Besides Booklovers The Historic National Library Attracts Ghost Hunters dgtl
National Library
গভীর রাতে আসে হেস্টিংসের ‘আত্মা’! বইপ্রেমীদের মতো জাতীয় গ্রন্থাগার আকর্ষণ ভূতবিশ্বাসীদেরও
দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী এই ভবনে ১৯৫৩ সালে হয় জাতীয় গ্রন্থাগারের নতুন ঠিকানা। উদ্বোধন করেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:০০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
কলকাতার গর্বের ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’ বা জাতীয় গ্রন্থাগারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারত তথা বাংলার ইতিহাস দুই খলনায়কের নাম। তাঁরা হলেন সৈয়দ মীর জাফর আলি খান বাহাদুর এবং লর্ড জর্জ কার্জন। ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে আছে সেই আখ্যান।
০২২১
আলিপুরের অভিজাত বেলভিডিয়ার গার্ডেন হাউস জাতীয় গ্রন্থাগারের বর্তমান ঠিকানা। কথিত, নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ‘আলিপুর’-এর নামকরণ করেছিলেন নবাব মীর জাফর। ব্রিটিশদের হাতের পুতুল হয়ে সিংহাসনে বসার পরেও বেশি দিন নবাব হয়ে থাকা হয়নি তাঁর। ব্রিটিশদের অঙ্গুলিহেলনেই সিংহাসন হারিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে চলে আসতে হয়েছিল কলকাতায়।
০৩২১
কলকাতায় বেশ কিছু প্রাসাদ তৈরি করিয়েছিলেন মীর জাফর। বেলভিডিয়ার গার্ডেন হাউস তিনি উপহার দিয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসকে। এই ভবনের সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে প্রিন্স আজিম উস খানের নামও। আওরংজেবের নাতি এবং প্রথম বাহাদুর শাহ জাফরের ছেলে প্রিন্স আজিম ছিলেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার সুবেদার।
০৪২১
যুবরাজ আজিম উস খান নিজে থাকার জন্য ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে বানিয়েছিলেন ‘বেলভিডিয়ার গার্ডেন হাউস’। ইটালিয়ান ভাষায় বেলভেডেয়ার শব্দের অর্থ মনোরম দৃশ্য। বিশেষ গথিক ঘরানার স্তাপত্যকে বলা হয় ‘বেলভিডিয়ার’। পদ্ম সরোবর এবং দুর্লভ গাছে সাজানো এই প্রাসাদ বহু বার হাতবদল হয়েছে।
০৫২১
১৭৭২-১৭৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলার গভর্নর ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। বক্সার যুদ্ধের পরে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান। উপনিবেশে আবার ফিরলেন ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে। এ বার তিনি ভারতের গভর্নর জেনারেল। এবং এ বার তাঁর বাহুলগ্না সুন্দরী জার্মান ব্যারনেস মারিয়ান ইনহফ। সাধের বেলভিডিয়ার হয়ে উঠল তাঁদের বাসভবন।
০৬২১
১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে বেলভিডিয়ার হাউসকে মেজর টলির কাছে বিক্রি করে দেন হেস্টিংস। এর পর মালিকানার হাতবদল, লিজ নেওয়ার পর্ব পেরিয়ে লর্ড ডালহৌসির আমলে বেলভিডিয়ার হয়ে ওঠে ভারতের লেফ্টেন্যান্ট গভর্নরের বাসভবন।
০৭২১
দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী এই ভবনে ১৯৫৩ সালে হয় জাতীয় গ্রন্থাগারের নতুন ঠিকানা। উদ্বোধন করেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। তার আগে একাধিক বার ঠিকানা বদলেছে এই গ্রন্থাগার।
০৮২১
জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার সলতে পাকানোর পর্ব শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি’। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ‘দ্য ইংলিশম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক জোয়াকিম স্টোকেলার ওরফে জোয়াকিম হেওয়ার্ডস সেডনস। মোট ২৪ জন উদ্যোক্তার মধ্যে মাত্র দু’জন ছিলেন বাঙালি। বাবু রসিককৃষ্ণ মল্লিক এবং বাবু রসময় দত্ত।
০৯২১
তখন বলা হয়েছিল, ৩০০ টাকা অনুদান দিলে ‘ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি’-র প্রোপাইটার হওয়া যাবে। প্রথম এই অনুদান দিয়ে প্রোপাইটার হয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর।
১০২১
এর পর ‘ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু এই দু’টি পাঠাগারেই সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী এবং অভিজাত শ্রেণি ছিল এই দুই পাঠাগারের ব্যবহারকারী। এই অবস্থার পরিবর্তন চাইলেন তৎকালীন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন।
১১২১
আলাদা দু’টি গ্রন্থাগারকে মিলিয়ে দিলেন লর্ড কার্জন। প্রতিষ্ঠা করলেন ‘দ্য ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি’। প্রথম ঠিকানা ছিল মেটকাফ হল। ১৯২৩ সালে গ্রন্থাগার উঠে যায় ৬ এসপ্ল্যানেড ইস্ট ঠিকানায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরাপত্তার কারণে সাময়িক ঠিকানা হয়েছিল জবাকুসুম হাউসে (আজকের সি আর অ্যাভিনিউয়ে)। যুদ্ধ মিটলে তা আবার ফিরে আসে এসপ্ল্যানেডে।
১২২১
দেশভাগ এবং স্বাধীনতার পরে ছোটলাটের বাসভবনের প্রয়োজনীয়তা আর থাকল না। তার আগে থেকেই গভর্নরের একমাত্র ঠিকানা এসপ্ল্যানেডের গভর্নর হাউস বা আজকের ‘রাজভবন’। ১৯৪৮ সালে স্থির হল, বেলভিডিয়ার হাউস হবে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির নতুন ঠিকানা।
১৩২১
শুধু সাকিনই নয়, বদলে গেল পরিচয়ও। এ বার থেকে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি পরিচিত হল ‘দ্য ন্যাশনাল লাইব্রেরি’ বা জাতীয় গ্রন্থাগার নামে। ১৯৫৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এর দরজা খুলে দেওয়া হল স্বাধীন ভারতের সাধারণ মানুষের জন্য।
১৪২১
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার কুড়ি লক্ষেরও বেশি বইয়ের আধার এই গ্রন্থাগার। নেওয়া হয় প্রায় সাড়ে উনিশ হাজার পত্রিকা। এর গ্রন্থাগারিকদের মধ্যে অন্যতম সাহিত্যিক প্যারীচাঁদ মিত্র এবং ভাষাবিদ হরিনাথ দে।
১৫২১
বিভিন্ন সময়ে দান করা ব্যক্তিগত সংগ্রহেও সমৃদ্ধ হয়েছে এই গ্রন্থাগার। বেশ কিছু দেশীয় রাজপরিবারের তরফে বই দান করা হয়েছে। পাশাপাশি, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার-সহ বহু বরেণ্য ব্যক্তিত্বের দুর্লভ সংগ্রহে সমৃদ্ধ হয়েছে জাতীয় গ্রন্থাগার।
১৬২১
‘জাতীয় গ্রন্থাগার’ আছে দেশের বাকি শহরেও। কিন্তু ঐতিহ্যে, আভিজাত্যে তাদের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে কলকাতার আলিপুরের বেলভিডিয়ার এস্টেটের বইসমুদ্র। ৭২ বিঘা ৮ কাঠা ৪ ছটাক জমির মূল ভবন ছাড়া আরও কিছু ভবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জাতীয় গ্রন্থাগারের বিভিন্ন বিভাগ।
১৭২১
ব্রিটিশ কলকাতায় এই বেলভিডিয়ার ভবন সাক্ষী ছিল এক ঐতিহাসিক ডুয়েলের। বেলভেডেয়ার এস্টেটের কাছেই একটি গাছের নীচে হয়েছিল সেই ডুয়েল। প্রতিপক্ষ ওয়ারেন হেস্টিংস এবং ফিলিপ ফ্রান্সিস। ব্যারনেসকে নিয়ে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ডুয়েলে হেস্টিংসের গুলিতে আহত হয়েছিলেন ফ্রান্সিস। বেলভিডিয়ার হাউসেই নাকি তাঁর শুশ্রূষা হয়েছিল।
১৮২১
জার্মান ব্যারনেস মারিয়ান ভন ইমহফ থেকে যান ওয়ারেন হেস্টিংসেরই। বিয়েও করেছিলেন তাঁরা। ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন মারিয়ানের দ্বিতীয় স্বামী। হেস্টিংস দম্পতি বলডান্স করতেন এস্টেটের হলরুমে। নাচের আসরে যোগ দিতেন কলকাতার ব্রিটিশ সমাজের আমন্ত্রিত অভিজাতরা। সেই হলঘরই দীর্ঘ দিন ছিল জাতীয় গ্রন্থাগারের রিডিং রুম। পরে তা ভাষা ভবনে স্থানান্তরিত হয়।
১৯২১
গৌরবের পাশাপাশি হেস্টিংসের শাসনকাল ছিল কলঙ্কিতও। মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি এবং ইমপিচমেন্ট জড়িয়ে তাঁর নামের সঙ্গে। পরে অবশ্য তিনি কলঙ্কমুক্তও হন। কিন্তু সেই বিচারপদ্ধতি নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। অভিযোগ, তাঁকে বাঁচাতেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল মহারাজা নন্দকুমারকে।
২০২১
হেস্টিংসের শেষ জীবন কেটেছিল জন্মভূমি ইংল্যান্ডে। সেখানে গ্লসেস্টারশায়ারে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হন তিনি। তবে তিনি নাকি এখনও ভুলতে পারেননি বেলভিডিয়ার এস্টেটকে। ইংরেজি বর্ষবরণের গভীর রাতে নাকি নির্জন এস্টেটের সামনে এসে থামে এক জুড়িগাড়ি। পার্টিতে বলডান্সে অংশ নিতে আসেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস! তাঁর জন্যই কলকাতার ভূতবিশ্বাসীদের কাছে অন্যতম ‘ভৌতিক’ জায়গা ঐতিহাসিক বেলভিডিয়ার এস্টেট বা আজকের জাতীয় গ্রন্থাগার।
২১২১
ঋণস্বীকার: ক্যালকাটা ইলাস্ট্রেটেড: জন ব্যারি, ইন্ডিয়াজ ন্যাশনাল লাইব্রেরিজ: বি এস কেশবন, ক্যালকাটাজ এডিফাইস: ব্রায়ান পল বাখ, ক্যালকাটা দ্য লিভিং সিটি: সুকান্ত চৌধুরী সম্পাদিত। ছবি: আর্কাইভ এবং সোশ্যাল মিডিয়া।