দাজ বছর চল্লিশ আগে। সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ সঞ্জীব আর তাঁর বন্ধু কলিম খান এক বিশ্বকর্মা পুজোর আগে ঠিক করেন, তাঁরা বিরিয়ানি বানিয়ে বিক্রি করবেন। পাঁচ কেজি চালের বিরিয়ানি বানান কলিমই। দশ টাকা প্লেট। সেই শুরু। সেই কলিম আজও তাঁর বিরিয়ানির রসুইখানার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।

দুই বন্ধুর সেই যাত্রা শুরুর কথা সঞ্জীব যেখানে বসে বলছেন, সেটা একটি নির্মীয়মাণ পাঁচতলা রেস্তরাঁ। ব্যারাকপুর স্টেশনের খুব কাছেই। নীচে টেকঅ্যাওয়ে কাউন্টারে লাইন। রেস্তরাঁয় সব মিলিয়ে এক সঙ্গে বসে খেতে পারবেন প্রায় হাজার জন। শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত অভিজাত আবহের রেস্তরাঁয় মৃদু শব্দে বাজছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর।

সুস্বাদু: এ ভাবেই একসঙ্গে একাধিক প্লেট বিরিয়ানি টেবিলে টেবিলে পৌঁছয় সময় বাঁচানোর জন্য।

সুস্বাদু: এ ভাবেই একসঙ্গে একাধিক প্লেট বিরিয়ানি টেবিলে টেবিলে পৌঁছয় সময় বাঁচানোর জন্য। —ফাইল চিত্র।

স্টেশনের ধারে ছোট্ট কাউন্টার থেকে দাদা-বৌদির বিরিয়ানির ব্যবসার যে এই মোড়ক ও আবহে বদল, তা কিন্তু এই বিরিয়ানি সাম্রাজ্যের দখল নিতে চাওয়া শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের মোকাবিলা করতেই। কারণ শতবর্ষ ছুঁতে চলা আমিনিয়া যখন ব্যারাকপুরে বিরিয়ানি বিক্রি করতে আসে, তখন তারা জোর দেয় খাওয়াকে কেবল খাওয়ায় সীমাবদ্ধ না রেখে অভিজ্ঞতায় বদলে ফেলার উপরে। যে অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, ঐতিহ্যই তাদের তুরুপের তাস, বলছিলেন আমিনিয়ার এগজ়িকিউটিভ শেফ শরাফত আলি। আমিনিয়ার সব শাখার রসুই তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে তিনি।

২০১৪-য় ব্যারাকপুরে তাদের যাত্রা শুরু করে আমিনিয়া। দাদা-বৌদির জনপ্রিয়তাকে কোণঠাসা করতেই কি কলকাতা থেকে ব্যারাকপুরে এসে শাখা খুলতে হল আমিনিয়াকে? একেবারেই মানতে চান না শরাফত। উত্তর দিলেন, “দেখুন, আমরা ১০০ বছর ধরে বিরিয়ানি খাইয়ে মানুষকে আনন্দ দিচ্ছি। আমাদের কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতা নেই। লোকে আমাদের এখানে আসেন একটা অভিজ্ঞতার জন্য, কেবল খাওয়ার জন্য নয়। আর বিরিয়ানি শুধু কেন? মেনু দেখলেই বোঝা যায় বিরিয়ানি ছাড়াও আমাদের এখানে আসার মতো অনেক পদ রয়েছে।”

গুণমান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মাংস কেনা থেকে বিরিয়ানি প্লেটে আসা পর্যন্ত পুরো পদ্ধতিটাই কেবল তাঁদের নিজস্ব কর্মীদের দিয়েই, নিজেদের নজরদারিতে সব কাজ করানো হয় বলে জানালেন শরাফত। তাঁর দাবি, অন্য দোকান যেমনই ব্যবসা করুক তাতে তাঁদের কিছু যায় আসে না। তাঁদের কাছে এসে খাওয়ার অভিজ্ঞতার জন্যই মানুষ তাঁদের এখানে আসেন।

মুখে যতই প্রতিযোগিতার কথা অস্বীকার করুন না কেন, ব্যারাকপুরের দোকানকে যা গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে শরাফতের কথায় আঁচ পাওয়া গেল তাতে বোঝাই যায়, তারা জমি ছাড়তে একেবারেই নারাজ। গঙ্গার ও-পারে শ্রীরামপুরে শাখা খোলা, ব্যারাকপুরের আগে সোদপুরে শাখা খোলা সেই প্রতিযোগিতারই পরিচায়ক নয় কি? এ যেন শহর দিয়ে, গ্রাম থুড়ি শহরতলিকে ঘিরে ফেলা!

প্রতিযোগিতার কথা অবশ্য অস্বীকার করছেন না দাদা-বৌদির বিরিয়ানির মালিক সঞ্জীব। তিনি জানালেন, আগে তাঁদের দোকান রবিবার বন্ধ থাকত। আমিনিয়া আসার পর থেকে তাঁরা রবিবারের ছুটি বাতিল করেছেন। দাদা-বৌদি কিন্তু আমিনিয়ার মতো অভিজাত রেস্তরাঁয় খাওয়ার অভিজ্ঞতার আকর্ষণ দিয়ে তৈরি হয়নি। কিন্তু এখন বহুতল রেস্তরাঁ, ঝাঁ-চকচকে পরিবেশ বা আবহ রচনা করে সেই স্মৃতি তৈরি করার, অনন্য অভিজ্ঞতার আকর্ষণী লড়াইয়েও জমি ছাড়তে নারাজ দাদা-বৌদি। আমিনিয়া শহর থেকে এগিয়ে এসে শহরতলিতে শাখা খুলেছে। ব্যারাকপুরে বাজার দখলে এসেছে কলকাতার আর এক নামজাদা বিরিয়ানি-নির্মাতা আরসালানও। তেমনই, দাদা-বৌদিও পাল্টা শহরের দিকে এগিয়ে গিয়ে এয়ারপোর্টে বিরাট মাপের রেস্তরাঁ খুলতে চলেছে বলে জানালেন সঞ্জীব। বিরিয়ানি-সাম্রাজ্যের জমি অত সহজে কেউ কাউকে ছেড়ে দেবেন না।

বিরিয়ানিপ্রেমীদের মন পাওয়ার লড়াই বদলে দিয়েছে ব্যবসার ধরন। আবার, এই লড়াইয়ের জমি তৈরির একটা কারণ জনপদ হিসেবে ব্যারাকপুরের ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া। সেই বদলও এই বিরিয়ানি-ব্যবসার সুতোয় বাঁধা। স্থানীয় ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন, ব্যারাকপুর একটি প্রাচীন বর্ধিষ্ণু জনপদ হিসেবেই পরিচিত ছিল। পশ্চিম পার গঙ্গাবেষ্টিত। পূর্ব দিকে অপেক্ষাকৃত নতুন বসতি। পুবের সীমারেখা টেনেছে নাউই (লাবণ্যবতী) খাল। দক্ষিণ গড়িয়েছে কলকাতামুখে, আর উত্তর ছুঁয়েছে ইছাপুর-শ্যামনগরের মাটি।

কথিত আছে, পাঁচশো বছরেরও প্রাচীন এই জনপদ। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা কবি বিপ্রদাস পিপলাইয়ের রচনায় ‘চাণক’ নামের একটি গ্রামের উল্লেখ আছে। গবেষকদের অনেকের মতে, এই চাণক ব্যারাকপুরের আদি নাম। ১৬৩০ সালে ফান ডেন ব্রুক রচিত মানচিত্রে চাণক গ্রামের উল্লেখ আছে এবং এই চাণকের অবস্থান দেখানো হয়েছে বরাহনগর (বারেনগার) থেকে কাঁকিনাড়ার (কাঙ্গনেরী) মধ্যে।

ইতিহাস বলে, মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলে (১৬৫৮-১৭০৭) সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও ছিল এই অঞ্চলের একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র। এক সময় সপ্তগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন রুকনউদ্দিন বারবক শাহ। উত্তরে পলাশি থেকে দক্ষিণে সাগরদ্বীপের হাতিয়াগড়, পূর্বে কপোতাক্ষ এবং পশ্চিমে হুগলি নদী পর্যন্ত ছিল সপ্তগ্রাম সরকারের অন্তর্গত। গবেষকদের মতে, শাসনকর্তা রুকনউদ্দিন বারবক শাহ’র নামানুসারে সপ্তগ্রাম মহালের নাম হয় ‘বারবকপুর’। কালক্রমে চাণক নামকে গ্রাস করে প্রথমত ‘বারবকপুর’ পরে ‘বারাকপুর’ নামের জন্ম। অনেকের আবার ধারণা, ১৭৭২ সালে ইংরেজ সরকার এখানে ‘ব্যারাক’ নির্মাণ করলে এর নাম ব্যারাকপুর বলে প্রচার পায়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাপন, খাদ্য, শিল্প ও স্থাপত্যে সমকালীন শাসকদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে ব্যারাকপুর। ইংরেজ আমলে সিপাহিদের ব্যারাক, পরে হুগলি নদীর দুই তীরে বহু চটকল থাকায় শিল্পাঞ্চলের সদর শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ব্যারাকপুর। একে ঘিরে বসতি বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে শিয়ালদহ মেন লাইনে জংশন হওয়ার জন্য আশপাশের এলাকা ইছাপুর, শ্যামনগর, বারাসত, টিটাগড়, পলতা— যেখানেই যাওয়া আসা হোক, এখান থেকে যানবাহন ধরেন লোকজন। তাই এই চলমান জনতা ব্যারাকপুরের বিরিয়ানি-বিপণিগুলির প্রধান ভরসা শুরু থেকেই।

জনতা চলমান। তাই জনপ্রিয়তাও চলমান। যে-হেতু রেলপথের সংযোগস্থলে অবস্থান ব্যারাকপুরের, আর দাদা-বৌদির অবস্থানও স্টেশন লাগোয়া, তাই বিরিয়ানির সুখ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ে নিত্যযাত্রীদের মাধ্যমে। ধীরে ধীরে চটশিল্প ক্ষয়িষ্ণু হয়। বন্ধ হয়ে যায় চটকলগুলি। তবে তাতে ব্যারাকপুরের গুরুত্ব বৃদ্ধিতে ভাটা পড়েনি।

গত কয়েক বছরে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের (বি টি রোড) ধার বরাবর তৈরি হয়েছে একের পর এক বহুতল আবাসন। বরানগরের ডানলপ মোড় পর্যন্ত মেট্রো চলে এসেছে। তাই কলকাতার সঙ্গে যোগসূত্র খুব সহজ হয়ে যাওয়ায় ওই সব আবাসনে বসবাসও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। পুলিশ-প্রশাসনের নিরিখেও এখন ব্যারাকপুর কমিশনারেট এলাকা। প্রশাসনের হিসাব বলছে, গত দশ বছরে ব্যারাকপুরে দশ হাজারেরও বেশি মানুষের বসতি বেড়েছে। বিরিয়ানির চাহিদাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। আগে যেমন ট্রেনের নিত্যযাত্রীরা বিরিয়ানি কিনে নিয়ে যেতেন, এখন অ্যাপ-নির্ভর খাবার পৌঁছে দেওয়ার সংস্থা রেস্তরাঁগুলির ব্যবসার পরিধিও অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক এলাকার বিশাল বাজার ব্যারাকপুরের বিরিয়ানি সাম্রাজ্য হয়ে ওঠার একটা বড় কারণ।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যারাকপুর যেমন বদলেছে, তেমনই বদলেছে বিরিয়ানিকে খাবার হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও। সেই কবে মোগল আমলে শুরু। বিরিয়ানি নামটির উদ্ভব ফারসি শব্দ ‘বিরিয়ান’ থেকে। মাংস এবং ঘিয়ে ভাজা সুগন্ধি চালই এর প্রধান উপকরণ। মধ্য এশিয়া থেকে এসে বিরিয়ানির ভারত জয় মূলত মোগল সম্রাটদের দৌলতেই। সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মুমতাজমহল স্বয়ং নাকি মোগল সেনাদের জন্য ভাত, মাংস আর মশলা সহযোগে এক সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। আজকের বিরিয়ানি তারই পরিবর্তিত রূপ!

কেবল উৎসবে বা বিশেষ আয়োজনের তারকা পদ হিসেবে নয়, বিরিয়ানি এখন একই সঙ্গে ফাস্ট ফুড হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। সহজে খিদে মেটানো যায়, সর্বত্র পাওয়া যায় এবং অস্বাভাবিক গুরুপাকও কিছু নয়। সেই সঙ্গেই বলতে হবে পূর্ব ভারতের আমজনতার ভাতের প্রতি ভালবাসা। কাজেই ভেতো বাঙালি যে বিরিয়ানিতে আকৃষ্ট হবে, বলাই বাহুল্য!

নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ লখনউ থেকে কলকাতায় নির্বাসিত হওয়ার পর মাংসের সঙ্গে আলু দিয়ে বিরিয়ানি বানিয়েছিলেন, সেই নবাবি রেসিপি বিবর্তিত হতে হতে এখন একই সঙ্গে স্ট্রিট ফুডও হয়ে গিয়েছে। দেখা যায় মোড়ে মোড়ে হাঁড়ি নিয়ে বিরিয়ানি বিক্রেতাদের। বস্তুত, দাদা-বৌদির বিরিয়ানি, যা আজ অভিজাত রেস্তরাঁর মহার্ঘ পদ হয়ে গিয়েছে, তা শুরু হয়েছিল স্ট্রিট ফুড হিসেবেই। অর্থাৎ ব্যারাকপুরের বদল, সেই ব্যারাকপুরে সফল বিরিয়ানি বিক্রেতাদের বিক্রির কৌশলে বদল, এবং খাবার হিসেবে বিরিয়ানির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির বদল— ব্যারাকপুরের বিরিয়ানি-হাব হয়ে গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই সব ক’টি বদলই সম্পৃক্ত।

সেই সঙ্গেই বিরিয়ানি বদলে দিয়েছে জীবনও। যার প্রধান উদাহরণ ব্যারাকপুরের হালের আর এক বিখ্যাত বিরিয়ানির দোকান ডি বাপি বিরিয়ানি। দাদা-বৌদি, আমিনিয়া, আরসালান-এর মতো স্টেশনের অদূরে চমকদার লোকেশন নয়। এই দোকান বারাসত রোডে, স্টেশন, বাজার থেকে বেশ কিছুটা দূরে। তাও তার পরিচিতি এমনই, স্টেশন থেকে বেরিয়ে দোকানের নাম বললেই সেখানে যাওয়ার টোটোর খোঁজ পাওয়া যায় অনায়াসে। সেই ডি বাপি-র মালিক, বাপি দাস ও তাঁর স্ত্রী ডলি শোনালেন বিরিয়ানি কী ভাবে তাঁদের জীবন বদলে দিয়েছে সেই গল্প।

নব্বইয়ের দশকে ভোররাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বসিরহাট থেকে খাসি কিনে এনে বারাসত রোডের এক চিলতে দোকানে মাংস বিক্রি করতেন বাপি দাস। মাংস সরবরাহ করতেন শ্যামনগরের বড় ব্যাটারি নির্মাতা কারখানার ক্যান্টিনে। ২০০৫-এ হঠাৎই সেই ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যায়। কী ভাবে বাড়তি মাংস বিক্রি করবেন, সেই চিন্তাতে তখন ঘুম উড়ে গেছিল বাপির। স্ত্রী ডলির পরামর্শেই তখন বাড়তি মাংস দিয়ে বিরিয়ানি বিক্রির শুরু।

দু’জনেই জানালেন, এখনও তাঁদের মনে আছে সেই দিনটার কথা। ১৫ অগস্ট শুরু করেছিলেন রাস্তার ধারে দোকানের। তিন কেজি চালের বিরিয়ানি। মাটন ৫০ টাকা, চিকেন ৪৫ টাকা। এখন ১৮ বছর পেরিয়ে বাপি, বারাসত রোড-কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ক্রসিং থেকে কিছুটা দূরের ওই জায়গাতেই রাস্তার ধারে জমি কিনে দোকান করেছেন। আসে এসি ছিল না। তাও লাগিয়েছেন মাস দু’য়েক। ঘন ঘন ফোন বাজছে শেওড়াফুলি, শ্রীরামপুরের মতো নদীর ও পারের হুগলি জেলার নানা জায়গা থেকে ডেলিভারির জন্য। বাপি জানাচ্ছেন, অত দূরে তাঁরা ডেলিভারি দেন না।

আরও দূরে ডেলিভারি দিলে তো ব্যবসা আরও বাড়ত? বাপির জবাব, “আমি অত বড় ব্যবসায়ী নই। আমার দোকান বড় বাজারের মধ্যেও নয়। যাঁরা এখানে আসেন শুধু এই বিরিয়ানি খেতেই আসেন। যত জন আসেন, তাঁদের খুশি করাই আমার উদ্দেশ্য।” বাপির নাম, ও তার আগে তাঁর স্ত্রী ডলির নামের আদ্যক্ষর ডি— এই নিয়েই ডি বাপি। দুপুর মোটামুটি বারোটা-সাড়ে বারোটা থেকেই টেবিল ফাঁকা থাকছে না। সঙ্গে ডেলিভারি বয়েরা অপেক্ষারত। দোকানে দেখা মিলল কলকাতার টালিগঞ্জের দুই বাসিন্দার, যাঁরা কর্মসূত্রে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাতায়াতের সময় কেবল ডি বাপিতেই বিরিয়ানি খান।

ডলি বললেন, “আমাদের জীবনে এমন সময় গিয়েছে, যখন আমরা দাদা-বৌদির বিরিয়ানি কিনে খেতে চাইতাম। পারতাম না। সেই টাকা ছিল না। খিদের কষ্ট আমি জানি। তাই আমরা চাই যাঁরা খেতে আসেন, সবাই যেন তৃপ্তি করে খান।” দাদা-বৌদি, আমিনিয়া, আরসালান-এর মতো বড় বড় প্রতিযোগীর মধ্যে তাঁরা টিকে থাকছেন, ব্যবসা বাড়াচ্ছেন কী করে? ডলি, বাপি দু’জনেরই উত্তর, “আমাদের বিরিয়ানির মানই আমাদের ভরসা। এখানে যাঁরা খান, তাঁরা এখানেই আবার আসেন। সেই ভরসাতেই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।”

রেস্তরাঁতেও দেখা গেল, বিরিয়ানিতে মাংসের কেমন টুকরো দেওয়া হবে, তাও জিজ্ঞেস করে নিচ্ছেন কর্মীরা। আর নিজে মাংস-বিক্রেতা বাপি মাংসের মান নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। বললেন, “মাংস কেমন, সেটা বিরিয়ানির জনপ্রিয়তার একটা প্রধান কারণ। আমার এখানে মাংসের মান নিয়ে আমি কোনও আপস করি না। সে জন্যই হয়তো অনেকে আসেন।” ২০২২ সালের ১৭ মে এই দোকানেই বাপিকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। সে খবর সংবাদমাধ্যমে সম্প্রচারিত হওয়ার পরে পরিচিতিও বেড়েছে এই দোকানের।

বিরিয়ানির এই দাপট প্রভাব ফেলেছে ব্যারাকপুরের সামগ্রিক খাদ্য-ব্যবসাতেও। ব্যারাকপুর স্টেশন চত্বর চিরকালই কলকাতার ডেকার্স লেনের সঙ্গে তুলনীয়। অসংখ্য অস্থায়ী খাবারের দোকান আর প্রচুর চাইনিজ়, তন্দুরি বা বাঙালি পদের হোটেল। বলা যেতে পারে, খাবারের দোকানের বাজার। যে দোকানে এত বছর রমরমিয়ে রোল, চাউমিন, লিট্টি পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে, সেখানেই এখন লাল শালুতে মোড়া একটা প্রমাণ সাইজ়ের হাঁড়ি। গরম বিরিয়ানিতে চিকেন, মাটন, ডিম, আলু মিলেমিশে আছে। ব্যারাকপুর স্টেশন-লাগোয়া পুরনো রেস্তরাঁ সোনা-ও বিরিয়ানি বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছে পাল্লা দিয়ে।

এই স্টেশন চত্বরেই ব্যারাকপুরের অন্যতম পুরনো রেস্তরাঁ ভি কাফের মালিক গৌতম সেন বলেন, “বাঙালি ভাত ভালবাসে। তা সে দিনের যে কোনও সময়ই হোক। বিরিয়ানি হল কম্বো মিল। কম টাকায় ভাত, মাংস, ডিম, আলু সব পাওয়া গেলে তার চাহিদা তো বাড়বেই। তবে ব্যারাকপুরে বেশি চলে দম বিরিয়ানি। আমাদের এখানেই একমাত্র হান্ডি বিরিয়ানি পাওয়া যায়। এর ক্রেতা নির্দিষ্ট।
তাই নামি ব্র্যান্ড এসে আমাদের প্রতিযোগিতায় ফেলতে পারেনি।”

সাধারণত যে কোনও বিরিয়ানির দোকানেই একশো টাকার নীচে চিকেন বা মাটন বিরিয়ানি মেলা দুষ্কর। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কেউ কেউ আবার ৯৯ টাকায় পেট পুরে বিরিয়ানি খাওয়ার অফার দিচ্ছেন এই ব্যারাকপুরেই। ব্যারাকপুর-বারাসত রাস্তায় তেমনই এক দোকান চালান মা-ছেলে, সর্বাণী ঘোষ ও সৌরায়ন ঘোষ। তাঁরা বললেন, “বিরিয়ানি এমন একটা খাবার যে তাতে প্রয়োজনীয় সব মশলাই দিতে হয়। সেখানে
কার্পণ্য করলে চলে না। তবে দাম নির্ভর করে মাংসের ওজন ও সাইজ় এবং ভাতের কোয়ালিটিতে। ক্রেতা সব সময় ভালটা চান, সেটা অল্প হলেও।” দিনে গড়ে ছ’হাঁড়ি বিরিয়ানি তাঁদের বিক্রি হয় বলে জানালেন তাঁরা।

এক দিক থেকে দেখলে দাদা-বৌদি ও ডি বাপি একই দলে। তাঁরা ব্যারাকপুরের ‘ভূমিপুত্র’। আমিনিয়া, আরসালান সেই অর্থে ব্যারাকপুরের বাইরে থেকে এসে ব্যবসা শুরু করেছেন। আবার, অন্য দিক দিয়ে দেখতে দাদা-বৌদি, আমিনিয়া, আরসালান এক দলে। কারণ, তাদের বিরাট ব্যবসা, বিরাট রেস্তরাঁ দিয়ে ব্যবসা চলছে। ডি বাপি তুলনায় ছোট। এখনও। যদিও এক দিন এ ভাবেই শুরু হয়েছিল দাদা-বৌদির বিরিয়ানিরও। সেই উত্থানের ছবি ব্যারাকপুরের আশপাশের সকলের জানা। তাই রাস্তার, পাড়ার মোড়ে মোড়ে নানা নামে যে ছোটখাটো বিরিয়ানি বিক্রেতাদের দেখা যায়, তাঁদের চোখেও কি তেমনই আশা?

কোভিডকালে লকডাউনে কাজ হারানো অনেকের সহায়ও হয়েছে বিরিয়ানির ব্যবসা। ছোট আকারে আয়োজন করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে হাঁড়ি নিয়ে বিক্রি করতে দেখা যায় তেমন অনেক বিক্রেতাকে। ভিন রাজ্যে কাজ হারিয়ে তেমনই বিরিয়ানি ব্যবসা শুরু করেছেন আদতে মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা জসিম শেখ ও আনিসুর মোমিন। রান্না করেন নিজেরাই। ব্যারাকপুরে তাঁদের আসা পড়াশোনার সূত্রে। লকডাউনের পর রাজ্যে ফিরে তাই চেনা ব্যারাকপুরেই অন্য পেশায় নতুন দিশা খুঁজছেন তাঁরা। লাইন দেওয়ার ধৈর্য বা সময় যাঁদের নেই, কি‌ংবা যাঁরা একটু কম খরচে ইচ্ছুক, তাঁদের ভরসা দিচ্ছেন এই সব বিক্রেতারাই।

এমন ছোট বিক্রেতাদের আশা দিতে হালে সহায় হয়েছে সমাজমাধ্যমও। ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব কিংবা ফেসবুক খুললেই এখন দেখা যাবে নানা ফুড ব্লগারদের ছড়াছড়ি। তাই ভাল খাবারের সন্ধান পেলে তার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে অসুবিধে হয় না। কথাগুলো বলছিলেন এক ফুড ব্লগারই। সেই আনন্দ শর্মা থাকেন ওড়িশার বারিপদায়। বিরিয়ানি-রসিক আনন্দ ইউটিউবে নানা রকম খাবারের ভিডিয়ো তুলে আপলোড করেন। মাসে এক বার হলেও নিজের বাইকে সওয়ার হয়ে চলে আসেন ব্যারাকপুরে। বড় দোকান তো বটেই, ছোটখাটো দোকানেও বিরিয়ানি পরখ করার নেশা তাঁর তীব্র। আনন্দের উপলব্ধি, “ব্যারাকপুরের শতাধিক বিরিয়ানির দোকানের মধ্যে বড় দোকান ছাড়াও অনেকেই এই খাবারটাকে সহজপাচ্য বানানোর দিকে নজর দিয়েছেন। এটা বেশ মজার। বিরিয়ানি মানেই যে অ্যান্টাসিড খেতে হবে, তা মনে হয় না।” কেবল দেশের ব্লগার নন, বিদেশ থেকে হালে ভারত ঘুরতে আসা ইউটিউবার ক্রিস লিউয়িস-এর সাম্প্রতিক কলকাতার ভিডিয়োতেও শোনা গেল ব্যারাকপুরের বিরিয়ানির কথা।

মুখে মুখে ফেরা এমন কথায় ভর করেই তৈরি হয়েছে এই বিরিয়ানি-সাম্রাজ্য। সেই কারণেই গোড়ার কথাটা বলা— প্রমাণ চাইলে ব্যারাকপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে শুধু। অথবা স্টেশন চত্বরের বাইরে এসে ভিড়ের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করতে হবে। শব্দটা কানে আসবে হলফ করে বলা যায়। বিরিয়ানি!

অন্য বিষয়গুলি:

biriyani Food
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy