রতনকে অফিসের কাজে নিয়মিত সাহায্য করতেন শান্তনু। আবার ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রামের কোথায় কোন হ্যাশট্যাগ দিতে হবে, কোন ইমোজির মানে কী, এ সব ব্যাপারেও বন্ধুকে চোস্ত করে তুলতেন সময় পেলেই। মধ্য আশির শিল্পপতির ইনস্টাগ্রাম অনুরাগীর সংখ্যা যে এখন পাঁচ লক্ষ পার করেছিল তা সেই প্রশিক্ষণের দৌলতেই। বন্ধুর উৎসাহে রতন নিজেও নিয়মিত ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করতেন।
রতনের সেই জন্মদিন পালন করা হয়েছিল ছোট্ট একটি কাপ কেকের উপর একটি মাত্র বাতি জ্বালিয়ে। পাশে শুধু এক ছিপছিপে তরুণ। তাঁর মাথাভরা ঝাঁকড়া চুল। অনায়াসে স্কুলের ছাত্র বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। জন্মদিনের আয়োজক থেকে অতিথি একমাত্র তিনিই। তিনিই শান্তনু। টাটা গোষ্ঠীর পঞ্চম প্রজন্মের এক কর্মী। রতন টাটার প্রিয় বন্ধু।
সমস্যার কারণ জানা যায়। কিন্তু সমাধান? শান্তনু ঠিক করেন রাস্তার কুকুরদের আলো জ্বলা কলার পরানো হবে। যাতে রাতের অন্ধকারেও তাদের দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কলার বানাবে কে? কেই বা পরাবে? অফিসের কাজ সামলে একার পক্ষে এত কাজ করা সম্ভব নয়। তবে এই সমস্যারও সমাধান বার করে ফেলেন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। রাস্তার কুকুরদের দেখভালের জন্য সমমনস্কদের নিয়ে তৈরি করে ফেললেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘মোটোপজ়’। এই ‘মোটোপজ়’-ই জীবন বদলে দেয় শান্তনুর।
সংস্থা তৈরি হলেও টাকা ছিল না। কলার যে বানানো হবে তার জিনিস আসবে কোথা থেকে! বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেঁড়া জিন্স জোগাড় করে আনেন শান্তনুরা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে তাতে জোড়া হয় অন্ধকারে জ্বলে এমন কাপড়। তৈরি হয় কলার। শান্তনুদের এই উদ্যোগ পুণের টাটা এলেক্সি কর্তৃপক্ষের নজর কাড়ে। সংস্থার নিউজ়লেটারে জায়গা করে নেয় ঘটনাটি। নজরে পড়ে তৎকালীন চেয়ারম্যান রতন টাটারও।
রতন নিজেও পশুপ্রেমী। তাঁর সংস্থার এক কর্মীর এমন উদ্যোগের কথা জেনে রতন নিজেই যোগাযোগ করেন শান্তনুর সঙ্গে। তাঁদের কাজকর্মের বিশদ জানাতে বলেন। সেই শুরু। শান্তনুর সঙ্গে দেখা হয় রতন টাটার। তাঁদের সংস্থাকে অর্থসাহায্য করেছিলেন রতন। তবে টাটা গোষ্ঠীর তরফে নয়। শান্তনুদের তিনি সাহায্য করেছিলেন ব্যক্তিগত ভাবে। সম্পূর্ণ নিজের অর্থ থেকে।
টাটার সঙ্গে সম্পর্কে ছিঁড়লেও দুই বন্ধুর যোগাযোগে ছেদ পড়েনি। শান্তনুর গ্র্যাজুয়েশনের শেষ দিন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন রতন। সে দিনই শান্তনুকে তাঁর সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন। রতন টাটার ব্যক্তিগত বিজ়নেস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ শুরু করেন শান্তনু। গাঢ় হতে থাকে দুই অসমবয়সির বন্ধুত্ব।
রতন টাটার সঙ্গে তাঁর কাজটা ঠিক কী রকম? জানতে চাওয়া হয়েছিল রতনের প্রিয় বন্ধুর কাছে। ঝাঁকড়া চুলের ছিপছিপে তরুণ এক বার বলেছিলেন, ‘‘ওঁর অফিসে আসার আগে আমি সমস্ত মিটিংয়ের নোট নিই। যাতে পরে বিষয়গুলি নিয়ে ওঁর সঙ্গে আলোচনা করতে পারি। তার পর উনি যখন অফিসে আসেন আমি আমার পরিকল্পনা ওঁকে জানাই। উনি নিজের পরিকল্পনা আমায় জানান। তার পর আমরা একসঙ্গে এক একটি লক্ষ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি।’’
রতনকে নতুন স্টার্টআপ সংস্থার ব্যাপারে নিত্যনতুন ধারণাও দিতেন শান্তনু। সেই সব ভাবনার বেশ কয়েকটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগও করেন রতন। এমনকি টাটা গোষ্ঠী কোন কোন নতুন ক্ষেত্রে নিজেদের ডানা মেলতে পারে সে ব্যাপারেও রতনকে নিয়মিত তত্ত্বতালাশ দিতেন তাঁর বন্ধু তথা সহকারী শান্তনু। এর পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর নিজের ভাবনাচিন্তাগুলোকে রূপ দেওয়ার কাজও।
যেমন সমৃদ্ধ হতেন টাটা গোষ্ঠীর প্রাক্তন চেয়ারম্যান রতনও। শান্তনু সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাদের একই বিষয়ে আগ্রহ ছিল। সেই থেকেই আলাপ। তবে শান্তনুর যে বিষয়টা আমার ভাল লাগে তা হল ওর সজীবতা। সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে ওর উদ্বেগ। স্বজাতিকে টেনে নামানোর পৃথিবীতে এমন ভাবনাচিন্তা আজকাল খুব কমই দেখা যায়।’’
রতনকে নিয়ে ইতিমধ্যে একটি বইও লিখে ফেলেছেন শান্তনু। বইয়ের নাম ‘আই কেম আপন আ লাইটহাউস’। বন্ধু রতনের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন মুহূর্তের কথা, তাঁদের দু’জনের বন্ধুত্বের কথা শান্তনু লিখেছেন সেই বইয়ে। তবে বই না বলে ডায়েরি বলাই ভাল। শান্তনু জানিয়েছেন, রতনের সঙ্গে কাটানো তাঁর মুহূর্তগুলি তাঁর মা তাঁকে একটি ডায়েরিতে লিখে রাখতে বলেছিলেন। তবে বন্ধুত্ব যত বেড়েছে সংখ্যা বেড়েছে ডায়েরির। তাঁর বই সেই ডায়েরির পাতা থেকেই সটান তুলে আনা।
বয়সের ফারাক অনেকটাই। তবে শান্তনু আর রতন সেই ফারাক অনায়াসে কাটিয়ে উঠেছিলেন। কাজের সূত্রে একসঙ্গে সময় কাটাতেন তাঁরা। তবে মাঝেমধ্যেই তাঁদের আড্ডা চলত কাজের বাইরেও। একসঙ্গে সিনেমা দেখতেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেদের চিন্তাভাবনার সহজ বিনিময় করতেন দু’জনে। বন্ধুত্ব যে কোনও বেড়া মানে না, বয়স বা সামাজিক প্রতিষ্ঠা যে সেখানে কোনও ভাবেই বিচার্য নয়, তার প্রমাণ শান্তনু আর রতন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy