চারিদিকে বিদ্রোহের আগুন, ক্ষমতা দখলের লড়াই। রক্ত শুষে নেওয়ার নেশায় বুদ হয়ে আছেন সাম্রাজ্যের অধিপতিরা, সৈনিকেরা তথা নর-খাদকেরা। আরও কত প্রাণ, আরও কত রক্ত, আরও কত মায়ের বুক খালি ... ! এই ধ্বংসলীলার মধ্যেই এক সর্বহারা মা স্বপ্ন দেখছেন তার সন্তানকে নিয়ে। সমস্ত ভালবাসা দিয়ে তার সন্তানকে গড়ে তুলবেন, আগলে রাখবেন। ছেলে যেন কোনও দিন যুদ্ধে না যায়। মানুষকে ভালবাসতে শেখে। এই মায়ের পণ। কিন্তু এই একা মা কি পারবে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে? সম্প্রতি কলকাতা রঙ্গিলা-র প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হল শৈলেন ঘোষের কাহিনি অবলম্বনে কৌশিক করের নির্দেশনায় ‘মা এক নির্ভীক সৈনিক’ নাটকটি।
যুদ্ধ, হত্যা, ক্ষমতার আস্ফালন, সব কিছুকে ছাপিয়ে এ নাটকে মুখ্য হয়ে ওঠে সন্তানের প্রতি মায়ের চিরন্তন ও অকৃত্রিম ভালবাসা। আর এই ভালবাসার কাছেই শেষপর্যন্ত নতজানু হতে হয় ক্ষমতাকে। বিষয়টি হয়তো নতুন নয়। পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের বা বীভৎসতার রূপ-রং একই। আর তার অন্য খাতে প্রবহমান ভালবাসা। কিন্তু এ নাটকের উপস্থাপনার কৌশল বিদ্ধ করে দর্শকদের। এখানেই নির্দেশক কৌশিকের সার্থকতা। নাটকের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক। আনাতুরী এক মৃত সেনাপতি স্তানের স্ত্রী, তার কোলের পুত্র সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নেয় শত্রুপক্ষের সৌরামতি রাজার রাজ্যে। সেখানেই ছেলে কোহেনকে স্নেহ-মমতা দিয়ে বড় করে তুলেছেন আনাতুরী। চারিদিকের যুদ্ধ-বিগ্রহের পরিবেশের মধ্যেও ছেলেকে এসব থেকে দূরে রাখতে চান। কিন্তু ছেলের ঝোঁক যে যুদ্ধে। এখানেই কঠিন লড়াই আনাতুরীর।
প্রথমেই বলতে হয় নাটকের প্রথম দৃশ্যের কথা। যুদ্ধের পরিবেশ। আবহে ভেসে আসছে হুহা হুহা শব্দ। যা যুদ্ধের আবহকে আরও ভয়ঙ্কর করে। মঞ্চে সৈনিকদের উল্লাস। একটা মৃতদেহের হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে আনা হয়। এরই মধ্যে মঞ্চের অন্য প্রান্তে এক প্রাণের জন্ম হয়। শিশু সন্তান। দৃশ্যটি ভোলার নয়।
আনাতুরীর চরিত্রে অঙ্কিতার অভিনয়ে ধরা পড়ে অসহায় মায়ের আর্তনাদ। মন ছুঁয়ে যায় অঙ্কিতার অভিনয়। এক সময় নিজের রাজ্যের রাজার প্রতি আনুগত্য স্বরূপ আনাতুরীকে শত্রুপক্ষের লোক গণ্য করে মায়ের বিরুদ্ধে কোহেন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। সেই যুদ্ধের দৃশ্যে অস্ত্র ফেলে ছেলের কাছে মায়ের করুণ আর্তি ‘বাপ আমার... আমায় বন্দি করিস না, হত্যা কর।’ এ দৃশ্য চোখে জল এনে দেয়। পুরুষালি সুঠাম দেহ, গম্ভীর কণ্ঠস্বর, শরীর জুড়ে ক্ষমতার আস্ফালন আর সর্বদা ক্ষমতা দখলের নেশায় মত্ত মোশেনের চরিত্রে বেশ মানিয়ে যায় কৌশিক। তাঁর অভিনয় অনেক দিন মনে থাকবে।
মূল গল্পের বাইরে গিয়ে কৌশিক কয়েকটি নতুন চরিত্রকে তৈরি করেছেন নাটকের প্রয়োজনে। যেমন মোশেন চরিত্রটি। ক্ষমতার চূড়ায় আরোহণ করেও একসময় এক ক্ষমতাহীনের হাতে তার পতন অনিবার্য হয়। যা প্রতীকবহ। কিংবা গ্রিফিন। শৈলেন ঘোষের ‘মা এক নির্ভীক সৈনিক’ গল্পে এ চরিত্রটিও ছিল না। গ্রিফিন আধা মানুষ, আধা রাক্ষস। অনেকটা মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভাল-মন্দ দুটো সত্তার মতো। লোম্যান (প্রিয়ঙ্ক দাস) চরিত্রটিও খুব যত্ন নিয়ে গড়েছেন কৌশিক। একজন শিল্পী, যিনি গান করেন আবার কাঠের কাজ করেন, ঘর বাঁধেন। কোহেন চরিত্রে গম্ভীরা ভট্টাচার্য অসাধারণ। নিজেকে এই চরিত্রে উজাড় করে দিয়েছেন। বিশ্বজিৎ দাস-এর বুমবুজাং রাজা চরিত্রটিও প্রশংসনীয়। সাদা কালো গ্রিফিনের চরিত্রে ত্র্যম্বক ভট্টাচার্য অনবদ্য। সৌরামতি রাজার চরিত্রে পলাশ কর্মকার সহ অন্যান্য চরিত্ররাও যোগ্য সঙ্গত করেছে।
নাটকের বিরতি দৃশ্যেও ছিল চমক। কোহেনের ছোড়া পাথরের আঘাতে মোশেন ছিটকে পড়ে মঞ্চের বাইরে একেবারে দর্শকদের পায়ের নীচে। পর্দা পড়ে যায়। মিনিটখানেক হলেও ওঠে না মোশেন। চমকে যান দর্শকেরা। শেষে দুজন সৈন্য এসে বেঁধে নিয়ে যায় মোশেনকে। কৌশিকের কথায়, এই অংশকে কেউ বিরতি হিসেবে ধরতে পারে আবার নাও পারে। ক্ষমতার পতন আচমকাই হয়, এটাই বোঝানো হয়েছে। নাটকের শেষ দৃশ্য খুবই ট্র্যাজিক। যেখানে মিশে থাকে নিষ্ঠুর বাস্তব। যুদ্ধবাজ ছেলের বিরুদ্ধে মায়ের যুদ্ধ সফল হয়। জয় হয় ভালবাসার। রষ্ট্রামের ওপরে মায়ের কোলে শায়িত সন্তানের প্রাণহীন নিথর দেহ। মঞ্চজুড়ে অন্ধকার। শুধু তাদের পেছনে চাঁদের
উজ্জ্বল আলো। আর নীচে মঞ্চে আনাতুরীর পদতলে রাজা সহ সৈন্যদের দল। নাটকের আলো করেছেন দীপঙ্কর দে, মঞ্চসজ্জায় বিশ্বজিৎ দাস। আবহে অভিজিৎ আচার্য। ‘যেখানে দিন ডুবে রাত জাগে ...’ নাটকে ব্যবহৃত গানটির গীতিকার শুভঙ্কর দাশশর্মা প্রশংসা পাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy