চায়ের দোকান থেকে দিল্লির উচ্চপদস্থ আমলা! এ এক অন্য চাওয়ালার গল্প
হিমাংশুকে ভর্তি করানো হয় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। কিন্তু সেই স্কুল ছিল বাড়ি থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। স্কুলের পড়াশোনার জন্য প্রতি দিন ৭০ কিলোমিটার সফর করতে হত কিশোর হিমাংশুকে।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:০৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
দিনমজুরের কাজ করতেন বাবা। কাজ না পেলে অস্থায়ী চায়ের দোকানও দিতেন কখনও-সখনও। সেই দোকানেই বাবাকে সাহায্য করত ছেলেটি। গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পৌঁছে দিত ক্রেতাদের হাতে। চায়ের দোকানে কাজ করা সেই ছেলেই আজ দেশের একজন আমলা। আইএএস অফিসার।
০২১৮
নাম হিমাংশু গুপ্ত। ইউপিএসসি-র সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কোনও রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই বসেছিলেন। আর প্রথম বারেই পাশও করে গিয়েছিলেন। কিন্তু হিমাংশু তার পরেও আরও দু’বার ইউপিএসসি পরীক্ষা দেন।
০৩১৮
২০১৮ সালে পরীক্ষায় পাশ করে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ট্র্যাফিক সার্ভিসে (আইআরটিএস)-এ সুযোগ পেয়েছিলেন। ২০১৯ সালে আবার পরীক্ষা দিয়ে আইপিএস হওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু হিমাংশু ঠিক করে নিয়েছিলেন, তিনি দেশের প্রশাসনিক কাজ করবেন। আইএএস হবেন। তাই ২০২০ সালে আবার ওই পরীক্ষায় বসেন। এবং আইএএস হন।
০৪১৮
গোটা ভারতের ১৩৯ তম স্থানাধিকার করেছিলেন হিমাংশু। আর এই প্রচেষ্টা এবং লড়াই পুরোটাই ছিল তাঁর একার। বাড়িতে কেউ সাহায্য করার ছিল না। আবার প্রথাগত প্রশিক্ষণ নেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থাও ছিল না তাঁর।
০৫১৮
উত্তরাখণ্ডে বাড়ি। সেই বাড়িতে বাবা-মা ছাড়াও থাকতেন হিমাংশুর ভাই-বোনেরা। তবে বাবার সঙ্গে প্রায় দেখাই হত না তাঁর। কাজের খোঁজে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন তিনি। আবার কখনও পর্যটনের মরসুমে বাড়ি ফিরে খুলতেন চায়ের দোকান। হিমাংশু সেই দোকানেই বাবাকে মাঝেমধ্যে সাহায্য করতেন।
০৬১৮
কিন্তু এ সব কাজে পাঁচ জনের সংসার চলত না। তাই একটা সময়ে উত্তরাখণ্ড ছেড়ে উত্তরপ্রদেশের বরেলীতে মামারবাড়িতে তাঁদের নিয়ে চলে আসেন মা। সেখানেই হিমাংশুর বড় হয়ে ওঠা। একটি স্থানীয় সরকারি স্কুলে শুরু হয় তাঁর পড়াশোনা।
০৭১৮
হিমাংশুর বয়স যখন ১১ তখন বরেলীর সিরউলিতে চলে আসেন তাঁরা। বাবা সেখানে একটি মুদিখানার দোকান খোলেন। হিমাংশুকে ভর্তি করানো হয় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। কিন্তু সেই স্কুল ছিল বাড়ি থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। স্কুলের পড়াশোনার জন্য প্রতি দিন ৭০ কিলোমিটার সফর করতে হত কিশোর হিমাংশুকে।
০৮১৮
এ ভাবেই শেষ করেছেন পড়াশোনা। এক সাক্ষাৎকারে হিমাংশু বলেছেন, ছোট থেকে আইএএস হবেন ভেবে পড়াশোনা করেননি। বস্তুত উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ইউপিএসসি পরীক্ষা, আইএএস নিয়ে স্পষ্ট ধারণাই ছিল না তাঁর। ছিল না কোনও আগ্রহও। কলেজে পড়তে দিল্লিতে এসে প্রথমে ইউপিএসসির বিষয়ে জানতে পারেন তিনি।
০৯১৮
উচ্চ মাধ্যমিকের পর দিল্লিতে চলে আসেন হিমাংশু। ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। আর এই দিল্লি আসার পরই তাঁর জীবন আমূল বদলে যায় বলে জানিয়েছেন হিমাংশু। তাঁর কথায়, ‘‘আমি যে গ্রামে থাকতাম, সেখানে সব কিছু খুব ঢিলেঢালা গোছের। আর দিল্লিতে এসে দেখলাম ব্যস্ততা কাকে বলে। সবাই ছুটছে এখানে।’’
১০১৮
প্রথম কয়েকটা মাস দিল্লির আবহের সঙ্গে মানিয়ে নিতেই চলে যায় হিমাংশুর। তার পরে ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে দূরে অন্য পরিবেশে নিজেকে আবিষ্কার করতে শুরু করেন ভাবী আইএএস অফিসার। হিমাংশু ওই সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, এই বদলের জন্য তিনি তাঁর দিল্লির শিক্ষক এবং বন্ধুদের কৃতিত্ব দিতে চান। কারণ ওই কলেজ ক্যাম্পাসই ছিল তাঁর প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র।
১১১৮
হিন্দু কলেজ থেকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা করতে যান হিমাংশু। পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকোত্তরে ডিগ্রি অর্জন করেন। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হন হিমাংশু। যার ফলে বিদেশে পিএইচডি করার স্কলারশিপও পেয়ে যান।
১২১৮
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া শেষও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন হিমাংশু। ঠিক করেন ভারতেই থাকবেন। তবে পাকাপাকি ভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে তাঁর তিন মাস সময় লেগেছিল বলে জানিয়েছেন হিমাংশু।
১৩১৮
বাবা-মায়ের দিক থেকে কখনও কোনও চাপ আসেনি। তাঁরা বরাবর হিমাংশুর বুদ্ধির উপর ভরসা করেছেন। বিদেশে না গিয়ে দেশে থেকে দেশের কাজ করার সিদ্ধান্তও ছিল সম্পূর্ণ তাঁরই। হিমাংশু বলেছেন, ‘‘আসলে আইএএস হিসাবে দেশের বিভিন্ন স্তরে কাজ করার আকর্ষণই টেনেছিল আমাকে।’’
১৪১৮
এ ভাবেই দেশের আমলাতন্ত্রের চৌহদ্দির দিকে প্রথম পদক্ষেপ হিমাংশুর। তার পরে আর ফিরে তাকাননি তিনি। ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিন বার ইউপিএসসির সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসে অবশেষে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছন তিনি।
১৫১৮
গত বছর জুলাইয়েও যোগী আদিত্যনাথের সরকারের উপজেলাশাসক ছিলেন হিমাংশু। এখন তাঁর ইনস্টাগ্রাম পোস্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, তিনি দিল্লিতে কর্মরত।
১৬১৮
নিজের সাফল্যের জন্য পরিবারের সমর্থনকেই কৃতিত্ব দেন হিমাংশু। বলেছেন, ‘‘ওঁরা প্রথম থেকেই বিশ্বাস করে এসেছেন আমি সফল হবই। সেই ভাবনাটাই আমাকে আরও কঠিন লড়াই লড়তে সাহায্য করেছে।’’
১৭১৮
তাঁর মতো যাঁরা ইউপিএসসি পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেতে চান, তাঁদের জন্য পাঁচটি পরামর্শও দিয়েছেন হিমাংশু।
১৮১৮
হিমাংশুর মতে, ১)পড়ার থেকে বেশি পড়া ঝালিয়ে নিতে হবে। ২) ইন্টারনেটে প্রস্তুতি নেওয়ার যে সমস্ত সাহায্য পাওয়া যায়, তার উপযুক্ত ব্যবহার করতে হবে। ৩) শুধু পড়াশোনা নয়, নিজের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যও ভাল রাখতে হবে। ৪) আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। ৫)এই সুযোগ বার বার পাওয়া যায় না, তাই যতটা জানা যায়, জেনে নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। অর্জিত জ্ঞান কখনও বিফলে যায় না।