খাতা কেনারও ক্ষমতা নেই তাঁর। তাই তিনি পেনের বদলে খাতায় লেখার জন্য পেনসিল ব্যবহার করেন। যাতে লেখা মুছে প্রয়োজন মতো খাতার পাতা আবার সাদা করে ফেলতে পারেন।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
ভুবনেশ্বরশেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২৩ ১৬:০৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমায় র্যাঞ্চো বলেছিল, ‘‘বাচ্চে, কাবিল বনো! কামইয়াবি ঝক মারকে তুমহারে পিছে আয়েগি!’’ এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামের জনজাতি কন্যা কার্মা মুদুলিও র্যাঞ্চোর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত। তিনি ‘কাবিল’ অর্থাৎ যোগ্য হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দু’চোখে আইএএস বা আইএফএস অফিসার হওয়ার স্বপ্ন। আর দৃঢ় বিশ্বাস, ‘কামইয়াবি’ অর্থাৎ সাফল্য তাঁর থেকে কিছুতেই দূরে থাকতে পারবে না।
ছবি: সংগৃহীত।
০২১৮
ওড়িশার মালকানগিরি জেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে বাড়ি কার্মার। শহর থেকে বহু দূরে এই গ্রামে মূলত জনজাতিরাই থাকেন। চাষবাসই মূল পেশা। কেউ কেউ দিনমজুরের কাজও করেন। তবে পড়াশোনায় তেমন আগ্রহ নেই। সারা বছর অনটনে ভোগা মানুষগুলো দু’মুঠো অন্নের ব্যবস্থাকেই বেশি গুরুত্ব দেন। বছর কয়েক আগের সুমারি বলছে এখানে শিক্ষার হার ৬ শতাংশ। মেয়েদের পড়াশোনার হার আরও কম। কার্মা সেই গুটি কয়েকের একজন। যিনি শুধু শিক্ষিতই নন, মেধাবীও।
ছবি: সংগৃহীত।
০৩১৮
দ্বাদশের পরীক্ষায় গত অগস্টে জেলার মধ্যে শীর্ষ স্থান অধিকার করেছিলেন কার্মা। যেখানে তাঁর নিজের বাড়িতেই কেউ অষ্টম শ্রেণি পেরিয়ে নবমেও পা রাখেননি। পরিবার তো বটেই গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে কৃতী তিনিই। স্বাভাবিক ভাবেই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে মালকানগিরির মেধাবী জনজাতি কন্যা কার্মার নাম। যিনি বাণিজ্য নিয়ে দ্বাদশের পরীক্ষায় ৮৮.৬৬ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন।
ছবি: সংগৃহীত।
০৪১৮
সেই কৃতিত্ব অর্জনের পর প্রায় এক বছর কেটে গিয়েছে, কার্মার কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলেন দেশবাসী। কিন্তু কার্মা ভুলতে দিলেন না। কার্মা তাঁর কর্মগুণে আবার চলে এলেন খবরের শিরোনামে। নতুন কোনও পরীক্ষায় সাফল্য নয়। কার্মা খবর হয়েছেন সম্পূর্ণ অন্য কারণে। সম্প্রতি তাঁর গ্রামে দিনমজুরের কাজ করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
ছবি: সংগৃহীত।
০৫১৮
তাঁর গ্রামেরই অন্য মহিলারা এই কাজ করে উপার্জন করেন। কেউ কয়লা ভাঙেন, কেউ বা মাথায় করে নিয়ে যান ইট-বালি-সুরকি। পুরোটাই কায়িক শ্রমের কাজ। কলেজের গরমের ছুটিতে কার্মাও সেই কাজই নিয়েছিলেন। আশা ছিল কিছু অর্থ উপার্জন করে পড়াশোনার খরচ জোগাতে সাহায্য করবেন বাবা-মাকে।
ছবি: সংগৃহীত।
০৬১৮
গত বছর তাঁর সাফল্য দেখে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। উচ্চশিক্ষার জন্য কার্মাকে সাহায্য করেছিল তারা। তাদের সাহায্যেই এখন ভুবনেশ্বরের রমাদেবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়েছেন তিনি। কিন্তু উচ্চশিক্ষার খরচ চালানো তো মুখের কথা নয়!
ছবি: সংগৃহীত।
০৭১৮
একটি সাক্ষাৎকারে কার্মা জানিয়েছেন, পড়াশোনা চালানোর জন্য খাতা কেনারও ক্ষমতা নেই তাঁর। তাই তিনি পেনের বদলে খাতায় লেখার জন্য পেনসিল ব্যবহার করেন। যাতে লেখা মুছে প্রয়োজন মতো খাতার পাতা আবার সাদা করে ফেলতে পারেন। এবং আবার সেই পাতায় লিখতে পারেন।
ছবি: সংগৃহীত।
০৮১৮
কার্মা জানেন, এ ভাবে কালি মুছে আবার লেখার সুযোগ জীবন দেয় না। তাই বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করতে চান না তিনি। মাথায় বালির গামলা নিয়ে চড়া রোদে কাজ করতে করতেই তিনি বলেন, ‘‘আমি জানি, টাকা না থাকলে স্বপ্নপূরণ করতে পারব না। আমার পরিবার হতদরিদ্র। তাই দিনমজুর হিসাবেই কাজ করছি। যাতে আমার পড়াশোনার খরচ আমি নিজেই জোগাতে পারি।’’
ছবি: সংগৃহীত।
০৯১৮
পারিবারিক আয় বলতে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া বাবা-মায়ের বার্ধক্যভাতা। কিন্তু তা দিয়ে ছ’জনের পরিবার চলে না। কার্মারা চার ভাইবোন। দাদা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ার পর স্কুলছুট। এখন তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। বড় দিদি স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। তিনিও অষ্টম শ্রেণির পর অর্থাভাবে পড়াশোনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। কার্মার ছোট বোন অবশ্য এখনও পড়ছে। কিন্তু সামান্য আয়ে সবার খাওয়ার খরচ জুগিয়ে পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম পরিবার।
ছবি: সংগৃহীত।
১০১৮
পরিবারের কথা ভেবেই কার্মা চান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি আমলার চাকরি পেতে। আপাতত সেটাই কার্মার একমাত্র লক্ষ্য। তার জন্য যদি তাঁকে দিনে ৬-৭ ঘণ্টা পড়াশোনার পাশাপাশি দিনমজুরের কাজ করতে হয়, তিনি তা করতেও রাজি।
ছবি: সংগৃহীত।
১১১৮
কাজ করতে করতেই কার্মা এক সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বাণিজ্যে সাম্মানিক স্নাতকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। কার্মা বলেছেন, দ্বাদশের ফলের পর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আমাকে সাহায্য করেছিল। ওরা আমাকে ভুবনেশ্বরের রমাদেবী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে পড়াশোনার খরচ জোগাতে মাথায় হাত পড়েছিল আমার।
ছবি: সংগৃহীত।
১২১৮
কার্মা জানিয়েছেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেন, তাঁরা অধিকাংশই উচ্চবিত্ত পরিবারের। প্রথম প্রথম তাঁদের দেখে, তাঁরা যে ধরনের পোশাক পরেন, তেমন পোশাক পরতে এবং তাঁরা যে সমস্ত খাবার খান, তা খেতে শুরু করেছিলেন কার্মা। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর পক্ষে এটা চালানো সম্ভব নয়। এর পরই নিজের স্বপ্নপূরণের ইচ্ছে আরও জোরালো হয় কার্মার।
ছবি: সংগৃহীত।
১৩১৮
দিনমজুরের কাজ করতে করতে মালকানগিরির জনজাতি কন্যা বলেছিলেন, ‘‘ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আমি যদি চেষ্টা করি, সব করতে পারব। আমি বিশ্বাস করি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল ভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার লক্ষ্যও ছুঁয়ে ফেলব।’’
ছবি: সংগৃহীত।
১৪১৮
১৯ বছরের ছাত্রী কার্মার এই বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। প্রশাসনের কানেও পৌঁছেছে। তার পরই তাঁকে সাহায্য করার জন্য একের পর এক প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে।
ছবি: সংগৃহীত।
১৫১৮
বুধবার মালকানগিরির জেলা প্রশাসনের তরফে ৩০ হাজার টাকার একটি চেক তুলে দেওয়া হয়েছে কার্মার হাতে। ওই অর্থ ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
ছবি: সংগৃহীত।
১৬১৮
মালকানগিরির জেলাশাসক বিশাল সিংহ জানিয়েছেন, এর পাশাপাশি মেধাবীদের আর্থিক সাহায্য করার যে সরকারি প্রকল্প রয়েছে, তাতে বার্ষিক ১৩ হাজার ৩০০ টাকার একটি স্কলারশিপও পাবেন কার্মা।
ছবি: সংগৃহীত।
১৭১৮
তবে শুধু প্রশাসন নয়, কার্মা জানিয়েছেন, তাঁর খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকে অনেক ফোন পেয়েছেন তিনি। সবাই জানতে চেয়েছেন, তাঁকে কী ভাবে সাহায্য করতে পারেন তাঁরা। কার্মা জানিয়েছেন, বুধবার তাঁর অ্যাকাউন্টে দু’জন সাহায্যকারী ৫০০০ টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন।
ছবি: সংগৃহীত।
১৮১৮
কার্মা জানিয়েছেন, এই অর্থসাহায্য পেয়ে তাঁর উপকার হয়েছে। তাঁকে এখন আর দিনমজুরের কাজ করতে হবে না। তিনি তাঁর পড়াশোনায় সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারবেন এবং তাঁর আশা, একদিন তাঁর সরকারি আমলা হওয়ার স্বপ্নও পূরণ করতে পারবেন।