ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
১৩
অবৈধের নিবিড় স্পর্শ
অলকেশ লাহিড়ীর নাম আগে কখনও শোনেনি বুধুয়া। কিন্তু ওই লোকটার জন্যই নাকি তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে!
বাবাকে নাকি সে দিন পুলিশ ধরেছিল। এমনি পুলিশ নয়, রেল পুলিশ। ওই অলকেশ লাহিড়ী নাকি রেল পুলিশের বড়বাবু। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে দিন বাবা। অনেক রাত পর্যন্ত মা’কে আর ঠাকুমাকে বোঝাল। পুলিশ নাকি এখনও জানে না, কিন্তু জানতে কত ক্ষণ? বাবা, মা আর ঠাকুমা ফিসফিস করছিল। তখনই তো অলকেশ লাহিড়ীর নামটা শুনল বুধুয়া! সে নাকি খুব খারাপ লোক। ধরতে পারলে বুধুয়াকেও জেলে পুরে দেবে!
তাকে ধরবে কেন? ঠাকুমা বলেছিল, অন্যায় করলে পুলিশে ধরে! সে কি তা হলে অন্যায় করেছে? কী অন্যায়? এই কথাটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না বুধুয়া। সে দিন রাতে তাকে আর ছোটনকে ঘুম পাড়িয়ে মা, বাবা আর ঠাকুমা আলোচনা করছিল। ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল বুধুয়া, কিন্তু মা আর ঠাকুমা বুঝতে পেরে গিয়েছিল বোধহয়। যখনই তার নাম উঠছিল, তখনই গলা নামিয়ে ফেলছিল সবাই। ফিসফিস করে কথা বলছিল। আর ঘুমের ভান করতে করতে কখন যে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছে বুধুয়া, সে নিজেই জানে না!
পরের দিন একেবারে কাকভোরে তাকে ডেকে তুলেছিল ঠাকুমা। ওই অত সকালে স্নান করিয়ে পরিষ্কার জামাকাপড় পরিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে দিয়েছিল একটা ছোট্ট সুটকেস। তাতে তার জামাকাপড়। দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল বুধুয়া। তখনই তো মা আর ঠাকুমা তাকে খুব আদর করল। বলল, বড়মামু আর বড়মামি নাকি তাকে দেখতে চেয়েছে, তাই তাকে বরাকরে নিয়ে যাবে বাবা।
বরাকর যেতে তো ভালই লাগে বুধুয়ার, কিন্তু ইস্কুলে এখন কত মজা হচ্ছে রোজ। স্বাধীনতা দিবসের রিহার্সাল হচ্ছে। স্পোর্টসের প্র্যাকটিস হচ্ছে দু’বেলা। এ সব ছেড়ে এখুনি তাকে বরাকর যেতে হবে কেন? সহজে যেতে রাজি হয়নি সে। কিন্তু বাবা খুব বকেছিল তাকে। বলেছিল, তাকে যেতেই হবে বড়মামুর কাছে। না হলে বড়মামু আর মামি নাকি খুব রাগ করবে। খুব কেঁদেছিল বুধুয়া। তাই দেখে শেষ পর্যন্ত একটু নরম হয়েছিল বাবা। বলেছিল, স্বাধীনতা দিবসের আগেই তাকে ফিরিয়ে আনবে শিউলিবাড়িতে। স্বাধীনতা দিবসে সে যাতে ইস্কুলে যেতে পারে।
পরে অবশ্য ইস্কুলের মাস্টারমশাইরাও তা-ই বলেছেন। গত কাল বাবা এসেছিল ঠাকুমাকে নিয়ে। বুধুয়াকে দেখে গিয়েছে। বাবা নাকি তার ইস্কুলে গিয়ে মিথ্যে কথা বলেছে! বলেছে তার শক্ত অসুখ হয়েছে, তাই সে ক’দিন আসতে পারবে না ইস্কুলে। শুনে হেডস্যর পর দিন সন্ধেয় তাদের বাড়িতে চলে এসেছিলেন বুধুয়াকে দেখতে। বুধুয়া বাড়িতে নেই দেখে তিনি নাকি বাবাকে খুব বকেছেন। বলেছেন, স্বাধীনতা দিবসের আগে সে যেন অবশ্যই ইস্কুলে ফিরে যায়।
বুধুয়াদের স্কুলের হেডস্যর নিশিকান্ত ঝা বিহারি হলেও খুব ভাল বাংলা বলেন। সবাই বলে, উনি খুব লেখাপড়া করা লোক। আর কী একটা পার্টি করেন বলে সবাই খুব ভয়ও পায় ওঁকে। আবার মান্যও করে। হেডস্যর ও রকম করে বলে গিয়েছেন বলে বাবা এখন বলছে, স্বাধীনতা দিবসের আগে বাড়িতে ফেরত নিয়ে যাবে বুধুয়াকে। না হলে নাকি অনেক দিন পরে নিয়ে যেত। তাই বোধহয় বুধুয়া বরাকর চলে আসার দিন মা অত কাঁদছিল, চোখে আঁচল চেপে।
ঠাকুমা এ সব বলেছে বুধুয়াকে। ঠাকুমা তাকে খুব ভালবাসে তো!
বুধুয়া খুব চেয়েছিল, ঠাকুমা কাল রাতে থেকে যাক। বড়মামু আর বড়মামিও বারে বারে বলেছিল ঠাকুমাকে। কিন্তু বাবা রাজি হয়নি। ঠাকুমাকে বাড়িতে রেখে কালই নাকি কোথায় যেতে হবে বাবাকে। আর ঠাকুমা চলে যাওয়ার পর থেকেই একটু মনকেমন করছে বুধুয়ার। কত দিন মা’কে দেখেনি সে! ছোটনটা সব সময় তার সঙ্গে সেঁটে থাকত বলে ওকে কত বকেছে বুধুয়া। এখন মনে হচ্ছে, ছোটনকে একটু খেপাতে পারলে ভাল হত। তবে ঠাকুমা বলে গেছে, আর তো ক’টা দিন। স্বাধীনতা দিবসের দু’সপ্তাহও আর বাকি নেই। বাবাকে খুব তাড়াতাড়িই আসতে হবে আবার, ফেরত নিয়ে যেতে হবে বুধুয়াকে।
বাবাকেও সে কথা বলতে শুনেছে বুধুয়া। বড়মামুকে বলছিল বাবা। অবস্থা এখন আবার কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। এখন আর অতটা ভয় নেই। কিছুই পায়নি পুলিশ। আর হেডস্যর নিশিকান্ত ঝা বুধুয়াকে এত ভালবাসেন, এটা আশার কথা! ওঁকে খুব একটা চটাতে সাহস করবে না পুলিশ। হেডস্যর যে তাকে এত ভালবাসেন, এটা তো কখনও বুঝতেই পারেনি বুধুয়া। তাদের সামনে তো হেডস্যর সব সময় গম্ভীর, রাশভারী এক জন মানুষ। চোখে কালো ফ্রেমের মোটা চশমা, হাতে বই।
কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছে না সে। পুলিশ তাকে ধরবে কেন? কী করেছে সে? আর ‘অবস্থা ঝিমিয়ে পড়া’ কাকে বলে? অবস্থা ঝিমিয়ে পড়েছে বলে তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে বাবা? আর অবস্থা যদি আবার না-ঝিমোনো হয়ে যায়, তখন? আবার কি বাবা তাকে বরাকরে নিয়ে আসবে?
এখানে অবশ্য ভালই লাগে বুধুয়ার। প্রতি বছরই কালীপুজোর সময় মা তাকে আর ছোটনকে নিয়ে বড়মামুর কাছে চলে আসে। বরাকরে খুব ধুমধাম করে দু-তিনটে কালীপুজো হয়। তার পর ভাইফোঁটা। বড়মামুকে ফোঁটা দেয় মা। আগের বছর তো মেজমামু আর ছোটমামুও এসেছিল। মেজমামু চাকরি করে পুণেতে। আর ছোটমামু কলকাতায়। বড়মামু-বড়মামির এখনও কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি, তাই ওরা বুধুয়াকে খুব ভালবাসে। বড়মামি খুব ভাল রান্না করতে পারে। কাল তো বাবা আর ঠাকুমা আসবে বলে কড়াইশুঁটির কচুরি, আলুর দম, আরও কত কী রেঁধেছিল। বাবার জন্য মাংস নিয়ে এসেছিল বড়মামু। ঠাকুমা তো নিরামিষ খায়, কিন্তু বড়মামু আর বাবার সঙ্গে বসে বুধুয়া মাংস-ভাত খেয়েছিল। দারুণ হয়েছিল খেতে।
বড়মামুর বাড়িটা বরাকর স্টেশনের একেবারে গায়েই বলা চলে। বরাকর স্টেশনে লাইনম্যানের কাজ করে বড়মামু। ট্রেন চলে যাওয়ার আগে-পরে লাইন ঠিকঠাক আছে কি না, দেখে। মাঝেমধ্যে সিগনাল দেয়। বড়মামুর কোয়ার্টারের থেকে এক দিকে একটু এগোলেই যেমন রেল স্টেশন, অন্য দিকে একটু গেলেই বরাকর নদী। নদী যখন ভরা থাকে, টলটল করে জল। দূরে বিশাল বাঁধ। বাঁধে জল ছাড়ে মাঝে মাঝে! ঝরঝর করে ঢল নামছে জলের, বিরাট গম্ভীর একটা গর্জন করে! রোদের ছটা লেগে চিকচিক করছে লাফিয়ে ওঠা জলকণাগুলো। দারুণ লাগে বুধুয়ার। মুনিয়ার সঙ্গে সে প্রায়ই বরাকর নদীর ধারে খেলতে যায়।
বুধুয়ার থেকে বছর দুয়েকের ছোট মুনিয়া। ফুলিমাসি আর হিতেশমেসোর মেয়ে। হিতেশমেসোকে অবশ্য হিতেশমেসো বলে ডাকে না বুধুয়া, শুধু মেসো বলে। আর ফুলিমাসি ফুলিমাসিই। বড়মামুদের পাশের বাড়িতে থাকে ফুলিমাসিরা। ফুলিমাসি বড়মামির খুব বন্ধু। কিন্তু ফুলিমাসির যে আর একটা বন্ধুও আছে, সে কথা তো আগে জানত না বুধুয়া! জেনেছে গত পরশু।
সে দিন বিকেলবেলা খেলতে খেলতেই তো ঘটল ঘটনাটা। ছোট্ট একটা বাচ্চা শালিকপাখি বসেছিল গাছের ডালে। মা’টা বোধহয় মুখে করে একটু খাবার বা খড়কুটো নিয়ে আসতে গেছে। অমনি মুনিয়া তাকে বলল, ‘তোর তো খুব টিপ, পারবি পাখিটাকে মারতে?’
খুব ডানপিটে মুনিয়াটা। বুধুয়া তো কখনও পাখির গায়ে মারে না, কিন্তু মুনিয়াকে হাতের টিপ না দেখালে চলে? তা হলে মুনিয়া তো যা-তা বলবে! তাই সে একটা ঢিল নিয়ে এমন ভাবে তাক করে মেরেছে যে পাখিটার গায়ে লাগেনি একটুও, কিন্তু পাখিটা যেখানে বসে ছিল, ঠিক সেইখানে গাছের ডালটা ভীষণ ভাবে দুলে উঠেছে। আর তাতে হয়েছে কী, ছোট্ট পাখিটা টাল সামলাতে না পেরে, মাটিতে পড়ে গেছে। পাখির বাচ্চাটা যে তখনও ঠিকমত উড়তে শেখেনি, এটা ঠিক বুঝতে পারেনি বুধুয়া! তা হলে কিছুতেই সে ডালটা লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ত না! পাখির বাচ্চাটা পড়ে যাওয়ামাত্রই দৌড়ে গিয়ে সেটাকে খপ করে ধরে ফেলেছে মুনিয়া। আর বুধুয়া সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুনিয়ার উপর।
‘ছেড়ে দে, ছেড়ে দে!’
‘না ছাড়ব না, বাড়ি নিয়ে গিয়ে পুষব।’
‘বলছি ছাড়! ও মা’র কাছে যাবে!’
‘ইইস! তুই ধরেছিস? আমি ধরেছি! ছাড়ব
না আমি।’
‘ছাড়বি না? দেখাচ্ছি তবে।’
দুজনে হুটোপুটি, জাপটাজাপটি করতে করতে একেবারে জড়িয়েমড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেছে। তত ক্ষণে পাখিটা হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে মুনিয়ার। অপরিণত ডানা ঝটপটিয়ে কোনও মতে সামনের একটা ডালে উড়ে গিয়ে বসেছে। আর দূর থেকে দেখতে পেয়ে মা’টাও সটান চলে এসেছে তার শিশুর কাছে।
মুনিয়া আর বুধুয়া দুজনেই হাঁপাচ্ছে। বুধুয়া ছেড়ে দিয়েছে মুনিয়াকে। উঠে বসেছে দুজনে। মুনিয়া রাগ-রাগ চোখ করে তাকাচ্ছে বুধুয়ার দিকে।
‘ও রকম করলি কেন রে তুই? আমি কী সত্যি সত্যিই রাখতাম নাকি পাখিটাকে?’
‘তুই যে বললি ছাড়বি না? আমার পাখি ধরলে খুব কষ্ট হয়!’
‘কষ্ট তো আমারও হয়। অত ছোট্ট পাখিকে কেউ মা’র কাছ থেকে নিয়ে যায়?’
‘তবে বললি কেন ছাড়বি না?’
‘তোকে খ্যাপাব বলে! বুদ্ধুরাম!’
‘কি, আমি বুদ্ধু?’
‘তা না তো কী? তুই কী রকম খেপে গেলি... হিহি...’
‘দেখ মুনিয়া, বুদ্ধু বললে ভাল হবে না বলছি!’
‘বলবই তো! বলবই তো! কী রকম করলি তুই! একদম... হিহি...’
‘একদম কী?’
‘একদম... একদম... হিহিহি...’
‘একদম কী বল না! শুধু হিহি করছিস কেন?’
‘একদম সুজনকাকুর মতো করলি। হিহি।’
‘কার মতো?’
‘সুজনকাকু।’
‘সুজনকাকু কে?’
‘সুজনকাকুকে চিনিস না, এ মা! সবাই চেনে তো! ইলেকট্রিকের কিছু খারাপ হয়ে গেলে সারিয়ে দেয়, টিভিও সারায়!’
‘ওই যে যে দিন বড়মামির ঘরে ফ্যান সারাতে এসেছিল?’
‘হ্যাঁ, ওটাই তো সুজনকাকু!’
‘তা আমি সুজনকাকুর মতো কেন হব? আমি কি ফ্যান সারাতে পারি? হাতেই পাব না! মইয়ে উঠেও না!’
‘ফ্যান সারাবি কেন? তুই যে ও রকম করলি!’
‘কী করলাম?’
‘ওই যে আমাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ঝটাপটি করলি আমার উপর চেপে! সুজনকাকুও ঠিক ও রকম করে!’
‘সুজনকাকু ও রকম করে? কার সাথে?’
‘সুজনকাকু আর মা।’
‘মা মানে? ফুলিমাসি? যাহ্!’
‘হ্যাঁ রে, সত্যি বলছি, মা কালীর দিব্যি!’
‘তুই নিজের চোখে দেখেছিস?’
‘না তো কী? অনেক বার দেখেছি।’
‘কোথায়?’
‘কোথায় আবার? আমাদের ঘরে! তবে বাবা থাকলে করে না। বাবা অফিস গেলে যখন টিভি সারাবার জন্য সুজনকাকুকে ডেকে পাঠায় মা, তখন করে। দুপুরবেলায়।’
‘যাহ্!’
‘হ্যাঁ রে, তিন সত্যি! আচ্ছা ঠিক আছে। বিশ্বাস করলি না তো আমার কথা? এর পর যদি আসে সুজনকাকু, তোকে দেখাব! দেখাতে পারলে নাক মুলবি, কান মুলবি তো?’
‘ক’বার?’
‘এক বার নাক, এক বার কান। মুলবি তো?’
‘তুই পারবিই না দেখাতে!’
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy