Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

সেই তিনটে গুলি শুধু মুম্বই নয়, গোটা ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল

কেন কিছু খুনের ঘটনা মরে না? নানাবতীকে নিয়ে বাচি করকরিয়া-র নয়া বই বেস্টসেলার। কানসাসের দু’জোড়া খুন অমর করেছে ট্রুম্যান কাপোটিকে।কেন কিছু খুনের ঘটনা মরে না? নানাবতীকে নিয়ে বাচি করকরিয়া-র নয়া বই বেস্টসেলার। কানসাসের দু’জোড়া খুন অমর করেছে ট্রুম্যান কাপোটিকে।

স্ত্রী সিলভিয়ার সঙ্গে কাওয়াস নানাবতী।

স্ত্রী সিলভিয়ার সঙ্গে কাওয়াস নানাবতী।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৭ ০০:৩৬
Share: Save:

দু’মাস পরে ঘরে ফিরেছেন ভদ্রলোক। সকালে স্বামী-স্ত্রী পোষা কুকুরকে ডাক্তার দেখিয়ে, ছেলেমেয়েদের জন্য সিনেমার টিকিট কেটে ফিরেছেন কোলাবার ফ্ল্যাটে। এখনও লাঞ্চের দেরি আছে। এমন ছোট ছোট অবসরই পুরনো দাম্পত্যকে রিনিউ করার সময়। স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখলেন সাঁইত্রিশ বছরের পুরুষটি। ছ’ফুট লম্বা, ছিপছিপে, সুপুরুষ। নেভি কম্যান্ডারের ধবধবে সাদা ইউনিফর্ম পরলে তো কথাই নেই। পার্টিতে, ক্লাবে, সরকারি অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি দাঁড়ালেই মেয়েদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য পড়ে যায়।

আরও পড়ুন: ‘আমার যা সম্পদ তা হারাতে চাই না’

অথচ দশ বছরের সুখী দাম্পত্য পেরিয়ে আসা আঠাশ বছরের সুন্দরী স্ত্রী কেমন শীতল। ক’দিন ধরেই এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। এখন স্বামী কাছে টানতে চাইলে হাত সরিয়ে দিলেন। ‘‘গায়ে হাত দিয়ো না।’’

তুমি কি আমাকে ভালবাসো না আর, সিলভি? তবে কি আর কেউ...?

২৫ এপ্রিল, ১৯৫৯। সোমবার সকালটা আর পাঁচটা সকালের থেকে খুব আলাদা বলে মনে হয়নি কারও। স্বামী-স্ত্রী’র কথাবার্তার মধ্যেই বেয়ারা টোকা দিয়ে জানিয়ে গেল, লাঞ্চ সার্ভ করা হয়েছে। গ্রেভি কাটলেট, প্রন রাইস দিয়ে দুপুরের খাওয়ার পর বউ-ছেলেমেয়েদের মেট্রো সিনেমায় পৌঁছে দিলেন স্বামী। ইন্টারভালে আইসক্রিম কিনে দিতে বললেন। যেন সবই ঠিকঠাক, তেমন কিছুই ঘটেনি।

তার পর? তার একটু পরেই চলেছিল তিনটি গুলি, কাওয়াস নানাবতীর রিভলভার থেকে। সেতলভাদ লেনের ‘জীবনজ্যোত’ বিল্ডিং-এর ফ্ল্যাটে নিজের বেডরুমের অ্যাটাচড বাথরুমে লুটিয়ে পড়েছিল সিলভিয়ার প্রেমিক প্রেম আহুজা। গুলির শব্দ শুনে প্রেমের বোন ম্যামি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে, ভয়ার্ত চাকরের দিকে রিভলভার তাক করে রেখে বেরিয়ে যাচ্ছেন নানাবতী। নীচে দারোয়ান আটকাতে গেলে বললেন, ‘‘আমিই যাচ্ছি পুলিশের কাছে।’’ তা-ই গেলেন। সিআইডি-র ক্রাইম ব্রাঞ্চে ডেপুটি কমিশনার জন লোবো-র ঘরে ঢুকলেন। ‘‘আই অ্যাম কম্যান্ডার নানাবতী। আই হ্যাভ শট আ ম্যান।’’

সেই তিনটে গুলি শুধু মুম্বই শহর নয়, গোটা ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে যা একটা ওপেন-অ্যান্ড-শাট মার্ডার কেস, তা নিয়ে পাঁচ বছর গোটা দেশে শ্বাসরুদ্ধ উত্তেজনা। কেস সুপ্রিম কোর্টে উঠল, প্রশ্ন উঠে গেল দিল্লির সংসদে, জবাব দিতে হল স্বয়ং জওহরলাল নেহরুকে। ভারত থেকে চিরকালের জন্য উঠে গেল জুরি দিয়ে বিচার করার প্রথা। ট্যাবলয়েড কাগজ বেস্টসেলার হয়ে উঠল। পর পর ফিল্ম তৈরি হল নানাবতী-সিলভিয়া-আহুজার ত্রিকোণ প্রেম নিয়ে। ১৯৬২ সালের ‘ইয়ে রাস্তে হ্যায় পেয়ার কে’ থেকে শুরু করে গত বছরের ‘রুস্তম’। নেভি কম্যান্ডারের ভূমিকায় সুনীল দত্ত থেকে অক্ষয় কুমার। ষাট বছর পেরিয়েও নানাবতী বেস্ট সেলার, ফের প্রমাণ করল বাচি করকরিয়া-র বই, ‘ইন হট ব্লাড।’

ইন হট ব্লাড? এক মিনিট, নামটা চেনা চেনা লাগছে না? চেনা বইকী। সেই বিখ্যাত বই, ‘ইন কোল্ড ব্লাড,’ লিখেছিলেন নামজাদা লেখক-সাংবাদিক ট্রুম্যান কাপোটি। ১৯৬৬ সালে। তত দিনে কাপোটি বিখ্যাত, তাঁর নভেল ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিজ’ বেরিয়ে গিয়েছে। তা নিয়ে ছবি করেছে হলিউড, লম্বা সিগারেট-হোল্ডার হাতে স্টাইলিশ নায়িকা অড্রে হেপবার্ন সাড়া ফেলে দিয়েছেন। কানসাসে একটা গোটা পরিবারকে হত্যার কাহিনি নিয়ে লেখা ‘ইন কোল্ড ব্লাড’ বইটাও ব্লকবাস্টার হল। এমনকী বই লেখার পর্বটিও এমন আগ্রহ তৈরি করেছিল, যে দুই খুনি আর এক সাংবাদিককে নিয়ে তৈরি হল ছবি, ‘কাপোটি’ (২০০৫)। কাপোটির মৃত্যুর একুশ বছর পরে।

বাচি-ও কি ‘ইন কোল্ড ব্লাড’ বইয়ের কথা মনে রেখে নাম দিয়েছেন নিজের বইয়ের? ‘‘মনে তো এসেইছিল কাপোটির কথা,’’ বললেন বাচি। ‘‘তবে নানাবতী কেসটাই এমন, যে তা নিয়ে না লিখে পারিনি।’’

দু’টি খুন ঘটে একই বছরে। মুম্বইতে কাওয়াস নানাবতী তখনও জেলবন্দি। কেসের ডেট পড়লে বুকে ঝকঝকে মেডেল ঝুলিয়ে পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরে নানাবতী হাজিরা দেন। মেয়েরা চেঁচায়, ‘‘কাওয়াস! কাওয়াস!’’ ছুড়ে দেয় প্রেমপত্র, লিপস্টিক-ছাপসুদ্ধ টাকার নোট। ঠাসা ভিড় থেকে স্লোগান ওঠে, নানাবতী জিন্দাবাদ। যেন খুনের আসামি নয়, ফিল্মের হিরো। তাঁর উকিলরা দাবি করেছেন, খুন করেননি তিনি, ধস্তাধস্তিতে গুলি চলে গিয়েছে।

সেই বছর নভেম্বরের মাঝামাঝি আমেরিকার কানসাসের এক ছোট্ট গ্রামে এক পরিবারের চার জন খুন হয়ে গেল এক রাতে। অতি-ভদ্র, নির্বিবাদী, পরোপকারী পরিবারটি এলাকায় সবার প্রিয় ছিল। প্রায় কিছুই খোয়া যায়নি, ‘মিসিং’ বলতে কিছু খুচরো ডলার আর একটা পুরনো ছোট রেডিয়ো। সতেরো বছরের কন্যা ন্যান্সির জামাকাপড়, পায়ের মোজাটি অবধি একটুও অবিন্যস্ত হয়নি। তার গলা অবধি লেপ তুলে দেওয়া। তার ছোট ভাইয়ের মাথার নীচে দু’টি বালিশ। গৃহকর্তা আটচল্লিশ বছরের হার্বার্ট ক্লাটারের দেহ মেলে বেসমেন্টে। কিন্তু ঠান্ডা মেঝেতে না শুইয়ে একটা বড় কার্ডবোর্ডের বাক্স টেনে এনে শোয়ানো হয়েছে তাঁকে। তার পর কাটা হয়েছে গলা। গুলি করা হয়েছে মাথায়।

একই সঙ্গে এমন নরম যত্ন আর শীতল নৃশংসতা দেখে লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল পুলিশ ডিটেকটিভ অ্যালভিন ডিউই-এর। ক্লু বলতে দু’টো আলাদা জুতোর ছাপ, তাও আধখানা করে। তাই সম্বল করে তদন্তে তোলপাড় করলেন দেশ। মাত্র মাসখানেকের মাথায় ধরা পড়ে গেল দুই খুনি। মেক্সিকোয় পালিয়ে গিয়েও সব টাকাপয়সা খুইয়ে, ভুয়ো চেক কেটে টাকা তোলার ধান্দায় দেশে ফিরে এসেছিল পেরি স্মিথ আর ডিক হিকক। এমনই কপাল, দু’জনের জুতোসুদ্ধ মালপত্তর, যা তারা পোস্ট করেছিল মেক্সিকো থেকে, সেগুলো নিয়ে ডাকঘর থেকে বেরনোর ঠিক মুখেই পুলিশ ধরল তাদের। যত দিনে ফাঁসি হল তাদের, তত দিনে বেকসুর খালাস হয়ে গিয়েছেন নানাবতী।

কাপোটির কলম সার্জেনের নিস্পৃহ ছুরি। বাচির গদ্য নিমের মধু, তেতো সত্যের সঙ্গে মধুর রসিকতার ব্লেন্ড। তাঁদের লেখার জাদুতে মরা লোক জ্যান্ত হয়। তবু একটা প্রশ্ন খুঁতখুঁত করে। এত তো খুন হয় রোজ, কত ভয়ানক, ভয়ংকর খুন। কেন কয়েকটা খুনের ঘটনা পাগল করে দেয় লোককে? কেন দিনের পর দিন ভিড় উপচে পড়ে আদালতে, কাগজের কাটতি বেড়ে যায়, তর্কে মাথা-ফাটাফাটি হয়? এই দু’টো বই ইঙ্গিত দেয়, বীভৎসতা নয়, মনে ঘা দেয় নিজের বিপন্নতা। ক্লাটার পরিবার ছিল ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর দৃষ্টান্ত— সামান্য অবস্থা থেকে অক্লান্ত পরিশ্রমে মস্ত ফার্ম তৈরি করেছিলেন হার্ব ক্লাটার। সপরিবারে তাঁর হত্যা যেন আমেরিকার সব মধ্যবিত্ত চাষিকে চ্যালেঞ্জ, ‘সারা জীবনের অ্যাচিভমেন্ট এক রাতে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারি।’ গোটা দেশ উদ্বেল হল। যেমন নৌসেনার অফিসারদের ক্ষিপ্ত করেছিল নানাবতী কেস। ‘আমি দেশ বাঁচাতে পড়ে থাকব সমুদ্রে, আর একটা প্লেবয় আমার বউকে ফুসলে নিয়ে যাবে? তাকে ছেড়ে দিতে হবে?’ নৌসেনা দাঁড়ায় নানাবতীর পাশে, সাক্ষ্য দিতে আসেন স্বয়ং নেভি কম্যান্ডার। ‘আমার সঙ্গেও এমন হতে পারে,’ এই আবেগ থেকে লোকে গলা ফাটায় কোনও এক পক্ষে। ফাঁসি দিতেই হবে। নইলে, ছেড়ে দিতেই হবে।

খুনের গল্পকে বলা হয় ‘হু-ডান-ইট’। আসল গল্প কিন্তু ‘হোয়াই ডান ইট’। কেন খুন? মোটা চোখে যা কারণ, সন্ধানী সাংবাদিকের তাতে মন ভরে না। গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও ...। দীর্ঘ চার বছর কাপোটি নিয়মিত দেখা করেছেন পেরি স্মিথ আর ডিক হিকক-এর সঙ্গে। খুঁটিয়ে জেনেছেন দুই তরুণের কথা। জেলবন্দি অবস্থায় আর এক বন্দির কাছ থেকে ক্লাটার পরিবারের সম্পন্ন খামারের কথা শুনে ডিক হিকক ডাকাতির পরিকল্পনা আঁটে, টাকার লোভ দেখিয়ে সঙ্গী করে পেরি স্মিথকে। শেষ অবধি বাড়িতে খুচরো কিছু ডলার পেয়েছিল দু’জনে। স্রেফ সাক্ষী ঘোচাতে মারতে হল গোটা পরিবারকে। চার জনকেই মারল পেরি।

কাপোটি বলছেন, এক ধরনের মনের অসুখ আছে, যেখানে খুনি যেন ঘোরের মধ্যে থাকে। হঠাৎ ‘আবিষ্কার’ করে, সে কোপাচ্ছে, বা গলা টিপছে। যাকে মারছে, তাকে হয়তো চেনেই না। পেরি-ও বলেছে, হার্ব ক্লাটারকে তার বেশ ভদ্রলোক, মিষ্টভাষী বলেই মনে হয়েছিল, একেবারে গলা কেটে দেওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত। কিশোরী ন্যান্সিকে ধর্ষণের ধান্দা করেছিল ডিক, বাধা দেয় পেরি। গুলি করার আগে গলা অবধি লেপ তুলে দেওয়া, মাথার তলায় বালিশ রাখা, এ সব পেরিরই মনের ছাপ। অতি শালীন, পোশাক-প্রসাধনে অতি পরিচ্ছন্ন, নোটবুকে যত্ন করে নতুন শব্দ টুকে-রাখা যুবক। পেরি স্মিথ সেই লোক, যাকে গাড়ির গ্যারাজে, পথের ধারের ধাবায়, ট্রেন-বাসে পাশের সিটে হামেশাই দেখা যায়। কথায় কথায় কেঁদে ফেলতে দেখে মায়াও হতে পারে। পরিশীলিত, বিনয়ী ব্যবহারের পিছনে নির্যাতিত, অসুস্থ শৈশব লুকিয়ে আছে, বোঝার উপায় থাকে না।

কাপোটি ঢুকেছেন মনস্তত্ত্বে। বাচি করকরিয়া ঢুকেছেন সমাজতত্ত্বে। নানাবতী ছিলেন পার্সি। বম্বে শহরের অর্ধেকটা তখন পার্সিদের। যেমন টাকা, তেমনই দানধ্যান। জামসেদজি জিজিবয়ের অনুদানে তৈরি জেজে হাসপাতাল। মাহিম থেকে বম্বে শহর জুড়বার রাস্তা তৈরি তাঁর স্ত্রীর টাকায়। পেটিট লাইব্রেরি, পার্সি জেনারাল হাসপাতাল, মধ্যবিত্তের নানা আবাসন, সর্বোপরি তাজ হোটেল, সব পার্সিদের। আইনজীবীদের মাথায় ননি পালকিওয়ালা, সোলি সোরাবজি, ফলি নরিম্যান। বম্বে সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা কনডাক্ট করছেন মেহলি মেহতা, তাঁরই সন্তান জুবিন মেহতা পরে বিশ্ববিখ্যাত হবেন। ব্যবসা থেকে থিয়েটার, রেসের মাঠ, পার্সিরা বম্বের প্রাণশক্তি। বিখ্যাত ল ফার্ম ‘মাল্লা অ্যান্ড মাল্লা’-র ক্লায়েন্ট ইন্ডিয়ান নেভি। ধনজিশ’ নানাবতী তার সিনিয়র পার্টনার। তাঁর ভাইপো নেভি কম্যান্ডার কাওয়াস নানাবতী। যার ‘আইএনএস মাইসোর’ যুদ্ধজাহাজে দিন কাটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, কন্যা ইন্দিরা। সেই কাওয়াস নানাবতীর সুন্দরী ইংরেজ স্ত্রীকে প্রলুব্ধ করে পার পেয়ে যাবে একটা সিন্ধি গাড়ির ডিলার? দোকানদারি, তেজারতি আর প্রোমোটারি করা যে সিন্ধিরা মাত্র ক’দিন আগেই পাকিস্তান থেকে এসেছে এ দেশে?

বাচি দেখিয়েছেন, প্রেম আহুজাকে খুনের দায়ে নানাবতীর বিরুদ্ধে মামলা কার্যত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল পার্সি বনাম সিন্ধি মামলায়। গোটা পার্সি সমাজ ছিল নানাবতীর পিছনে। পার্সি রুসি কারাঞ্জিয়ার ট্যাবলয়েড ‘ব্লিৎজ’ যে ভাবে দিনের পর দিন মামলার রিপোর্ট করেছে তা এক নিরস্ত্র, নিহত যুবককে ‘ভিলেন’, অন্যের প্রতি অনুরক্ত মহিলাকে ‘ভিক্টিম,’ আর খুনিকে হিরো বানানোর চিত্রনাট্য। পরে ফিল্মগুলো তাতে দাগ বুলিয়েছে শুধু।

অন্য দিকে, বম্বে হাই কোর্টে নানাবতীকে খুনের দায়ে যিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন, সেই বিচারপতি চৈনানি ছিলেন সিন্ধি।

আর যে যুক্তিটা ধসিয়ে দিয়েছিল নানাবতীর উকিলদের ‘ধস্তাধস্তি’ থিয়োরিকে, তা জুগিয়েছিলেন এক সিন্ধি আইনজীবী। তাঁর নাম রাম জেঠমালানি। আহুজা পরিবারের স্বার্থরক্ষায় নিযুক্ত ছত্রিশ বছরের জেঠমালানিই প্রশ্ন তোলেন, ধস্তাধস্তি হয়ে থাকলে আহুজার কোমরের তোয়ালেটা যেমন-কে-তেমন রয়ে গেল কী করে?

কাগজে সেই রিপোর্ট বেরোতেই ফ্লোরা ফাউন্টেনে হকাররা গলা ফাটাতে লাগল। ‘আহুজা তৌলিয়া, মরেঙ্গা তো ভি নহি গিরেঙ্গা। নানাবতী কা পিস্তল, ব্যাং ব্যাং ব্যাং।’ তোয়ালে, খেলনা পিস্তল বিক্রির এমন মওকা ছাড়বে না ‘বম্বে’।

উকিলরা যতই গল্প ফেঁদে বসুক, আদালত কিন্তু ছিল অনড়। আঠারো মাস প্রেম চলেছে সিলভিয়া-আহুজার, বিয়েতে আগ্রহী ছিল সিলভিয়া, রাজি ছিল না আহুজা। তবু সরে আসতে পারেনি সিলভিয়া। যে প্রেমের পরিণতি অনিশ্চিত, স্বামীকে তার কথা না জানিয়ে পারেনি। আদালতে নানাবতী বলেন, তিনি জানতে গিয়েছিলেন আহুজা তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নিতে রাজি আছে কি না। আদালত মানতে পারেনি। গুলি-ভরা রিভলভার নিয়ে কেউ অন্যের দায়িত্ববোধের জরিপ করতে যায় না। নিজের বাবা-ভাই থাকতে আহুজাকে সন্তানের দায়িত্ব দিতে এত আগ্রহই বা কেন? ফৌজদারি আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট, সর্বত্র কাওয়াস নানাবতী খুনি সাব্যস্ত হন।

কিন্তু ছা়ড়া পেয়ে গেলেন নানাবতী। গভর্নর বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত ক্ষমার আবেদনে সই করলেন। একই সঙ্গে ছাড়া পেলেন সিন্ধি ব্যবসায়ী ভাই প্রতাপ। সর্বজনসম্মানিত এই ধনী ভদ্রলোক মিথ্যা সাক্ষ্যে ফেঁসে গিয়েছিলেন একটা প্রতারণার মামলায়। পার্সি নানাবতীর সাজা মাফ করলে সিন্ধি সমাজ ফুঁসে উঠবে, তাই একই সঙ্গে মাফ করা হল ভাই প্রতাপকে। কী ভাবে আহুজার বোনকে ম্যানেজ করে সেই ‘ডিল’ হয়েছিল, তার বিবরণ বাচিকে দিয়েছেন স্বয়ং জেঠমালানি।

কিন্তু ভারতে ‘সেলিব্রিটি’-র বিচারের প্রোটোটাইপ তৈরি হয়ে গেল। যাবজ্জীবন সাজায় দণ্ডিত নানাবতী মাত্র বছর দেড়েক কাটিয়েছেন সাধারণ কয়েদির জীবন, তারও অনেকটা জেজে হাসপাতালে। সেখানে তাঁর জন্য আলাদা ফ্যানের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর (পার্সি) ডাক্তার। তার পর ‘বন্দি’ ছিলেন লোনাভালার ‘সানডাউন’ বাংলোতে। সেখানে দেখা করে গিয়েছেন হলিউডের হিরোইন ভিভিয়েন লে। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলিয়াছে। জেসিকা হত্যার মনু শর্মা, বিএমডব্লিউ হিট অ্যান্ড রান কেসে সঞ্জীব নন্দা, কৃষ্ণসার হরিণ মামলায় সলমন খান...।

পেরি স্মিথ আর ডিক হিককের ফাঁসি রদের আবেদনও পাঠানো হয়েছিল কানসাসের গভর্নরের কাছে। গভর্নর উইলিয়াম আভেরি নিজে ছিলেন বড় চাষি, নিহত হার্ব ক্লাটারের মতোই সম্পন্ন, প্রভাবশালী। কানসাসের ভোটদাতাদের বড় অংশই চাষি। ‘কানসাসের স্বার্থে’ ফাঁসির রায় বজায় রেখেছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল ফাঁসির সময় উপস্থিত ছিলেন ট্রুম্যান কাপোটি। ছত্রিশ বছরের পেরি আর তেত্রিশ বছরের ডিকের অনুরোধে। নিন্দুকে বলে, ডিক আর পেরি ভাবছিল, কাপোটি তাদের মুক্তির চেষ্টা করছেন। কিন্তু কাপোটি চাইছিলেন ফাঁসি হোক। নইলে বই কাটবে না। ফাঁসি হল, বই ব্যবসা করল ষাট লক্ষ ডলার। কুড়ি লক্ষ ডলারে তার ফিল্ম রাইট বিক্রি করেছিলেন কাপোটি। কিন্তু জীবনে আর বই লিখতে পারেননি।

আর নানাবতী? জীবনের স্ক্রিপ্ট নতুন করে লিখলেন নিজেই। সপরিবারে চলে গেলেন কানাডার ওন্টারিওতে। নয়া অবতারে বিমার সেলসম্যান। সিলভিয়া চাকরি নিলেন ব্যাঙ্কে। আশি বছর পার করে (২০০৩) মারা গিয়েছেন কাওয়াস নানাবতী। সিলভিয়া দিন কাটাচ্ছেন নাতিপুতি নিয়ে।

কখনও কথা হয়েছে সিলভিয়ার সঙ্গে? ‘‘ফোন নম্বর পেয়েছিলাম,’’ বললেন বাচি। ‘‘ডায়াল করেছি, রিং-ও হচ্ছে। রেখে দিলাম ফোনটা। ভেবে পেলাম না, কী বলব।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE