আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান আইনজীবীর বিরুদ্ধেই এ বার উঠল যৌন উৎপীড়নের অভিযোগ। যুদ্ধাপরাধের কথা বলে ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার দাবি তুলেছিলেন তিনি।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৩৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
এ যেন সর্ষের মধ্যেই ভূত! দুনিয়ার ‘সর্বোচ্চ’ অপরাধ আদালতের মুখ্য আইনজীবীর (চিফ প্রসিকিউটর) বিরুদ্ধে উঠল যৌন উৎপীড়নের অভিযোগ! পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধাপরাধ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় কি চক্রান্তের শিকার হলেন তিনি? না কি নেপথ্যে আরও কোনও গভীর ষড়যন্ত্র? উঠছে প্রশ্ন।
০২২১
অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম করিম খান। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট বা আইসিসি) চিফ প্রসিকিউটর বা প্রধান আইনজীবী পদে রয়েছেন তিনি। এক মহিলা আইনজীবীর করা যৌন নিপীড়নের অভিযোগকে কেন্দ্র করে রাতারাতি খবরের শিরোনামে এসেছেন এই ব্রিটিশ আইনবিদ।
০৩২১
চলতি বছরের ১১ নভেম্বর করিমের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগের তদন্ত বহিরাগত নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত নেয় আইসিসির গভর্নিং বডি, যাকে স্বাগত জানিয়েছেন মুখ্য আইনজীবী। পাশাপাশি, সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
০৪২১
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন ব্রিটেনবাসী করিম। তাঁর কথায়, ‘‘তদন্তে সত্যিটা উঠে আসবে। তাই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকব। পাশাপাশি, তদন্ত চলাকালীন চিফ প্রসিকিউটারের কাজও চালিয়ে যাব।’’
০৫২১
ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘গার্ডিয়ান’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিযোগকারী মহিলা কৌঁসুলি অবাঞ্ছিত যৌন স্পর্শ ও কাম উত্তেজনা তৈরির অভিযোগ করেন চিফ প্রসিকিউটারের বিরুদ্ধে। শুধু তা-ই নয়, এ ব্যাপারে আইসিসির নজরদারি সংস্থা ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওভারসাইট মেকানিজ়ম’-এর (আইওএম) দক্ষতা ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
০৬২১
এ হেন অভিযোগ উঠতেই তৎপর হয় আইসিসি। এ বছরের অক্টোবরে তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা আইওএমের সভাপতি পাইভি কাউকোরান্ত অভিযোগকারিণীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁকে তদন্তের আশ্বাস দেন তিনি।
০৭২১
সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে আইসিসি অন্য কোনও আইনজীবী মারফত চিফ প্রসিকিউটরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পরে সেই অবস্থান থেকে সরে আসে তারা। নিরপেক্ষতার কথা ভেবেই বহিরাগত সংস্থাকে এ কাজের দায়িত্ব দিচ্ছে আইসিসি।
০৮২১
এ বছরের ২৯ এপ্রিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যোগ দেন করিম খান। গত ২০ মে পশ্চিম এশিয়ার গাজ়ায় যুদ্ধাপরাধের জন্য ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়ের গ্যালেন্টকে দায়ী করেন তিনি। দু’জনের বিরুদ্ধেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে আইসিসির কাছে আবেদন করেন সেখানকার চিফ প্রসিকিউটর।
০৯২১
ইহুদি প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছাড়া গাজ়ার সশস্ত্র সংগঠন ‘হামাস’-এর একাধিক নেতার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তোলেন করিম। তাঁদের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানার দাবি করে ওকালতনামা পেশ করেন তিনি, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায়।
১০২১
করিমের এ হেন পদক্ষেপের সমালোচনা করেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। হামাসের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে কী ভাবে তাঁর তুলনা হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ইহুদি রাষ্ট্রপ্রধান। করিমকে পক্ষপাতদুষ্টের তকমা দিয়ে কূটনৈতিক ভাবে চাপ তৈরির চেষ্টা শুরু করেন তিনি।
১১২১
এই ইস্যুতে ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়ায় আমেরিকা। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে, আইসিসির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর হুমকি দেয় ওয়াশিংটন। হামাস ও ইজ়রায়েলকে এক সারিতে রাখা ঘোরতর অনুচিত বলেও জারি করে বিবৃতি, যার তারিখ ছিল ২২ মে।
১২২১
এ ব্যাপারে নিজের দেশ ব্রিটেনেরও সমর্থন পাননি করিম। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক জানিয়ে দেন, ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিকে কখনওই সমর্থন করবে না লন্ডন। নেতানিয়াহুকে যুদ্ধপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাওয়া আইসিসির চিফ প্রসিকিউটরের সমালোচনা করেন তিনি।
১৩২১
অন্য দিকে, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্পেন এই ইস্যুতে করিমের পাশে দাঁড়ায়। ইউরোপের এই তিন দেশ প্যালেস্টাইনকে মান্যতা দিয়ে থাকে। তাদের তরফে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, আইসিসির জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে।
১৪২১
নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্পেনের ওই বিবৃতির পর এই তিন দেশের সঙ্গে যাবতীয় কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় নেতানিয়াহুর সরকার। সেখান থেকে রাষ্ট্রদূতদের দেশে ফেরার নির্দেশ দেন বেঞ্জামিন। এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই আগের অবস্থান থেকে সরে আসে ব্রিটেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার বলেন, ‘‘আইসিসি কোনও নির্দেশ দিলে তা মানতে আমরা বাধ্য।’’
১৫২১
কিন্তু এর পরই অন্য দিকে মোড় নেয় এই ঘটনা। তিন বিচারপতির বেঞ্চে নিজের ওকালতনামা পেশ করেছিলেন করিম। ২৫ অক্টোবর রহস্যজনক ভাবে তাঁদের এক জনকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। তাঁর জায়গায় আসা নতুন বিচারপতি প্রথম থেকে বিষয়টি শুনবেন বলে জানিয়ে দেন। ফলে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এখনই যে কোনও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে না, তা বলাই বাহুল্য।
১৬২১
বিচারপতি ছুটিতে যাওয়ার ঠিক দু’দিনের মাথায় (২৭ অক্টোবর) করিমের বিরুদ্ধে যৌন উৎপীড়নের অভিযোগ ওঠে, যা কাকতালীয় বলে মানতে নারাজ ইহুদি-বিরোধীরা। যদিও বিষয়টি নিয়ে ইজ়রায়েলের তরফে সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি।
১৭২১
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, আইসিসির পক্ষে নেতানিয়াহুর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা যথেষ্ট কঠিন। কারণ, সে ক্ষেত্রে আমেরিকা এই প্রতিষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। ফলত ইহুদি প্রধানমন্ত্রীর ওয়াশিংটনে পা রাখায় কোন সমস্যাই হবে না।
১৮২১
দ্বিতীয়ত, করিম যে সমস্ত হামাস নেতার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির দাবি জানিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই গাজ়ার যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। সেই তালিকায় রয়েছে হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের নাম। ফলত, তাঁর ওকালতনামার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
১৯২১
গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) ৭ অক্টোবর গাজ়া থেকে ইহুদি ভূমিতে ঢুকে মারাত্মক হামলা চালায় ইরান মদতপুষ্ট হামাস। ওই ঘটনায় ১,২০০ ইজ়রায়েলি নাগরিকের মৃত্যু হয়। ২৫০ জনকে অপহরণ করে গাজ়ায় নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। পাল্টা যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রত্যাঘাতে নামে ইহুদি ফৌজ। এর পরই ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) বিরুদ্ধে গাজ়ায় হাসপাতাল ও স্কুলে বিমান হামলার অভিযোগ ওঠে।
২০২১
১৯৯৮ সালের ১৭ জুলাই ‘রোম স্ট্যাটিউট’ মেনে তৈরি হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। ২০০২ সালের ১ জুলাই থেকে যা কার্যকর ভূমিকা নিয়ে আসছে। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১২৫। ২০১৯ সালে সর্বশেষ দেশ হিসেবে মালয়েশিয়া এর সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। নেদারল্যান্ডসের ‘দ্য হেগ’ শহরে রয়েছে এই আইসিসি।
২১২১
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া। এর কিছু দিনের মধ্যেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আইসিসি। ওই সময়ে আমেরিকা-সহ পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত দেশ নিশ্চুপ ছিল।