যে থিয়েটারের সঙ্গে শম্ভু মিত্রর নাম প্রায় একই সাথে উঠে আসে।
যে থিয়েটার দেখে সত্যজিত্ রায় খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর ‘ঘরে বাইরে’-র বিমলাকে।
বেটোর্ল্ট ব্রেখটের সেই ‘গ্যালিলেও গ্যালিলেই’ আবার ফিরতে চলেছে বাংলার নাটমঞ্চে।
পৃথিবী স্থির। সূর্য, চন্দ্র, অন্যান্য গ্রহ পৃথিবীর চার ধারে ঘোরে। বিজ্ঞানী টলেমির আমল থেকে এই ছিল মানুষের বিশ্বাস। চার্চেরও। চার্চের ব্যাখ্যা, মানুষ ঈশ্বরের সন্তান। কাজেই মানুষের বাসস্থান পৃথিবীই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার চারধারেই তো অন্যদের ঘোরার কথা। এই ধারণাটি চলতে থাকে বহু বহু বছর।
প্রথম উল্টো কথাটি বলেন বিজ্ঞানী কোপারনিকাস। সূর্য স্থির, তার চার ধারে ঘোরে পৃথিবী সহ অন্য গ্রহের দল। সবিস্তার তা নিয়ে বড়সড় একটি বইও লিখে ফেলেন তিনি। ‘দে রিভলিউশনিবাস অরবিয়াম সেলেস্টিয়াম’। বিতর্ক তখন থেকেই। গ্রহ-তারা নিয়ে প্রায় একই রকম অবস্থান নেওয়ায় জিওদার্নো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়।
এর পর গ্যালিলেওর পালা। অত্যাধুনিক দূরবিন বানিয়ে গ্রহ-তারার চলন দেখে তাঁরও ধারণা হয়, কোপারনিকাস ঠিকই বলেছেন। যে কারণে সংলাপধর্মী একটি বইও লেখেন তিনি। ‘ডায়লগ কনসার্নিং টু নিউ সায়েন্সেস’। কোপে পড়েন একদা বন্ধু স্বয়ং পোপের। শেষমেশ গৃহবন্দি হতে হয় গ্যালিলেওকে।
শোনা যায়, গ্যালিলেওকে নিয়ে সারা পৃথিবীতে ঝড় তোলা এই নাটকটি স্বয়ং ব্রেখট নিজেই লেখেন তিনবার। তৃতীয়বার নাকি গ্যালিলেওকে তিনি আর ‘হিরো’ মানতে পারেননি। সে অবশ্য অন্য তর্ক। খোদ বাংলায় এই নাটকটি অভিনীত হয়েছে অসংখ্য বার। শম্ভু মিত্র ছাড়াও যে নাটকের সঙ্গে জুড়ে আছেন যে ক’জন থিয়েটার-কর্মী, তাঁরাও কম ওজনদার নন। কুমার রায়, বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত থেকে দীপা ঘোষ (দাশমুন্সি), সৌমিত্র বসু। এমনকী বিখ্যাত জার্মান নির্দেশক ফ্রিত্স বেনেভিতস্ যখন ভারতে আসেন, তখন কলকাতার সাতটি দল মিলে প্রোডাকশন নামায় ‘গ্যালিলেওর জীবন’।
পুরনো নাটক ফিরিয়ে আনার বড় আপদ হল, প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ চলে একটা ছায়ার সঙ্গে। সেই চ্যালেঞ্জটি সঙ্গে করেই কাজে নেমে পড়েছে প্রযোজক নিভা আর্টস ও তার সৃজন সহযোগী নাট্যদল ‘প্রাচ্য’। পরিচালক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাষান্তর রতনকুমার দাস।
২০১৪-য় উইলিয়াম শেক্সপিয়রের সঙ্গে সাড়ে চারশো বছরে পৌঁছনো বিজ্ঞানী গ্যালিলেওকে এ ভাবেই স্মরণ করেছেন তাঁরা। যার প্রথম অভিনয় ১৫ অগস্ট, তপন থিয়েটারে। পরিচালকের কথায়, যত দিন সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংঘাত থাকবে, মৌলবাদের থাবা দেখা যাবে, গাজা, ইজরায়েল-এর মতো নৃশংসতা ফিরে ফিরে আসবে, তত দিন গ্যালিলেওর মতো প্রতিবাদীরা থাকবেন। এ নাটক তাই প্রাসঙ্গিক তখনও। আজও।
অধুনা ‘ক্যালিগুলা’-র মতো সফল নাটক নামানো বিপ্লব মঞ্চের সঙ্গে আছেন প্রায় আড়াই দশক। তাঁর এ বারের নাটকে বড় তাস হতে চলেছেন ‘গ্যালিলেও’ পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়। এক সময়ের ইউনিভার্সিটি ব্লু, ময়দানে উয়াড়ি ক্লাবের গোলকিপার পীযূষের ঝুলিতে প্রায় দুশো টিভি সিরিয়াল থাকলেও মঞ্চে তিনি উঠছেন আশির দশকের শেষ থেকে। তার মধ্যে ভারী নাটক নেহাত কম নয়। ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’, ‘জোছনাকুমারী’, ‘আকরিক’ থেকে ‘ভাইরাস এম’, ১৭ই জুলাই, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘বাবলি’, ‘সিনেমার মতো’...।
নাটকের দ্বিতীয় বড় তাস অবশ্যই গ্যালিলেওর মেয়ে ভার্জিনিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করা মোনালিসা চট্টোপাধ্যায়। নাটমঞ্চে যার বয়স বছর দশেক পেরিয়েছে। কাজ করেছেন অবন্তী চক্রবর্তী থেকে ব্রাত্য বসুর মতো পরিচালকের সঙ্গে।
তপন থিয়েটারে দিন কয়েক আগে মহলা দেখতে গিয়ে মনে হল, এ নাটকের ট্রাম্পকার্ড অবশ্যই হতে চলেছে বিশ্বনাথ দে-র সেট আর জয় সেনের আলো। পিছন দিকে বড়সড় সেট স্কোয়্যার-এর দুটো প্লাইউড। মঞ্চের দু’পাশে দুটো এক্সটেনশন। একেবারে মাঝেও আনুভূমিক তল এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা। তিনটিকেই এমন ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে দর্শকও কখনওসখনও হয়ে পড়বেন নাটকের নির্বাক চরিত্র।
মঞ্চের একেবারে সামনের দিকে একটা আয়তক্ষেত্রাকার জাল। যে জালের ওপরে প্রজেক্টার থেকে এসে পড়বে কখনও রাতের আকাশ, কখনও গ্রহ-তারা ভরা সৌরজগতের আলো-আঁধারি খেলা। বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামে গোল চাঁদোয়ায় যেমন ছবি ভাসে, এ যেন অনেকটা তেমনই। ফারাক শুধু এখানে খেলাটা ঘটতে থাকবে মাথার ওপরে নয়, চোখের সমান্তরালে। তার সামনে-পিছনে হাঁটাচলা করবে নাটকের কুশীলব। মোমবাতি হাতে যাজকের দল, চার্চের ঘণ্টা, গসপ্যাল, জালের সৌরমণ্ডল মিলে মিশে অদ্ভুত একটা ইলিউশন কাজ করবে বার বার! অনেকটা যেন সিনেমার মায়াজাল থেকে রক্তমাংসর নাটকে যাওয়া, আবার নাটক থেকে সিনেমায় ফেরা।
সব মিলিয়ে আয়োজন দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে, ছায়াযুদ্ধটা হয়তো থাকবে, কিন্তু তাকে বাগে আনতে তৈরি আজকের ‘প্রাচ্য’। আর যাই হোক, খেলাটা কিছুতেই ব্রাজিল-জার্মানি মার্কা একতরফা সাত-শূন্য হতে পারে না। কিছুতেই না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy