সম্প্রতি আইসিসিআর সত্যজিৎ রায় অডিটোরিয়াম-এ ‘চয়নিকা’ (ভারত-বাংলাদেশ) সংস্থার একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হল। অনুষ্ঠানের মূল ভাবনা ছিল ‘রবিকিরণে শৈলজারঞ্জন’ এই মর্মে একটি প্রামাণ্য তথ্যচিত্র প্রদর্শন আর ছিল ভারত-বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য, সেই সঙ্গে গান। অনুষ্ঠানের শুরুতেই দু’ দেশের শিল্পীদের সম্মেলক কণ্ঠে দু’ দেশেরই জাতীয় সঙ্গীত। এর পর শৈলজারঞ্জনের পরিবারের কিছু সদস্য সমবেত কণ্ঠে ‘আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে’ গানটি সম্ভবত কোনও মহড়া ছাড়াই পরিবেশন করেন।
দ্বিতীয় পর্বে বিশিষ্ট অতিথিদের মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার জন্য ঘোষিকার পক্ষ থেকে অনুরোধ এল শুধু একটি নাম বাদ দিয়ে। যে নামটি আমন্ত্রণ পত্রে সভাপতির আসন অলংকৃত করার জন্য লিপিবদ্ধ ছিল। এর পর এই অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা এবং ‘রবির কিরণে শৈলজারঞ্জন’ এই প্রামাণ্য তথ্যচিত্রের নির্মাতা বাংলাদেশের এস.বি.বিপ্লব তাঁর বক্তব্য রাখলেন। বিশেষ করে উল্লেখ করলেন এই তথ্যচিত্র নির্মাণ এবং বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁকে কতখানি জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অবশ্য অনেক সহৃদয় ব্যক্তির উৎসাহ ও সহযোগিতা তাঁকে কতখানি অনুপ্রাণিত করেছিল এবং সাহস জুগিয়েছিল তাও উল্লেখ করলেন। মঞ্চে উপবিষ্ট গুণিজনদের মধ্য থেকে কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে স্বরলিপিকার, সুর সংরক্ষক প্রভৃতি বিশেষণে বিভূষিত শৈলজারঞ্জনের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তাঁর গায়নরীতির উৎকর্ষের কথা উল্লেখ করলেন। উদাহরণ স্বরূপ বললেন শৈলজারঞ্জনের কণ্ঠে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ শুনে মনে হয়েছিল যে গানটি যেন নতুন শোনা যদিও এর আগে বহু বার বিভিন্ন জনের কণ্ঠে শুনেছেন। নবনীতা দেব সেন তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে তথ্যচিত্রটির সাফল্য কামনা করেন। পশ্চিমবঙ্গে নিযুক্ত বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার আবিদা ইসলাম তাঁর ভাষণে তথ্যচিত্রটি নির্মাণের প্রশংসা করেন। এর পর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী জনাব আবদুল লতিফ সিদ্দিকি, তাঁর সুচিন্তিত ভাষণে শৈলজারঞ্জনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সভাপতি অধ্যাপক ড. অরুণকুমার বসু বলেন, দিনু ঠাকুরের মতো শৈলজারঞ্জনও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সুরের ভাণ্ডারি, স্বরলিপিকার। কিন্তু শুধু কি তাই? রবিঠাকুরের গানকে স্বরলিপির শৃঙ্খলে বাঁধা ছাড়াও তিনি তাঁর অসাধারণ গায়নরীতির সাহায্যে গানে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, পেলবতা দিয়েছিলেন। আসলে কবিকে শৈলজারঞ্জন দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। প্রাণের গভীর গহন থেকে উৎসারিত এক একটি গান রচনার সময় শৈলজারঞ্জন প্রত্যক্ষ করেছিলেন কবির হৃদয়ের আকুতি ও অনুভূতি। কবির খুব কাছের মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন রবিরশ্মিজালে আচ্ছন্ন। তাই তাঁর সুর সংরক্ষণের ধারাটিও অতি স্বতন্ত্র। রবীন্দ্রনাথের গানের গভীরতম আত্মাকে আত্মস্থ করার ফলে তাঁর গায়নরীতিতে পড়েছিল সেই অনুভূতির প্রভাব যা তাঁর গানগুলিকে অতীন্দ্রিয় গানে পরিণত করেছিল।
এই অনুষ্ঠানে এই প্রথম ‘রবীন্দ্র-শৈলজারঞ্জন’ সম্মাননা প্রদান করা হয় দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে। বাংলাদেশের অধ্যাপিকা বাঁশরী দত্ত এবং কলকাতার প্রসাদ সেনকে। ‘রবিকিরণে শৈলজারঞ্জন’ এই তথ্যচিত্রটির নির্মাতা বাংলাদেশের এস.বি.বিপ্লব এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন যিনি প্রচার বিমুখ, অনেকের কাছেই অপরিচিত অথচ সঠিকভাবে ও নিঃস্বার্থভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার ও প্রসারে যাঁর অবদান অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর আরাধ্য দেবতা।
এই প্রচারবিমুখ ব্যক্তির পরিচিতির ক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলায় তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি যাতে করে এই অপরিচিত এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতে সমর্পিত প্রাণ ব্যক্তিটির কথা সবাই জানতে পারেন। বাংলাদেশের এস.বি.বিপ্লব এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করে সকলের প্রশংসার পাত্র হবেন এই বিষয়ে কোনও দ্বিধা নেই।
শেষ পর্বে দু’ দেশের গায়ক-গায়িকা সঙ্গীত পরিবেশন করলেন। বাংলাদেশের নীলোৎপল সাধ্য, ছায়া কর্মকার, রীতা মজুমদার, আইনুন নাহার ও সুমাইয়া ফারাহ্ খান এবং পশ্চিমবঙ্গের সুরঞ্জন রায়, সুছন্দা ঘোষ, রণজয়ব্রত রায়, অসীম ভট্টাচার্য। এর মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ্য ছায়া কর্মকার, রীতা মজুমদার, সুমাইয়া, সুছন্দা ঘোষ, সুরঞ্জন রায়ের গান।
শেষে একটি কথা শৈলজারঞ্জন হারমোনিয়াম যন্ত্রটি পছন্দ করতেন না। যেহেতু এই অনুষ্ঠানটি তাঁকে উপলক্ষ করে সেই হেতু অনুষঙ্গ যন্ত্রের প্রতি উদ্যোক্তাদের সতর্ক হওয়া সমীচীন ছিল। গায়ক গায়িকারা তাঁর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত না হলেও এমন ভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন যাতে শৈলজারঞ্জনের কোনও রকম অসম্মান বা অবমাননা না হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy