আজ সেই বাড়িটা। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
১৭ ফেব্রুয়ারি। সন্ধেবেলা। প্রতি বছর এ দিনটার মতো গলদঘর্ম হয়ে লালবাড়ির ফুটপাথের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ছোটাছুটি করে চলেছেন সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।
দু’খানা বিশাল সাইজের মাইক ভাড়া নিয়ে রাস্তার দুই প্রান্তের দুটো ল্যাম্পপোস্টে ফিটিং-এর কাজে তদারকি করছিলেন তিনি।
এ দিন সাহিত্যিকের একমাত্র ছেলে ‘মাসকিউলার ডেসট্রফি’র মারণরোগে আক্রান্ত জয়-এর জন্মদিন।
জয়ের খবর গানের শিল্পী মহলে রটে গিয়েছিল যাঁর কল্যাণে, তাঁর নাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আমাদের দুই ভাইবোনের ‘হেমন্তকাকু’। প্রথম বার বাড়িতে এসেই তিনি দেখেছিলেন ‘জয়’-কে। শুনেছিলেন, গান জয়ের প্রাণ। গান শুনলে তার আর কিচ্ছু লাগে না। সব কষ্ট চলে যায়, পেট ভরে যায়। আরামের ঘুম এসে যায়।
এর পর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল নামী শিল্পীদের লালবাড়িতে হাজির করানোর তাঁর অবশ্য কর্তব্য। সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতাপাদিত্য রোডের পৈতৃক বাড়ির টকটকে ইট-রঙের জন্য ‘লালবাড়ি’ বলত পাড়ার সকলে।
আশুতোষ-পুত্র ‘জয়’।
ফিরে যাই ১৭ ফেব্রুয়ারি, জয়ের জন্মদিনের সন্ধেয়। সবার আগেই এসে যেত হেমন্তকাকু আর তার স্ত্রী বেলা কাকিমা। কাকিমা দোতলায় জয়ের শোবার ঘরের মেঝেতে নিজের হাতে বিছিয়ে দিত বাহারি শতরঞ্চি।
তার ওপর বাজনা নিয়ে বসে গান গাইতেন গায়ক-গায়িকারা। আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের ভিড়ে লালবাড়ি তো উপচে পড়তই!
গান-পিয়াসি বাইরের লোকেরা? এমন দিনে এমন সমস্ত শিল্পীর গান যাতে সবাই শুনতে পায়, সেজন্য পাড়ার দুই প্রান্তের ল্যাম্পপোস্টে ঢাউস-ঢাউস মাইকের ব্যবস্থা হত।
মাঝরাত গড়িয়ে যেত সেই গানের আসর। শেষমেশ বেলা কাকিমা সবাইকে “ওঠো ওঠো” করতে করতে শতরঞ্চি গোটাতে শুরু করত।
লতা মঙ্গেশকর। শীতের ভোর। সাতটাও বাজেনি। কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে গানের নাইটেঙ্গেলকে নিয়ে লালবাড়িতে এসে হাজির হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
পুবমুখো ঘর ভরে গেছে গিনি-গলা কাঁচা সোনার রোদে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঢুকলেন সেই ঘরে। পেছনে লতা মঙ্গেশকর। এনে বসালেন একেবারে শোওয়ার খাটে, যেখানে ব্যাকরেস্টের ওপর আধশোওয়া সাহিত্যিকের ছেলে।
পুরো ঘরে যেন নিমেষে হাজার সূর্য জ্বলে উঠল। অবাক চোখে দেখছিলাম, সরস্বতীর বরপুত্রীর সাধারণ বেশভূষা। সব অতি সাধারণ। কেবল অসাধারণ লেগেছিল পায়ের পাতায় দু’ছড়া অপূর্ব সোনার নূপুর!
পায়ে সোনা? বরাবর জানতাম পায়ে সোনা ঠেকাতে নেই। সোনা লক্ষ্মী।
চলে যাওয়ার পর সে কথা বাবাকে বলতে সাহিত্যিক নির্দ্বিধায় বলে উঠেছিল, “উনি তো একাধারে লক্ষ্মী-সরস্বতী দুই-ই! উনি পায়ে সোনা পরবেন না তো কে পরবে?”
লতা মঙ্গেশকর যতক্ষণ ছিলেন নির্নিমেষে ব্যথা-ভরা চোখে সাহিত্যিক-পুত্রকে দেখছিলেন। তাঁকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিচ্ছিলেন হেমন্তকাকু, বলাচ্ছিলেন আশুতোষের অসুস্থ ছেলেকে দিয়েও। “জয়, লতাকে ওই গানটা গাইতে বলো!”
কী কী গান, বা ক’টা গেয়েছিলেন, আজ আর মনে পড়ে না। কারণ ওই বয়েসে শোনার চেয়ে শোবার ঘরে খাটের ওপর বসা, পায়ে স্বর্ণ-মঞ্জরী পরা, বিয়ে না হয়েও কপাল আর সিঁথির গোড়ায় মেটে রঙের সিঁদুর লাগানো অনন্যা কণ্ঠের অধীশ্বরীকে হাঁ করে দেখছিলাম অনেক বেশি।
পরে শুনেছিলাম, ওটা পুজোর সিঁদুর। শীতের ওই সকালে স্নান করে পুজো সেরে সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অসুস্থ ছেলেকে দেখে গেলেন, গান শুনিয়ে গেলেন, গানেই ‘হরি ওম’ প্রার্থনা করে গেলেন ভাল হয়ে ওঠার।
বারবার অনুরোধে গাইতে গাইতেই থেমে গিয়েছিলেন ‘মেরে বতন কি লোগোঁ/ জারা আঁখো মে ভর লো পানি...’ নিজের চোখে জল এসে গিয়ে বুজে গিয়েছিল ওঁর গলা।
লালবাড়িতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
আশা ভোঁসলে। প্রচণ্ড বৃষ্টির রাত। ঝকমকে শাড়ি আর ঝলমলে হিরের গয়নায় সেজে এলেন তিনি। সটান বসে পড়লেন সেই খাটে।
ভাঙা ভাঙা বাংলা-হিন্দির মিশেলে বাবা-ছেলের উদ্দেশে বলে উঠলেন, “তুমলোগ হামার খুব আপন আছো। আশুতোষ মেরি পোতা। তো তুম (জয়কে) মেরি পর্পোতা, পোতা কা বেটা।” সঙ্গে সেই অদ্ভুত মাদক-মাখা ঝিনঝিনে হাসি।
হেমন্তকাকু ব্যাখ্যা করল, “ওর পোতা মানে ওর নাতির নামও আশুতোষ, তাই আপনাকে (বাবাকে) ওর নাতি বানালো। জয়কে নাতির ছেলে পুতি।’’ ঘরে তখন হাসির ফোয়ারা। এর পর সাহিত্যিকের ছেলেকে সরাসরি আশার সেই বিখ্যাত গানের কলি ‘হাল ক্যায়সা হ্যায় জনাবকা’ একটু বদলে দিয়ে প্রশ্ন, “নাম ক্যায়া হ্যায় জনাবকা?”
‘জয়’ শুনেই সঙ্গে সঙ্গে দু’আঙুল উঁচিয়ে ভিক্টরি চিহ্ন দেখিয়ে বললেন, “তব তো তুম উইনার হো বেটা! আধি-ব্যধি সব্ জিত্ লেঙ্গে তুম্। ঠিক হ্যায় না?” মুহূর্তে নিজে থেকেই শুরু করলেন গানের পর গান ‘চোখে চোখে কথা বলো না’র থেকে অনায়াস ঝাঁপ “মেরা নাম হ্যায় শব্নম...’। পরক্ষণেই গলা একেবারে খাদে নামিয়ে ঘন হাস্কি স্বরে, “পিয়া তু অব তু আ যা।”
রাহুল দেববর্মনের জায়গাগুলো, “হামিই পঞ্চমেরটা করছি” বলে অবিশ্বাস্য নিপুণতায় একেবারে অন্যরকম মোটা গলায় ‘হুর্রা, হুর্রা’ থেকে ‘মণিকা ও মাই ডার্লিং’!
রাত কত গড়াচ্ছে, কারও তো খেয়াল নেই-ই, জানতে ইচ্ছেও নেই। শেষে ‘ময়না বলো তুমি কৃষ্ণ রাধে’র পর হেমন্তকাকু সোজা হাত ধরে উঠিয়ে দিল, “আর নয়, এবার চলো।” এ বার বাধ্য হয়েই উঠে দাঁড়িয়ে খুব ভাল করেই জেনে বুঝে কুট করে দুষ্টুমি, “কিঁউ? ভাল লাগছে না?” জয় ততক্ষণে মন্ত্রমুগ্ধ আবেশে ওই অনবদ্য গান্ধর্বী গায়িকার ঝলমলে হিরের আংটি পরা আঙুল টেনে ধরেছে শক্ত হাতে, “যেয়ো না, তুমি যোয়ো না।”
মুহূর্তে পাল্টে গেলেন উদ্দাম ঝলমলে শিল্পী। আঙুল না ছাড়িয়ে অন্য হাতে অসুস্থ ছেলের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে গভীর স্নেহে বলে উঠলেন, “ফির আয়েগী... আবার আসব-ও। তু তো মেরি পোতা কা বেটা না? আনা তো পড়েগাই।”
আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, যেতে যেতে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, জোর করে ধরে রাখা ঠোঁটের হাসিতে তখন বিন্দু বিন্দু কান্নার শিশির।
হেমন্তকাকুর এ বাড়িতে প্রথম পা পড়েছিল আশুতোষের ‘দীপ জ্বেলে যাই’ সিনেমার মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে কোনও আইনগত সমস্যায় পড়ে। সেই দিন থেকে আশুতোষের ও নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এক অচ্ছেদ্য বাঁধনে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন মূলত জয়ের জন্যই।
প্রথম দিনের কথা বলি। গাড়ি থেকে হারমোনিয়াম দোতলার ঘরে তুলে বললেন, “গানের আগে একটা গল্প বলি। তখন অনেক ধরাধরি করে কোনও রকমে আমার প্রথম রেকর্ড বের হয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ছটফট করে মরছি। লোকে শুনবে তো? একটা মতলব ভাঁজলাম। রেকর্ডটা ভাল ব্রাউন পেপারে মুড়ে ভর-দুপুরে ঘেমে নেয়ে একেক দিন একেক জন নামকরা মানুষের বাড়ি যেতে লাগলাম। এঁদের শোনানো গেলেই অব্যর্থ পাবলিসিটি। প্রত্যেককে একই কথা ‘এই এ দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, যা গরম! ভাবলাম একবার দেখা করে একটু জল খেয়ে যাই’... বলতে বলতে কাগজে মোড়া ঢাউস রেকডর্টা চোখের সামনে নামিয়ে রাখলাম। বুকের মধ্যে ধুকপুক এই বার নিশ্চয়ই অবধারিত প্রশ্ন আসবে ‘এটা কী?’ আর ব্যস্, তা’হলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু...” থেমে গেলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
সলজ্জ স্বীকারোক্তি লাজুক মুখে, “জল এল, কোথাও জলের সঙ্গে টলও। কিন্তু আমার নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের ওই অবধারিত প্রশ্নটা কোথাও এল না। খানিকক্ষণ বোকার মতো বসে থেকে শেষে নিজের রেকর্ড বুকের সঙ্গে সেঁটে গুটি গুটি পায়ে প্রস্থান।”
এ বার সকলকে চমকে দিয়ে তাঁর বিখ্যাত হা-হা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলেন সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, “আরে মশাই! কী আশ্চর্য! আমারও যে ওই একই ব্যাপার! ... নিজের পয়সায় ছাপা প্রথম তিনখানা বই প্যাকেট করে আমিও যে ওই একই রকম কম্ম করে বেড়িয়েছি। কেউ ফিরেও তাকায়নি।”
পুত্রের সঙ্গে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।
এত গান গেয়েছেন হেমন্তকাকু আমাদের বাড়িতে, কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি। তবে মনে পড়ে, প্রায় প্রত্যেকবার জয়ের কাছে তার বাবার ছবি ‘দীপ জ্বেলে যাই’-এর ‘এই রাত তোমার আমার’ গাইতে হতই, চড়চড়ে রোদ কী ঘোর অমাবস্যাতেও।
আর বারবার বলা সত্ত্বেও গাওয়ানো যেত না আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবির ‘যাই চলে যাই/আমায় ডেকো না পিছু’ গানটি।
তবে শেষ পর্যন্ত গেয়েছিলেন। জয় চিরদিনের মতো চলে যাওয়ার আগে এবং তিনি কানাডা প্রোগ্রাম করতে যাওয়ার সময় না-জেনেই শেষ দেখা করতে এসেছিলেন।
ছবির মতো এখনও চোখে ভাসে। কথাসাহিত্যিকের ষোলো বছরের মুমূর্ষু ছেলে তাঁকে বলছে, “এইবার ওই গানটা গেয়ে দিয়ে যাও!” প্রত্যেকবারের মতো সে বার আর পাশ কাটিয়ে না গিয়ে গানটা ধরলেন। কিন্তু গাইতে পারলেন না পুরোটা। ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে চোখে হাত চাপা দিয়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললেন।
একবার কলকাতায় এক জলসার পরের দিন বেলা এগারোটা নাগাদ লালবাড়িতে হাজির মুকেশ।
গভীর রাত পর্যন্ত গেয়েছেন। এ দিনই বিকেলের ফ্লাইট ধরবেন। তারই ফাঁকে তাঁকে নিয়ে এলেন হেমন্তকাকু।
সেদিন ওয়ার্কিং-ডে, বাড়ির বড়রা অফিসে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে। বাবার দুপুরের পরে অফিস, তাই বাড়িতে। তা ছাড়া মা-জেঠি-কাকিমারা ছাড়া অতবড় জয়েন্ট ফ্যামিলির বাড়িও ফাঁকা। আমি ছিলাম কারণ, আমার ভাই আমাকে ফিসফিস করে বলেছিল, “দিদিভাই, আজ যে ভাবে পারিস, বাড়িতে থাক।”
বলতে বলতেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পেছু পেছু মুকেশ।
ধড়মড় করে উঠে বসেছি। বাবা লেখা ছেড়ে ছুটে এসেছে। বাড়ির অন্যরাও। খাটে বসিয়ে মুকেশকে ধরিয়ে দেওয়া হল গাড়ি থেকে নামানো তাঁর নিজস্ব হারমোনিয়াম। চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম অতি সুদর্শন মানুষটিকে, যিনি বয়সকালে যে কোনও হিরোকে টেক্কা দিতে পারতেন।
মুকেশ খানিক চেয়ে রয়েছিলেন রোগজর্জর আধশোওয়া ছেলেটির দিকে। যে অতি পরিচিতের মতো তাঁকে তাগাদা দিচ্ছে, “কী হল, গাও? আজ বিকেলেই তো চলে যাবে!”
হেমন্তকাকু হেসে উঠেছেন, “ও বলছে, আর সময় নষ্ট না করে চটপট শুরু করো।” মুকেশ ধরলেন, ‘কভি কভি মেরে দিল মেঁ/খেয়াল আতা হ্যায়।’ করুণ মমতায় কথাগুলো যেন জয়ের উদ্দেশ্যেই উচ্চারণ করলেন। তারপর একটানা পর পর গেয়ে গেলেন নিজে থেকেই, ‘দোস্ত দোস্ত না রাহা’, ‘জানে কঁহা গ্যয়ে উও দিন’...।
ভারী হয়ে উঠছিল ঘর। যেন সব জেনেবুঝেই মাঝখান থেকে ধরলেন, ‘কাল খেল মেঁ হাম হো না হো’।
হাফ ডজন গান গেয়ে থামতে গেলেন। তখন সাহিত্যিকের পঙ্গু হয়ে যাওয়া ছেলে একমুখ হেসে বলে উঠল, “জানি, কেন এই কষ্টের গানগুলো গাইলে, যাবার আগে তোমার ওই মজার গানটা গেয়ে যাও ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি।”
বিবর্ণ অপরাধী হয়ে উঠল ধরা-পড়া সুন্দর মুখ। আস্তে আস্তে দু’দিকে মাথ
পেছনে পেছনে বাবার সঙ্গে আমি। মা বিভ্রান্ত হয়ে ছেলের কাছে বসা, উঠে আসতে পারছে না তাকে ছেড়ে। অস্থির ভাবে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করে জর্জকাকা বলছিলেন “দেবে না, আমাকে গাইতে দেবে না”।
এর পরই দু’হাতে মাথা চেপে ধরে নিবিড় বেদনায় উচ্চকিত আবৃত্তি করে চললেন, “মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি/ হে রাখাল বেণু তব বাজাও একাকী/ প্রান্তর-প্রান্তের কোণে রুদ্র বসি তাই শোনে/ মধুরের স্বপ্নাবেশে ধ্যানমগন আঁখি/ হে রাখাল বেণু তব বাজাও একাকী/ বাজাও একাকী/ বাজাও একাকী,” দু’চোখ বেয়ে জল উপচে উঠল। নিবিড় বাঁধনে তাঁকে বুকে টেনে নিল কথাসাহিত্যিক।
সময় ফুরিয়ে আসছে। সকলেই বুঝতে পারছে। ছেলে নিজেও বোধহয় সেটা বুঝেও তার হেমন্তকাকুকে অনুযোগের সুরে বলল, “রফি, কিশোরকুমার আর মান্না দে-কে আর কবে আনবে?” হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অস্ফুট স্বরে কথা দিয়েছিলেন, “খুব শিগগিরই।”
এর পরই একদিন। আমি তখন স্কুলের উঁচু ক্লাসে। বাড়ি থেকে আর্জেন্ট ফোন এল। কিছু হয়ে গেল না তো? কাঁপা গলায় ‘হ্যালো’ বলতেই ওধারে বাবার ফিসফিসে কথা, “শোন, মহম্মদ রফি আসছেন। জয় তোকে যে করে হোক চলে আসতে বলল।”
অনুমতি চাইতেই অসম্ভব কড়া প্রিন্সিপাল চেয়ার ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘হোয়াট হ্যাপেনড? এনিথিং রং?” মরিয়া হয়ে তাঁকে সত্যি কথাটাই বললাম। তাতে কড়া প্রিন্সিপাল একগাল হেসে গোদা বাংলায় বলে উঠলেন, “বলছ কী? দাঁড়াও তোমার সিক গেটপাস করে দিয়ে আমিই তোমায় নিয়ে যাচ্ছি।”
বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন ভেসে আসছে সেই দুর্দান্ত গান ‘চৌধভিঁ কা চাঁদ হো ইয়া আফতাব হো...’।
হেমন্তকাকু মান্না দে-কে নিয়ে এসেছিলেন বেশ রাত করে। কোনও ফাংশন থেকে, সঙ্গে অনেকগুলো মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট। ছেলে বলল, “আগে আমার বাবার সিনেমার গানগুলো শোনাও, তার পরে অন্য গান।” মান্না দে-কে কন্ডিশন দিচ্ছে ষোলো বছরের ছেলে!
ছেলের কথায় প্রথমেই গাইলেন তার বাবার ‘শঙ্খবেলা’ সিনেমার ‘আমি আগন্তুক আমি বার্তা দিলাম’, তারপর ওই একই ছবির ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’র অর্ডার শুনে যেন আঁতকে উঠলেন, “ওরে বাবা! এ তো লতার সঙ্গে ডুয়েট! কী করে গাইব?”
ছেলের অকুতোভয় জবাব, “তুমি গাও না, লতা মঙ্গেশকরের জায়গাগুলো আমি বলে দেব।”
শেষ পর্যন্ত কিশোরকুমারকে ধরে আনার প্রায়-অসাধ্য কাজটিও করে ফেলেছিলেন হেমন্তকাকু। সাহিত্যিকের ঘরে তখন সব দিক থেকেই শেষ অবস্থা।
ঘোর দুপুর। ছেলের দাবিতে তাঁকেও গাইতে হয়েছিল তার বাবার সিনেমার গান। ‘সফর’-এর ‘জিন্দেগি কা সফর’। গানটা গেয়ে নিজেই চুপ করে বসেছিলেন মাথা নিচু করে। ছেলের তাড়া খেয়ে সোজা তার চোখে চোখ রেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে ধরলেন, ‘জীবন সে ভরি তেরি আঁখে’, ‘মেরা জীবন কোরা কাগজ’...। হঠাত্ স্বমূর্তি ধারণ করলেন, “আর একটাও আমি তোর কথামতো গান গাইব না। যত্তোসব ‘ইয়ে’ গান। এ বার এটা শোন।”
বলেই গলা দিয়ে টিপিক্যাল কিশোরকুমার-আওয়াজ বার করে, ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’। গেয়েই ভোঁভাঁ দৌড়। সোজা গাড়িতে। পিছনে হেমন্তকাকু আর বাবা। গাড়িতে বসে চোখ মুছতে মুছতে কিশোরকুমার বললেন, “কী যে করেন, এমন জায়গায় আমার মতো মানুষকে কেউ আনে?”
১৯৭৭। ১২ জুলাই। সন্ধে ৭টা ২৩। চলে গেল সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র ছেলে। সেই ব্যাকরেস্টে, আধশোওয়া। জপের মুদ্রায় দুই হাত। হাসি হাসি মুখ। আধখোলা চোখ। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল খবর। কলকাতায় থাকা সমস্ত শিল্পীতে ভরে উঠল লালবাড়ি। শেষ বারের মতো।
দূরে, কানাডায় তার হেমন্তকাকু তখনও জানে না, একেবারে বহু দূরে বরাবরের জন্য পাড়ি দিয়েছে তার বড় আদরের জয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy