সুভাষচন্দ্র বসু। ফাইল চিত্র।
সুভাষচন্দ্র তখনও ‘নেতাজি’ হয়ে ওঠেননি, তবে বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম অগ্রণী যুবনেতা হিসেবে তিনি যথেষ্টই পরিচিত। সেই সময় এক বার পূর্ববঙ্গের কোনও এক গ্রামে কংগ্রেসের সভায় যোগ দিতে নদীপথে যাচ্ছিলেন সুভাষ, পদ্মার উপর দিয়ে। সঙ্গে ছিলেন সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর লেখাতেই পাওয়া যায়, আরোহীদের মধ্যে এক জন মাঝিকে সারিগান গাইতে বলায় সে সঙ্কোচ করছিল। সম্ভবত সুভাষচন্দ্রর ব্যক্তিত্ব বা চেহারা দেখেই তার সমীহ। সুভাষ তখন নিজেই উৎসাহ দিয়ে বলেন, “লজ্জা কী হে, গাও না? গান আমি খুব ভালবাসি।” সাহস পেয়ে মাঝি গান ধরে, “নদীর মর্ম জানতে হলে/ গহীন জলে নামতে হয়/ নিতলে তুই ডুববি যদি/ তুফানে তোর কিসের ভয়!”
তন্ময় হয়ে সেই গান শুনেছিলেন সুভাষ। আকাশে তত ক্ষণে ঘনিয়ে উঠেছে কালো মেঘ। সবাই চুপচাপ। একটু পরে আবার তিনি নীরবতা ভঙ্গ করে সঙ্গীদের প্রশ্ন করেন, “তোমরা কেউ শ্যামাসঙ্গীত জানো?”
সকলের হয়ে এক জন উত্তর দেয়, না।
একটু যেন অভিমানের সুরেই বলেন সুভাষ, “জানলেও তোমরা কেউ গাইবে না, সে আমি জানি। এমনি মেঘের আলোড়নের মধ্যে শ্যামাসঙ্গীত খুব ভাল লাগে আমার। তোমরা যখন কেউ গাইবে না, আমাকেই গাইতে হবে।”
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সুভাষ তত ক্ষণে গান ধরে ফেলেছেন, “কবে আবার নাচবি শ্যামা মুণ্ডমালা দুলিয়ে গলে/ ওই কালো মেঘের অন্ধকারে তোর হাতের খড়গ উঠুক জ্বলে।” তাঁর সঙ্গীরা হয়তো সে দিন অবাক হয়েছিলেন, তবে স্বামী বিবেকানন্দের ভাবশিষ্যের কাছে এ আচরণ খুব অপ্রত্যাশিত ছিল না।
প্রচলিত অর্থে সঙ্গীতজ্ঞ না হলেও সুভাষচন্দ্র ছিলেন নিবিষ্ট সঙ্গীতরসিক। নিজে অনেক সময়ই গান গেয়েছেন তিনি, সে রকম বেশ কয়েকটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর সহচর বা ঘনিষ্ঠ অনুরাগীরা। তখন সদ্য ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন সুভাষ। বিপ্লবী বন্ধু হেমন্তকুমার সরকার তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন কৃষ্ণনগরে। আরও কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে এসেছিলেন সুভাষ; সেখান থেকে নদীপথে তাঁরা পলাশি এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক জায়গা ঘুরে দেখেন। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছে, জ্যোৎস্নায় ভরা আকাশ। হেমন্তকুমার সুভাষকে অনুরোধ করলেন একটি গান গাইতে। সুভাষ গান ধরলেন, “দূরে হেরো চন্দ্রকিরণে উদ্ভাসিত গঙ্গা...”
কারাবাস-কালে তাঁর সঙ্গী ছিল সাহিত্য আর সঙ্গীত। ১৯২৫ সালের ৯ অক্টোবর, মান্দালয় জেল থেকে বন্ধু দিলীপকুমার রায়কে চিঠিতে লিখছেন তিনি, “গানে গানে দেশ ভরিয়ে দাও। জীবনের যে আনন্দ আমরা ভুলে পেছনে ফেলে এসেছি, তাকে আবার ফিরিয়ে আনো। যার লেখায় কোন সঙ্গীতের মূর্ছনা নেই, যার হৃদয় সঙ্গীতে জেগে ওঠে না, তার পক্ষে জীবনে বড় কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়।” আবার মেজবৌদি বিভাবতী দেবীকে চিঠি লিখছেন জেলজীবন সম্পর্কে— “গন্ধ ও গানের অভাব মাঝে মাঝে বড় বোধ করি, কিন্তু উপায় কি!” মান্দালয়ের জেলার সাহেবকে চিঠি লিখে দাবি জানাচ্ছেন, জেলের মধ্যে বন্দিদের গানবাজনা করার অনুমতি দিতে হবে। মানুষের আত্মা আছে, আর সে আত্মা শুধু ‘বেসিক নেসেসিটিজ়’ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারে না। সঙ্গীত সেই আত্মার চাহিদা।
‘তরুণের স্বপ্ন’ বইটিতে বেশ কয়েক বার তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান, কীর্তনাঙ্গের গান আর শ্যামাসঙ্গীত ছিল তাঁর প্রিয়। আর কাজী নজরুলের দেশাত্মবোধক গান যেন তাঁর হৃদয়ের সম্পদ। ১৯২৯ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে তিনি বিদ্রোহী কবিকে অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দিয়ে বলছেন, “আমি সারা ভারত ঘুরেছি কিন্তু ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মত গান আমি খুঁজে পাইনি।” বন্দিজীবনে ‘কারার ওই লৌহকপাট’ ছিল তাঁর সঙ্গী, এ কথাও লিখে জানিয়েছেন তিনি দিলীপকুমারকে। সুভাষচন্দ্র আর নজরুল— দু’জনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু এই প্রবাদপ্রতিম দিলীপকুমার, তাঁদের মধ্যে অন্যতম যোগসূত্রও হয়ে উঠেছিলেন তিনি। প্রায়ই সুভাষ বলতেন, “আমরা যখন স্বাধীনতার যুদ্ধে অগ্রসর হব, নজরুলের গান গেয়ে মার্চ করতে করতে এগিয়ে যাব।” তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে সে কালের পত্রপত্রিকায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়েছিল, কার্টুন পর্যন্ত ছাপা হয়েছিল!
সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ থেকে আরও জানা যায়, ১৯২৪ সালে গোপীনাথ সাহার ফাঁসির পর মর্মাহত সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লকের অফিসের দেওয়ালে টাঙানো ভারতের মানচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গাইছিলেন, “তোমার পতাকা যারে দাও...” সুভাষচন্দ্র হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে তাঁর দিকে চাইতেই সাবিত্রীপ্রসন্ন দেখেন যে তাঁর সারা মুখ লাল। অনেক ক্ষণ ধরে চেপে রাখা অব্যক্ত বেদনার ছাপ সেই মুখে। আর সেই বেদনাকে রূপ দিতে গানই হয়ে উঠেছিল তাঁর একান্ত অনুভূতির বাহন। সুভাষচন্দ্রের ভাগনি প্রতিমা মিত্র জানিয়েছেন, তিনি নিজের বাড়িতে উপাসনাকক্ষে, নিভৃতে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটি গাইতেন। অমূল্যচন্দ্র ভদ্র নামে আজাদ হিন্দ ফৌজের এক যোদ্ধার সাক্ষ্য বলছে, প্রচণ্ড সঙ্কটের সময়ে বোমাবর্ষণের মধ্যেও নেতাজি নির্ভয়ে গান গেয়ে চলেছিলেন, “প্রলয় নাচন নাচলে যখন, আপন ভুলে, হে নটরাজ।” কিশোর সুভাষচন্দ্র তাঁর ছোটবেলার বন্ধু চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কটকের কাঠজুড়ি নদীর ধারে গান গেয়ে বেড়াতেন, “আগে চল আগে চল ভাই/ পড়ে থাকা মিছে, মরে থাকা মিছে,/ বেঁচে মরে কিবা ফল ভাই”— অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছিলেন তাঁর ‘উদ্যত খড়্গ’ গ্রন্থে।
বন্ধু দিলীপকুমারের পিতা দ্বিজেন্দ্রলালের লেখা গানেরও বিশেষ অনুরাগী ছিলেন সুভাষ। কটকের কলেজিয়েট স্কুলে সুভাষ তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। শহিদ ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান স্মরণে ছাত্রাবাসে অরন্ধন দিবস পালন করা হয়। গাওয়া হয় ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটি, যা সেই সময়ে সভা-সমাবেশে গাওয়া নিষিদ্ধ ছ??? ? ?????? ????? ???? ???? ?????, ???? ??? ???িল। এ ছাড়াও ‘ভারত আমার ভারত আমার’, ‘ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে’, ‘ধনধান্য পুষ্প-ভরা আমাদের বসুন্ধরা’— এই গানগুলি তাঁর কাছে ছিল দেশপ্রেমের উৎসভূমি। দিলীপকুমার রায়কে প্রায়ই বলতেন, “দিলীপ, কী অপরূপ চরণ লিখেছিলেন তোমার পিতৃদেব, ‘আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি।’” এ সব গান শোনার পর যেন অন্য জগতে চলে যেতেন সুভাষচন্দ্র। ‘প্রতিমা দিয়ে কি পূজিব তোমারে’ গানটিও তিনি নিজে গুনগুন করে গাইতেন। শুধু দেশাত্মবোধক গান নয়, দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রীচৈতন্য-বিষয়ক ভক্তিগীতি ‘ও কে গান গেয়ে যায়’ শুনেও তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। কবি রজনীকান্তের ‘তব চরণ নিম্নে’ এবং ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানদু’টিও ছিল তাঁর প্রাণের খুব কাছাকাছি।
গান শুধু ভালই বাসতেন না, একটি নোটবুকে পছন্দের গানগুলি লিখেও রাখতেন তিনি। আর তাই বোধহয় আজাদ হিন্দ ফৌজের উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগাতে দেশাত্মবোধক ভাষণের পাশাপাশি গানেরও আশ্রয় নিয়েছিলেন নেতাজি। ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা’ আর ‘শুভ সুখ চয়ন কি’— গান দু’টির অবদান যে আইএনএ-র জাগরণে কতখানি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নেতাজি বা আজাদ হিন্দ ফৌজের ইতিহাস নিয়ে যে ক’টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে স্বাধীন ভারতে, তাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে এই অসামান্য গান দু’টি।
এই গান দু’টি তৈরির মূল অনুপ্রেরণা নেতাজি নিজেই। ১৯৪২ সালে ক্যাপ্টেন রাম সিংহ ঠাকুরি যোগ দেন আইএনএ-তে। তাঁর সঙ্গীতপ্রতিভা চিনতে ভুল হয়নি নেতাজির। তাঁর হাতেই তুলে দেন ফৌজের জন্য ‘মার্চিং সং’ আর স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকারের ‘জাতীয় সঙ্গীত’ তৈরি করার দায়িত্ব। ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা’ লিখেছিলেন বংশীধর শুক্ল। সুর দিলেন রাম সিংহ। দ্বিতীয় গানটির ক্ষেত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন’র কথা ভাবা হয়, কিন্তু নেতাজি অনুভব করেন, প্রবাসী ভারতীয় সেনাদলের সবাই যাতে এ গানের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারেন, সে জন্য মূল সংস্কৃত-ঘেঁষা বাংলা গানটির কিছু অংশ হিন্দিতে রূপান্তর করা দরকার। ক্যাপ্টেন রাম সিংহকে নেতাজি বলে দিয়েছিলেন, “এ গানের সুর এমন হবে, যে শুধু সেনাদলের নয়, যারা শুনবে— সেই লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণেও উদ্দীপনার স্রোত বয়ে যাবে।” ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’-র হিন্দি রূপান্তর করেছিলেন ক্যাপ্টেন আবিদ হাসান আর মুমতাজ হুসেন। রাম সিংহ সুরের সঙ্গে অর্কেস্ট্রা জুড়ে তাতে নতুন রূপ দেন। এটি গাওয়া হত ‘কোয়ামি তারানা’ হিসেবে। তাঁর সাঙ্গীতিক অবদানের জন্য আজাদ হিন্দ সরকার তাঁকে বিশেষ স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ভারতের প্রথম স্বাধীন সরকার যুদ্ধের ময়দানেও সঙ্গীতের গুরুত্ব অনুভব করেছিল, সৈনিক-শিল্পীর যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছিল, কারণ সেই সরকারের সর্বাধিনায়ক ছিলেন নেতাজি, যাঁর কাছে দেশাত্মবোধক গান ছিল দেশপ্রেমের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy