এ সেই ষাটের দশকের কলকাতার কথা। তার চলচ্চিত্র-জগতে এক দিকে যেমন ক্ষণজন্মা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভিড়, তেমনি টালিগঞ্জ আলো করে রয়েছেন কিংবদন্তি সব পরিচালক। এঁদের একটা চমৎকার অভ্যাস ছিল। খুব নাটক দেখতেন। কোথাও কোনও ছেলে বা মেয়ের অভিনয় ভাল লাগলেই তাকে ডেকে নিজেদের ফিল্মে সুযোগ দিতেন। এখনকার পরিচালকদের মধ্য থেকে এই স্বভাবটা একেবারে উবে গিয়েছে। এখন আর সে ভাবে মুক্তো খোঁজে না এরা। যাকগে। সেই সময়ে আমি নান্দীকার-এর হয়ে দুটো নাটকে অভিনয় করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছি। ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’ আর ‘মঞ্জরী আমার মঞ্জরী’। নির্মলকুমারের কথায় এই পরের নাটকটা দেখতে এসেছিলেন তপন সিংহ। একটু খুচরো ধরনের চেহারা ছিল আমার, তাই সেই নাটকে চাকর সাজতাম। নাটক দেখে, সিংহমশাই তাঁর সহকারী পলাশকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা ওই যে রোগা মতো ছেলেটা, তুমি ওকে চেনো? সুন্দর অভিনয় করল তো!’ পলাশ আমারই বন্ধু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো। সে দৌড়তে দৌড়তে এসে খবর দিল, আমাকে তপন সিংহ ডেকেছেন। আমি তো লাফিয়ে উঠলাম।
সত্যি বলতে কী, সত্যজিৎ রায় অন্য দুনিয়ার মানুষ। কিন্তু সিনেমা-জগতে তাঁর ঠিক পরেই যাঁদের স্থান, তাঁদের মধ্যে তপন সিংহ সামনের সারিতেই থাকবেন। মানিকদার আগে থাকতেই তিনি বিখ্যাত। সত্যজিৎ-জমানার পরেও সে খ্যাতি টোল খায়নি। এমন মানুষ আমাকে ডেকেছেন শুনে আনন্দ যে কোথায় রাখব তাই ভেবে কূল পাই না।
তার পর তো গেলাম। পরিচালক আমাকে বললেন, ‘খুব ছোট চরিত্র আছে একটা। করবেন?’ চিত্রনাট্য শোনালেন যত্ন করে। সিনেমার নাম ‘গল্প হলেও সত্যি’। একান্নবর্তী পরিবারের কাহিনি। বড়, মেজ, সেজ, ছোট ভাই, তাঁদের গিন্নি। মেলা চরিত্র। অভিনয়ে কেউকেটার দল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ছায়া দেবী, ভারতী দেবী। আমি এক জন চাকরের চরিত্রে। বাড়ির সব কর্তা-গিন্নিরা মিলে সেই চাকরের ইন্টারভিউ নেবেন। চরিত্রটা আমার বেশ মনে ধরল।
আমি অনেক চাকরকেই খুঁটিয়ে লক্ষ করেছি। আমার রিহার্সাল দেখেই ভারী খুশি হলেন তপনদা। বললেন, এ ভাবেই কোরো।
এ বার ক্যামেরার সামনে। চাকরের ইন্টারভিউ বোর্ডে তো নক্ষত্ররা সার সার দাঁড়িয়ে। নার্ভাস হয়ে যাওয়ার কারণ ছিল যথেষ্ট। কিন্তু তত দিনে আমি নাটক করেছি, ওয়ার্কশপও করেছি প্রচুর। তাই ঘাবড়াইনি। এই প্রশ্নোত্তরের পর্ব এমন সুন্দর ডায়লগ দিয়ে মোড়া যে আপনাআপনিই ভাল অভিনয় বেরিয়ে আসে। চাকরটা তো চ্যাংড়া। আমি তাই ডায়লগ ডেলিভারি করলাম চালু শ্যামবাজারি ঢঙে। একটু ‘স’ ‘স’ করে। আমাকে তো বলেই যাচ্ছে, ‘তোমাকে সায়া-সেমিজ কাচতে হবে, বড়কর্তার ধুতিও। বাটনা বাটতে হবে, বাসন মাজতে হবে।’ আর আমি বলছি, ‘লব্বই টাকায় এতগুলো কাজ! ও দিকে আমায় দুসো টাকার চাকরি নিয়ে সাধাসাধি করছে।’ একান্নবর্তী পরিবার। বউরা সব নিজের কাজ অন্যের ঘাড়ে ফেলতে ব্যস্ত। তাদের লিস্টি শুনে আমি একটু ব্যঙ্গ মিশিয়ে তেরছা ভাবে বলছি, ‘আপনাদের বাড়িতে কি কেউ কাজকম্ম করে না?’
দৃশ্য শেষ হতেই প্রত্যেকে এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে গেলেন। আমি ছায়া দেবীর বিশাল ভক্ত ছিলাম। তিনি এসে আমাকে বললেন, বাবা, আপনি অভিনয়টা ছাড়বেন না। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যেই না শুনলেন আমিও ও-পার বাংলার, হইচই বাঁধিয়ে দিলেন। বাঙাল বলে তাঁর ভারী গর্ব ছিল বরাবর। আমাকে বললেন, ‘ঢাকার পোলা ট্যালেন্টেড হইবই। নাম করবই। চলে আয় বাসায়।’ ফ্লোরে প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিম ঘোষ, ভারতী দেবীর সঙ্গেও আলাপ হল। আর ছিলেন রবি ঘোষ। তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, ‘চলে আসিস। তোর সঙ্গে কথা আছে।’
উৎপল দত্তর একটা নাটকে রবিদা দুরন্ত অভিনয় করেছিলেন। তখন আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের খুব চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। ফ্লোরে রবিদার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম নাটকের অফার আছে। কিন্তু তখন আমি সেটা করতে পারিনি। পরে অবশ্য কলকাতা জুড়ে প্রচুর বাণিজ্যিক নাটক করেছি, যাত্রাও করেছি এক বছর। রবিদার পরিচালনায় ‘বিবর’ নাটকেও অভিনয় করেছি। খুব জনপ্রিয় ছিল সেই নাটক। তত দিনে আমিও ‘চিন্ময় রায়’ হয়ে গিয়েছি। মঞ্চে এলেই দর্শকদের মধ্যে শোরগোল পড়ে যেত।
প্রথম রিলিজের সময় ‘গল্প হলেও সত্যি’ এতটা হিট করেনি। তবে আবার রিলিজ হতেই একেবারে ইতিহাসে ঢুকে গেল সিনেমাটা। রবিদা খুব নাম করলেন। আমিও টুকরো নাম করলাম। ওই সূত্রে তপনদার পরের ছবিতেও অভিনয়ের সুযোগ এল। ‘হাটে-বাজারে’। তার পর ‘আপনজন’, ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘এখনই’। দর্শকের মন জয় করে ফেললাম। নাটক ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে সিনেমায় মন দিলাম। হাতে টাকাও আসতে লাগল। প্রথমে নিজের খরচাটুকু, তার পর সংসারও চালাতে পারলাম ভাল ভাবে।
তখন আমি থাকতাম সিঁথিতে। সকাল দশটায় কলটাইম থাকলে, দু’ঘণ্টা আগে, সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বেরোতাম। শ্যামবাজার থেকে রাসবিহারী আসতাম ডবল ডেকার বাসে। তার পর সেখান থেকে ট্যাক্সি করে পৌঁছতাম এনটি ওয়ান স্টুডিয়োয়। তপনদা বেশির ভাগ শুট ওখানেই করতেন। ‘গল্প হলেও সত্যি’তে আমার তেমন একটা মেক-আপ লাগত না। একটা হাফ-প্যান্ট পরে অভিনয়ে নেমে পড়তাম।
এই বাস-ট্যাক্সি চড়া নিয়ে একটা সত্যি গল্প আছে। ‘হাটে-বাজারে’ মুক্তি পাওয়ার পর দেখলাম লোকে আমাকে চিনতে পারছে। এক বার শ্যামবাজার থেকে নয় নম্বরের ডবল ডেকার বাসে চড়ে যাচ্ছি, কয়েক জন আমারই মতো রোগা লোক সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। দেখে খুব একটা শিক্ষিত মনে হল না। সটান আমাকে জিগ্যেস করল, আপনি কি হাটে-বাজারে’তে পার্ট করেছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ ভাই, করেছি। ওরা বলল, আপনার চেহারা তো ভাল নয়, তবে সিনেমায় রোল পেলেন কী করে? আপনি কি তপন সিংহের বাড়ির বাজার করে দেন? সে দিন আমি পণ করেছিলাম, আর জীবনে কোনও দিন ট্যাক্সি ছাড়া বাসে চড়ব না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy