ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
পুব দিকের যে লোহার গেটটা সব সময় বন্ধ থাকে, তার গায়ে স্টাফদের আসা-যাওয়ার জন্য একটা ছোট দরজা কাটা আছে। মোল্লার চকের দিকে যাওয়ার দরকার না হলে ওই গেটটা কেউ ব্যবহার করে না। গেটের চাবি ঝোলানো থাকে অফিসঘরে, অন্য চাবির গোছার সঙ্গেই। সে নিজে সে দিন ওখান দিয়ে আসলামভাইদের ঢুকিয়েছিল। কিন্তু আসলামভাই যে সঙ্গে আরও দুজন লোক নিয়ে আসবে, এটা বোঝেনি সুকুমার। আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। নিজের উপরেই বিরক্ত হল সে।
শঙ্করটা যদি দেখে ফেলে থাকে কিছু, তা হলে একটু সতর্ক থাকতে হবে। একটাই বাঁচোয়া, ওর কথা খুব একটা কেউ বিশ্বাস করবে না। উন্মাদের কথা কে-ই বা মন দিয়ে শোনে? ওই রকম পাগল বাড়িতে থাকলে বোনদের বিয়ে হবে না, তাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ওর বাবা এই ইন্সটিটিউটে একটা সিট বার করেছিল। বাবা আর দাদা ওকে এনে রেখে গিয়েছিল তাও আজ তিন বছর হতে চলল। এখানকার চিকিৎসায় শঙ্করের কোনও উন্নতি হয়েছে কি না তা জানে না সুকুমার। জানতে চায়ও না। এখানকার কোন পেশেন্টেরই বা অবস্থা ভাল? সবই তো বদ্ধ পাগল। তাও তো শঙ্কর মারকুটে নয়! কথা না বললে বোঝার উপায় নেই যে ও পাগল। সমস্যা হল, মালটা ঠিক কোথায় পুঁতে রেখে গেছে আসলামভাই, তা সুকুমার নিজেও জানে না! চার দিকে এক বার চোখ বুলিয়ে নিল সে।
ঝকঝকে সকাল। দূরে টলটল করছে ঝিলের জল। তারও ও পারে আমবাগান আর সবজির ক্ষেত। আমগাছগুলোর বেশ কয়েকটা এখনও ফলন্ত। তার মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে। এরা এখানেই থাকে। দারওয়ান হরদেও-এর ছেলেটাকে চেনা যাচ্ছে এত দূর থেকেও।
সবজির ক্ষেতে সাদা গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছেন ডক্টর সেন। সঙ্গে বোধহয় সরমাদি আর সুকন্যা। দুজনেই মানসিক ভারসাম্যহীন। ডক্টর সেনের পেশেন্ট। থাকেন লেডিজ উইং-এ। সাদা রঙের দোতলা প্রশাসনিক ভবনটির ডান পাশে লেডিজ উইং, বাঁ দিকে মেন্স উইং। সবক’টি বাড়িই দোতলা, সাদা রঙের। প্রত্যেকটি বাড়ির সামনে এবং পিছনে ফুলের কেয়ারি করা লন। সারা বছর রঙীন হয়ে থাকে ক্যাম্পাস।
সুকুমার এখন দাঁড়িয়ে আছে প্রশাসনিক কার্যালয়ের ঠিক পিছনটায়। এখানকার কর্মচারীদের ভাষায় মেন বিল্ডিং। ফুলের বাগানে তিন জন মালী কাজ করছে। এ ছাড়াও আছে ছোট্ট একটি পশুখামার। সেখানে চারটি গরু এবং ছ’টি হরিণ। সঙ্গে পোলট্রি। সারা ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায় অনেকগুলো নেড়ি কুকুর। তাদেরও দু’বেলা খেতে দেওয়া হয়। পুরো এলাকাটা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বড় বড় আম, জাম, কাঁঠাল, অশ্বত্থ গাছে অজস্র পাখি।
প্রায় চারশো বিঘে জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই হাসপাতাল এবং গবেষণা কেন্দ্র। স্টেশনে নেমে মোল্লার চকের দিকে মিনিট পনেরো হাঁটলে মেঠো রাস্তার ডান দিকে পড়ে ‘মনের জগৎ মনস্তাত্ত্বিক কেন্দ্র’-এর বিরাট উঁচু দেওয়াল আর লোহার গেট। অবশ্য হাসপাতাল এটাকে ঠিক বলা চলে না। এখানে চিকিৎসা হয় ঠিকই, কিন্তু এই সংস্থার প্রধান উদ্দেশ্য চিকিৎসা নয়, গবেষণা। এবং মানসিক ভারসাম্যহীন নারী-পুরুষদের সুস্থ, সুন্দর পরিবেশে আশ্রয় দেওয়া।
আজ থেকে দশ বছর আগে সরকারের কাছ থেকে জমি পেয়ে এখানে এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. স্বামীনাথন রাও। ভদ্রলোকের মাতৃভাষা তামিল, কিন্তু কলকাতাতেই জন্ম, এখানেই বড় হয়ে ওঠা। বাংলা বলেন বাঙালিদের মতোই। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ। গত দশ বছরে এই প্রতিষ্ঠানটি যে আকারে এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে, তার মূলে তিনিই।
মনের জগৎ মনস্তাত্ত্বিক কেন্দ্রের এখন আর অর্থের কোনও অভাব নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদেশি মুদ্রায় অনুদান আসে এই সংস্থার জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিন-চারটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেনের একটি গবেষণাকেন্দ্র, ব্রিটেনের তিন-চারটি বড় জনহিতকর সংস্থা, ফ্রান্সের বেসরকারি সংস্থা, জাপানের কয়েকটি ট্রাস্ট অনুদান দেয়। সব বিভাগ মিলিয়ে এখানে কাজ করেন পনেরো জন ডাক্তার আর আড়াইশো কর্মচারী।
সমস্যা হল, এই প্রতিষ্ঠানের সর্বময় কর্তা ডা. রাও এক জন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মনস্তত্ত্ববিদ। প্রতিষ্ঠানটি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরও প্রতিষ্ঠা বেড়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। মাসের মধ্যে তিন সপ্তাহই তাঁকে বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়। আর তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে এত বড় প্রতিষ্ঠানের আনাচে-কানাচে ঘুণ ধরিয়ে দেওয়ার লোকেরও অভাব হয়নি।
সুকুমার এ সব জানতে পারে এখানকার ম্যানেজার অবিনাশ রাহার কাছ থেকে। অবিনাশবাবু সুকুমারদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তিনিই এই চাকরিতে ঢুকিয়েছেন সুকুমারকে। ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের হেড ক্লার্ক হৃষিকেশ মিত্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অবিনাশবাবু যে এখান থেকে কত টাকা সরিয়েছেন, তা বোধহয় তিনি নিজেই হিসেব করতে পারবেন না। সোনারপুরে তাঁর তিনতলা বাড়ি। এক বারই গিয়েছিল সুকুমার। সত্যনারায়ণ পুজোয় সুকুমারের মা’কে নিমন্ত্রণ করেছিলেন অবিনাশবাবুর স্ত্রী। বাড়ি দেখে তাক লেগে গিয়েছিল সুকুমারের।
বিদেশ থেকে অঢেল পয়সা আসে এই প্রতিষ্ঠানে। তাই ঠিকমত খেলতে পারলে জায়গা বুঝে কয়েক লাখ টাকা এদিক-ওদিক করে ফেলা কোনও ব্যাপার না।
ডা. রাও-এর পরেই এখানে যাঁর স্থান, সেই দীপায়ন সেনগুপ্তও খুব নামকরা ডাক্তার। তাতে কোনও অসুবিধা ছিল না সুকুমারের। সমস্যা যেটা, দীপায়ন সেনগুপ্ত মানুষটিও খুব সৎ। তাই ওষুধপত্র, ইঞ্জেকশন হাপিশ করে দেওয়ার ব্যাপারে আজকাল খুব সতর্ক থাকতে হয় সুকুমারকে। এখানে গবেষণার জন্য এমন সব বিদেশি ওষুধপত্র আসে যা অনেক সময় বাইরের দোকানে পাওয়া যায় না। তেমন জিনিস সরাতে পারলে ব্ল্যাকে খুব ভাল দাম পাওয়া যায়। সুকুমার এখন এই প্রতিষ্ঠান থেকে যা বেতন পায়, তার চেয়ে বেশি আয় করে ওষুধ ব্ল্যাক করে। কিন্তু ডা. সেনগুপ্তর উপস্থিতি তাকে উত্তরোত্তর চিন্তিত করে তুলেছে। গত মাসে তো তাকে প্রায় হাতেনাতে ধরেই ফেলেছিলেন। সেই থেকে সুকুমার প্রাণপণে তেল দিয়ে চলেছে অবিনাশবাবুকে, যদি তিনি মেডিক্যাল থেকে কোনও ভাবে ফিনান্সে বা প্রশাসনিক বিভাগে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু নানা বাহানায় তাকে কাটিয়ে দিচ্ছেন অবিনাশবাবু। কেন, তা বোঝে সুকুমার। ওখানে গেলেই তো সুকুমার অবিনাশবাবুর খেলাটা ধরে ফেলবে! সেটা চাইবেন কেন উনি?
এই প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে একটু একটু করে পচন ধরছে, তা তো চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছে সুকুমার। পশুখামার নামেই। গরু, হরিণগুলো ঠিকমত খেতে পায় না। হরিণগুলো চরে খায়। গরুদের তেমন ছাড়া হয় না বলে জরাজীর্ণ চেহারা। পোলট্রিতে মুরগি মারা যাচ্ছে প্রায়ই। প্রতি দিন অর্ধেক ডিম হাপিশ হয়ে যায়। আবাসিকদের সকালের ব্রেকফাস্টে ডিমসেদ্ধ দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কিচেনে এখন একটা ডিম ভেঙে দুটো পাতলা পাতলা ওমলেট তৈরি হয়। কোনও দিন যদি ধরা পড়ে এ সব, সাংঘাতিক কাণ্ড হবে। একটাই আশার কথা, দীপায়ন সেনগুপ্ত একা আর কত দিক দেখবেন?
সুকুমার যখন ভাবছিল কথাটা, ঠিক তখনই একই প্রশ্ন আছড়ে পড়ছিল অবিনাশ রাহার সামনে।
‘আমি একা আর কত দিক দেখব অবিনাশবাবু? লেডিজ ওয়ার্ডে এক জন আত্মহত্যা করার জন্য ছাদে উঠে গেল আর কেউ টের পেল না? নার্সরা কি সবাই ঘুমোচ্ছিল?’
অবিনাশ রাহা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রচণ্ড রেগে গেছেন দীপায়ন সেনগুপ্ত। এখন কোনও কথা না বলাই সমীচীন।
প্রশাসনিক ভবনটির দোতলায় নিজের অফিসে ক্রুদ্ধ ভাবে পায়চারি করছেন দীপায়ন।
‘কী হল, মিস্টার রাহা, কিছু বলুন? নার্সরা কী করছিল?’
‘খোঁজ নিচ্ছি, স্যর।’
‘খোঁজ নিচ্ছি না, বলুন এখনই খোঁজ নেব! লেডিজ উইং-এ আজ হেড নার্স-অন-ডিউটি কে? ডাকুন তাকে। আর আপনি নিজে থাকুন এখানে।’
গত কাল রাত ন’টা নাগাদ লেডিজ উইং-এ একটা বিকট হইচই শুনে হরদেও দারোয়ান আর দু-তিন জন মালী ছুটে যায়। ওরা ক্যাম্পাসের মধ্যেই থাকে। আউটহাউসের একতলায় ঘর দেওয়া হয়েছে তাদের।
লেডিজ উইং-এ তখন তোলপাড় চলছে। রাত সাড়ে আটটায় নৈশাহার করেন আবাসিকরা। কিচেন একটাই, মেন্স উইং-এর এক তলায়। সেখান থেকে এক দল কর্মচারী বড় বড় ডেকচিতে খাবার নিয়ে আসেন লেডিজ উইং-এর এক তলার বিশাল ভোজনকক্ষে। সেখানে লম্বা টেবিলের দু’পাশে সকলের একসঙ্গে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা। রাত ন’টা থেকে সাড়ে ন’টা আবাসিকদের নিজস্ব সময়। ওই সময়টা তাঁরা উইং-এর মধ্যে ঘুরেফিরে বেড়াতে পারেন। সাড়ে ন’টার সময় সবাইকে শুয়ে পড়তে হয়। তার পর কর্মচারী ও নার্সরা খেতে বসেন।
মানসিক রুগিদের কখনওই একা ছাড়ার নিয়ম নেই। প্রতিটি আবাসিকের উপর নজর রাখার কথা নার্সদের। সে জন্য তাঁদের মেন্স এবং লেডিজ উইং দুটির একতলা-দোতলার প্রতিটি ঘরে ডিউটির সময় নির্ধারিত করা আছে। নার্সরা আট ঘণ্টার শিফ্ট করেন। প্রভাতি বা মধ্যদিবসের ডিউটি পড়লে তাঁরা বাড়ি থেকে আসা-যাওয়া করতে পারেন। কিন্তু রাতের ডিউটি যাঁদের পড়ে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা আছে প্রতি তলায়। তাই কোনও সময়েই কোনও রুগির একা থাকার কথা নয়।
কিন্তু গত কাল কী ভাবে যেন লেডিজ উইং-এর মিনতি ধর একা একা ছাদে উঠে গিয়েছিলেন। ছাদের দরজায় তালা পড়ে রাত দশটায়। তার আগে পর্যন্ত দরজায় শুধু হুড়কো লাগানো থাকে। আবাসিকদের কারও ছাদে ওঠার কথা নয়। কাল খোলা ছিল ছাদের দরজা। নার্সদের এক জনের তখন ডিউটি ব্রেক। মহিলার ধূমপানের অভ্যাস ছিল। উইং-এর কোথাও ধূমপানের নিয়ম নেই, তাই তিনি ছাদে উঠেছিলেন নিশ্চিন্তে একটা সিগারেট ধরাতে। অন্ধকার ছাদের অন্য প্রান্তে একটা শব্দ শুনে নার্সটি যখন সে দিকে এগিয়ে যান, তত ক্ষণে মিনতি ধর টলোমলো পায়ে কার্নিসের উপর উঠে দাঁড়িয়েছেন। ঝাঁপ দিতে উদ্যত।
মিনতি ধর এখানকার সবচেয়ে পুরনো আবাসিকদের এক জন। ঢাকুরিয়া স্টেশনে লাইন পার হতে গিয়ে তাঁর দুই ছেলেকে ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়তে দেখেন মিনতিদেবী। বড় ছেলের বয়স তখন দশ, ছোটটির সাত। ইস্কুল থেকে তাদের নিয়ে ফিরছিলেন তিনি। তাড়াহুড়ো করে লাইন পার হতে গিয়েছিলেন। নিজে পেরিয়ে যান ঠিকই, কিন্তু ছেলেরা আর পার হওয়ার সময় পায়নি! ট্রেন চলে যাওয়ার পর দুটি বালকের দেহের আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। খণ্ড খণ্ড রক্তমাংসের দলা, জামাকাপড়ের টুকরো। দেখে অজ্ঞান হয়ে যান মিনতিদেবী। জ্ঞান ফিরেছিল, কিন্তু মানসিক ভারসাম্য আর ফেরেনি! মাঝে মাঝেই তিনি এখন ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পান। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন, ট্রেনের আলো এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে, আর দু’দিকে তাঁর দুই ছেলে বলছে, ‘মা, মা, ট্রেন আসছে, ট্রেন আসছে!’ মিনতি ধরের আর্ত চিৎকারে মাঝরাতে জেগে ওঠেন অন্যান্য আবাসিকরা।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy